বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

আপডেট: মে ৩১, ২০২১
0

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের ৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভার শুরুতে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী সুরাইয়া বেগম এবং রোকেয়া সদনের শিক্ষার্থীবৃন্দ। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

অনুষ্ঠানে সংগঠনের প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানমকে সুবর্ণজয়ন্তী সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননাপত্র পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। ‘মহিলা পরিষদের ৫০ বছরের পথ চলা ও বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ’ বিষয়ক একক বক্তৃতা করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি এবং লেখক, গবেষক ও প্রকাশক মফিদুল হক। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের লেখা থেকে পাঠ করেন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম। প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানমের পরিবারের পক্ষ থেকে স্মৃতিচারণ করেন তার একমাত্র কন্যা উর্মি খান এবং ননদ সদস্য সৈয়দা মনিরা আক্তার খাতুন

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন ৪এপ্রিল ২০২০ থেকে বছরব্যাপী গৃহীত কর্মসূচি পালনের সময় প্রয়াত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ, সভাপতি আয়শা খানম এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক বুলা ওসমান সহ সংগঠনের সাথে যুক্ত প্রয়াত সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সংগঠনের এই গৌরব মুহুর্তে যারা পাশে ছিলেন তাদের জানাই অভিবাদন। নারী মুক্তি মানব মুক্তি- সুফিয়া কামালের এই দর্শনকে ধারণ করে এবং দেশের সকল সংগ্রামের ধারাকে সাথে নিয়েই মহিলা পরিষদের যাত্রা। এই পাঁচ দশকের পথচলায় সকল পরিবর্তনকে সাথে নিয়ে এবং বৈশ্বিক আন্দোলনে যুক্ত থেকে সংগঠন কাজের ধারা অব্যাহত রেখেছে।

সমাপনী অনুষ্ঠানে সংগঠনের প্রয়াত সভাপতি আয়শা খানমকে সুবর্ণজয়ন্তী সম্মাননা প্রদান করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।

এসময় সম্মাননাপত্র পাঠ করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। তিনি বলেন বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের সাথে সংগঠনকে যুক্ত করার পাশাপাশি তৃণমূলে গণনারীদের মাধ্যমে সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটিয়ে বৃহত্তর স্বেচ্ছাসেবী গণনারী সংগঠন হিসেবে মহিলা পরিষদকে গড়ে তুলতে আয়শা খানমের মেধা, প্রজ্ঞা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভূমিকা অপরিসীম। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজে স্রোতের বিপরীতে উজান ঠেলে নারী আন্দোলনকে একটি দৃঢ় ও টেকসই অবস্থানে নিয়ে আসতে প্রয়াত আয়শা খানম যে অবদান রেখেছেন তা সংগঠন সবসময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইমাম বেগম রোকেয়ার লেখা সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসটির অংশবিশেষ উপস্থাপন করে বলেন অপূর্ব এই সংলাপ তিনি আজ থেকে অনেক বছর আগে রচনা করেন। তিনি নারীমুক্তির বিষয়টি অনেক আগেই উপলব্ধি করেন। রোকেয়ার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মহিলা পরিষদ অত্যন্ত সফলভাবে নিরলস পরিশ্রম করে কাজ করছে।

একক বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি এবং লেখক, গবেষক ও প্রকাশক মফিদুল হক বলেন, মহিলা পরিষদের পথচলা আর আমাদের দেশের পথচলা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে মহিলা পরিষদের যাত্রা শুরু হয়। তিনি যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নারীর অবস্থা ও অবস্থানের কথা তুলে ধরে বলেন প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে মহিলা পরিষদ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। এসময় উজ্জীবিত তরুণীদের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করে মহিলা পরিষদ। তিনি সুফিয়া কামাল, মনোরমা বসু ও হেনা দাসের অবদানের কথা তুলে ধরেন বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংগঠন বিস্তারে, জনজীবনের কল্যাণ এবং নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনে নারীর অধিকার সংযুক্ত করায় কাজ করতে তৎপর হয়, পাশাপাশি বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের সাথে সংঘঠন নিজেকে যুক্ত করতে থাকে। দীর্ঘ এই পথচলায় অর্জনসমূহও এসেছে। যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়নে সামাজিক আইন গড়ে তোলায় ছিলো সংগঠনের নিরবিচ্ছিন্ন প্রয়াস, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশব্যাপী প্রতিরোধ ভূমিকা গড়ে তোলা, ১৯৭৫ সালকে নারীদশক ঘোষণা করতে, সিডও সনদ প্রণয়ণের দাবি আদায়ে সংগঠন অবদান রাখে। এসময় নারী বান্ধব নানা আইনের কথা তুলে ধরে বলেন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনমত গঠনে সংগঠন কাজ করেছে এবং এখনো করছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে, নারীদের অবদানের কথা বলা হচ্ছে। একে টেকসই করতে হলে নারীর উন্নয়নের পথে সকল বাধা দূর করতে হবে। ধর্মান্ধতা, নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ সংগঠনকে করতে হবে; অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

প্রয়াত নেত্রীর পরিবারের পক্ষে তার একমাত্র কন্যা উর্মি খান তার পাঠানো লেখাতে স্মৃতিচারণ করেন।এর বাংলা অনুবাদ উপস্থাপন করেন সংগঠনের আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা। তার লেখায় উর্মি বলেন এমন সুন্দর আয়োজনে আমার মা থাকতে পারবেন না ভাবিনি। এসময় তিনি সম্মাননা দেয়ার জন্য মহিলা পরিষদকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। পাশাপাশি তিনি তার শৈশবে মহিলা পরিষদের সাথে থাকা স্মৃতির উল্লেখ করে বলেন আমি যেমন আমার মায়ের কাছে প্রিয় ছিলাম তেমনি তার কাছে প্রিয় ছিল মহিলা পরিষদ। তিনি মহিলার আগামী ৫০ বছরের উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে বলেন তিনি এই পরিবারের একজন কন্যা হতে পেরে গর্বিত।

অপর সদস্য সৈয়দা মনিরা আক্তার খাতুন বলেন সে আমার সহপাঠী, সহযোদ্ধা এবং পরিবারের একজন সদস্য। দীর্ঘ ৬২ বছর আমরাএকত্রে কাটিয়েছি। কাজের বিষয়ে আয়শা অত্যন্ত দৃঢ প্রতিজ্ঞ ছিলো। মহিলা পরিষদ তার রেখে যাওয়া লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা রেখে বক্তব্য শেষ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম উপস্থিত সকলকে আন্তরিক অভিবাদন জানিয়ে বলেন আমাদের নারী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা ও অর্জনের সহযাত্রী সকলেই। জাতীয় জীবনের অগ্রগতি নারীর জীবনের মূল চালিকাশক্তি। নারীর উন্নয়ন ব্যতীত প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাই নারী উন্নয়নে দেশে দেশে রাষ্ট্র নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তবে উন্নয়ন নারীর ক্ষমতায়নের দিকটিকে সমৃদ্ধ করছে কিনা তা দেখতে হবে। কেননা নারীর ক্ষমতায়নেই মূল লক্ষ্য নিহিত। প্রতিটি উন্নয়নে নারীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবেলায় সমাজকে প্রস্ততু করার পাশাপাশি সরকারের সাথে সংগঠনকে কাজ করতে হবে। নারী-পুরুষের সমান উন্নয়নের জন্য প্রশাসনকে কাজ করতে হবে। নারীর অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে সকল পশ্চাৎপদ আইন, নীতি ও ট্যাবু ভেঙে নারীর প্রকৃত উন্নয়নে সংগঠন কাজ করে যাবে এমন প্রত্যাশা রেখে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।

আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাঁচ দশকের কার্যক্রমের উপর স্লাইড প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি সভায় সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীআজিজুর রহমান তুহিন। কবি সুফিয়া কামালের লেখা ‘অমৃত কন্যা’ কবিতা আবৃত্তি করেন আবৃত্তি শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও অভিনেতা ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

অনুষ্ঠানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠন,সাংস্কৃতিক, ব্যক্তিত্ব,শিক্ষাবিদ, আইনজীবি, ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ এবং কর্মকর্তাসহ ৬০ জন উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম।