বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের অধিবেশন-২০২২ অনুষ্ঠিত

আপডেট: আগস্ট ১০, ২০২২
0


দুঃশাসন ও অব্যাহত দুর্নীতি লুটপাটের কারণে দেশ আজ মহাসংকটে : অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান

বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেছেন, বাংলাদেশ তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে। ক্ষমতাসীন সরকারের দুঃশাসন ও অব্যাহত দুর্নীতি লুটপাটের কারণে এই মহাসংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রে সৎ মানুষের শাসন কায়েম ছাড়া এই সংকট দূর হবে না।

তিনি আজ রাজধানীর একটি মিলনায়তনে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সাধারণ অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আতিকুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে আরও উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি গোলাম রব্বানী, লস্কর মুহাম্মদ তসলিম, কবির আহমদ, মুজিবুর রহমান ভূইয়া, মনসুর রহমান প্রমুখ।

অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলেন, সরকার সারাদেশে বাজারগুলোতে সিন্ডিকেট তৈরি করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জিম্মি করেছে। আজ মানুষ হাটে-বাজারে যেতে পারছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি চলছে। চাল-ডাল-তেলের দাম নিম্ম আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে গেছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেল ও ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি করে মানুষদের আরও বিপাকে ফেলেছে। প্রতিদিন কোন না কোন জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। কিন্তু সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে অযৌক্তিক ও বেহুদা কথাবার্তা বলে সিন্ডিকেট ও কালোবাজারীদের আশকারা দিচ্ছে। সরকারের আশকারা পেয়ে তারা অবৈধ সম্পদ ও কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার শ্রমিকবান্ধব সরকার নয়। যদি তারা শ্রমিকবান্ধব সরকার হতো তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শ্রমিকের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতো। কিন্তু সরকারের এই উদ্যোগ গ্রহণ করার মতো মানসিকতা নেই। তারা চায় তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের কালো টাকা ও সম্পদে ভরপুর করে তুলতে। যেন তারা আগামী নির্বাচনে এই টাকা ব্যবহার করে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু তারা জানে না দেশের জনগণ তাদের প্রতি এতটাই অসন্তুষ্ট যে সুষ্ঠু ভোট হলে ক্ষমতাসীন দলের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলেন, চলমান অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের মানুষ যখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে তখন সরকার তাদের পুরানো রূপে ফিরে গেছে। তারা অস্ত্রের মুখে মানুষের প্রতিবানেদর ভাষা স্তব্দ করে দিতে চায়। তাই সারা দেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন-গুম, গ্রেফতার আবার শুরু করেছে। আমরা কারাগারে আটক বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলামসহ সকল রাজবন্দিদের আশু মুক্তি দিতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

আজকের এই সম্মেলনে নিম্মোক্ত প্রস্তাবনা গৃহীত হয়েছে

১. আজকের এই কার্যকরী পরিষদের অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাহিরে চলে গেছে। আজ শ্রমজীবী মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আজকের এই অধিবেশন মানুষের দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে আশু মুক্তির জন্য সকল সিন্ডিকেট ভেঙে সকল দ্রব্যমূল্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে জোর দাবি জানাচ্ছে।

২. এই অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে যে, সরকার ইউরিয়া সারের দাম কেজি প্রতি ৬ টাকা বৃদ্ধি করে কৃষকদের বিপাকে ফেলে দিয়েছে। এই দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে। এই থেকে উত্তরণের জন্য অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধি প্রত্যাহারের জন্য আজকের অধিবেশন দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের শ্রমশক্তির ৬৫ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। কিন্তু দেশে এখনোও কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে না উঠার কারণে কৃষক পণ্যের নায্য মূল্য পাচ্ছে না। ফলে কৃষক কাজের আগ্রহ হারাচ্ছে এবং তাদের আর্থিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। এই অধিবেশন সরকারি ও বেসরকারি ভাবে কৃষি ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে।

৩. আজকের অধিবেশন আরও গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে, সরকারের অহেতুক ভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি দেশকে মহাসংকটের দিকে ফেলে দিচ্ছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কৃষক হতে শুরু করে সমাজের নিম্ম আয়ের মানুষের জীবন আবারও ধাক্কা খেয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে যানবাহনের ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের ইশারায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষদের জিম্মি করে জ্বালানি তেল চারগুণ দামে বিক্রি করছে। আজকের এই অধিবেশন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি প্রত্যাহার করে জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে জন-জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে। আজকের এই অধিবেশন জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ভুর্তকি বৃদ্ধি করার দাবি জানাচ্ছে।

৪. এই অধিবেশন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলাম (সাবেক এমপি) ও সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার (সাবেক এমপি) সহ সকল রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে এবং রাজনৈতিকভাবে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে দেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে।

৫. শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, শিল্প বাঁচলে দেশ বাঁচবে এবং দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় হবে। টেকসই উৎপাদন খাতকে মজবুত করতে হলে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাই এই অধিবেশন সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান ঠিক রাখার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানাচ্ছে।

৬. আজকের এই অধিবেশন মনে করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সর্বনিম্ম মজুরী ৮০০০/- টাকা নির্ধারণ করা হলেও অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক শ্রমিকদের সর্বনিম্ম মজুরি না দিয়ে বিভিন্নভাবে শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এমনকি দাবি আদায়ের আন্দোলনকে দমনের নামে হয়রানি ও গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুত করছে। এই অধিবেশন গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে গৃহিত কালাকানুন টার্মিনেশন এ্যাক্ট বাতিল করে পূর্বের আইন বহাল করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং সর্বনিম্ম মজুরি ২০০০০/- টাকা ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট নির্ধারণ করে মজুরি কমিশন ঘোষণা করার দাবি জানাচ্ছে। সকল বন্ধ গার্মেন্টস খুলে দিয়ে শ্রমিকদের চাকুরিতে বহাল রাখার জোর দাবি জানাচ্ছে।

৭. আজকের এই অধিবেশন বন্ধকৃত ২৬টি জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারিদের যাবতীয় বকেয়া পাওনাদি অবিলম্বে পরিশোধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং বিএমআরই পদ্ধতিতে আধুনিকায়ন করে উক্ত ২৬ট জুট মিলসহ সরকারি ও বেসরকারি বন্ধকৃত সকল কল-কারখানা অবিলম্বে চালু করার জোর দাবি জানাচ্ছে।

৮. এই অধিবেশন আইএলও কনভেনশন মোতাবেক অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে সরকার ও শ্রম অধিদপ্তরকে জটিলতা সৃষ্টি না করে সহজ শর্তে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।

৯. এই অধিবেশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে যে, পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারলে পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশা শেষ হবে না। তাই অধিবেশন পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধ করার জোর দাবি জানাচ্ছে এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে দুর্ঘটনা কবলিত পরিবহন শ্রমিকদের জন্য কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকা বরাদ্ধ দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।

১০. আজকের এই অধিবেশন মনে করে যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অগ্রগতি মানে দেশের উন্নতি। তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে দ্রুত আধুনিকায়নের পাশাপাশি ঢাকা-লাকশাম-ঢাকা কর্ড লাইন, দোহাজারী-কক্সবাজার ও বগুড়া, জামতইলসহ সারাদেশে রেলওয়ে সম্প্রসারণ করার জোর দাবি জানাচ্ছে।

১১. আজকের এই অধিবেশন মনে করে যে, শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান কুরআন সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রমজীবী মানুষসহ সকল স্তরের শ্রমিক জনতাকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পতাকাতলে শামিল হওয়ার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।