‘বিনয়’ মুমিনের এক অপরিহার্য গুণ

আপডেট: জুলাই ২, ২০২১
0

।। মুফতি রাশেদুল ইসলাম ।।

বিনয় যখন কারও হাসিল হবে তখন এর আলামত প্রকাশ পাবে তার ওঠা-বসায়, কথা-বার্তায়,এমনকি হাঁটা-চলায়ও। আল্লাহ তাআলার প্রকৃত সেই বান্দাদের বৈশিষ্ট্যাবলি পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখিত হয়েছে-
وَعِبَادُالرَّحْمٰنِالَّذِیْنَیَمْشُوْنَعَلَیالْاَرْضِهَوْنًاوَّاِذَاخَاطَبَهُمُالْجٰهِلُوْنَقَالُوْاسَلٰمًا.

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত প্রাপ্তির পর, মক্কার কুরাইশ কাফেরদের অত্যাচারের মাত্রা যখন দিন দিন কঠোরতর হচ্ছিল, আল্লাহ তাআলা তেমনি এক রাতে আকস্মিকভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে গেলেন আরশে আজিমের কাছে। প্রথমে মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস, এরপর সেখান থেকে উপরের দিকে যাত্রা। একেক আসমান অতিক্রম করে, সাত আসমান পেরিয়ে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আবার সে রাতেই ফিরে আসেন মক্কায়। এ ঘটনাকে আমরা ‘মেরাজ’ বলে স্মরণ করি। মেরাজ শব্দের অর্থই হলো ঊর্ধ্বারোহণ। ঘটনাটি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের আরও বহু গ্রন্থে সবিস্তারে উল্লেখিত হয়েছে। আর পবিত্র কুরআনে এসেছে-
سُبْحٰنَالَّذِیْۤاَسْرٰیبِعَبْدِهٖلَیْلًامِّنَالْمَسْجِدِالْحَرَامِاِلَیالْمَسْجِدِالْاَقْصَاالَّذِیْبٰرَكْنَاحَوْلَهٗلِنُرِیَهٗمِنْاٰیٰتِنَا.

পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে এক রজনীতে স্বীয় নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য ভ্রমণ করিয়েছেন আলমাসজিদুল হারাম থেকে আলমাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ,যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়। (সূরা বনী ইসরাঈল- ১)।

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাটির পৃথিবী থেকে সাত আকাশের বাধা অতিক্রম করিয়ে মহান রাব্বুল আলামীন এই যে কাছে নিয়ে গেলেন, এরপর আবার তিনি ফিরিয়ে ও আনলেন এই পৃথিবীতে, জানা কথা, এই সম্মান কেবলই তাঁর। নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন বলে তিনি পরিচিত ‘মূসা কালীমুল্লাহ’ নামে। কিন্তু কথা বলার জন্যে একেবারে কাছে ডেকে নেয়া- এখানে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনন্য। নবী-রাসূলের মহান কাফেলার তিনি সর্দার- সায়্যিদুল মুরসালীন ওয়ান নাবিয়্যীন। এ মর্যাদাবানদের মাঝেও তিনি শ্রেষ্ঠতর। তাই এ বিরল সম্মান তিনিই পেয়েছেন।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানব-ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনি যে বিরল সম্মান পেয়েছেন, সে ঘটনার বর্ণনায় মহান প্রভু তাঁকে কী বলে পরিচয় করাচ্ছেন? উপরের আয়াতেই বিষয়টি স্পষ্ট- পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর ‘বান্দা’কে এক রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছেনন …। এত সম্মান ও মর্যাদা যাকে দিলেন, তাঁর তো অনেক পরিচয়ই ছিল। তিনি আল্লাহর নবী, রাসূল। তিনি নবী-রাসূলগণের সর্দার। তিনি সর্বশেষ নবী। কিন্তু এসব কিছুই না বলে আল্লাহ তাআলা এ ঘটনায় তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন নিজের বান্দা বলে। আল্লাহর যথার্থ বান্দা হতে পারার মাহাত্ম্য এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। বান্দা হওয়ার পরিচয়ে যে যত বেশি সফল, আল্লাহ তাআলার নিকট তার মর্যাদা ততটাই উন্নত। ইবাদত শব্দের অর্থই হলো দাসত্ব ও বন্দেগি। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দাসত্ব পূর্ণ মাত্রায় সম্পাদন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সকল সৃষ্টির সেরা, মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দা।

এ দাসত্বের গুণ যে যতটা বেশি হাসিল করতে পারবে, মহান প্রভুর সামনে সে নিজেকে ততটাই তুচ্ছ ও মুখাপেক্ষী মনে করবে। নিজেকে এভাবে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে করার নামই বিনয়।

বান্দা খাঁটি মনে বিশ্বাস করবে, আমার যা কৃতিত্ব এর কিছুই আসলে আমার নয়, এসবই আমার প্রতি আমার আল্লাহর দান। আমার যা সম্পদ এগুলো আসলে কিছুই আমার অর্জন নয়, সবই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। দুনিয়াতে প্রাপ্ত সবকিছুকেই যখন আল্লাহর নিআমত হিসেবে কেউ মেনে নেবে, তখন অনিবার্যভাবেই সে হয়ে উঠবে কৃতজ্ঞ ও বিনয়ী। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগিতে যখন বিনয় ও কৃতজ্ঞতার পরশ থাকবে, সকল প্রাপ্তিকেই যখন সে কেবলই আল্লাহর দান বলে মেনে নেবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে মুক্ত থাকবে অহংকার ও বড়াই থেকে। অবচেতনভাবেই তার আচার-আচরণ হবে বিনয় ও নম্রতায় পূর্ণ।

এ বিনয় যার যতটা হাসিল হবে, বান্দা হিসেবে সে ততটাই সফল। আল্লাহ পাকের বিধিবিধানের সামনে সে ততটাই নিজেকে সঁপে দিতে পারবে। শোকর আর কৃতজ্ঞতায় ততটাই আপ্লুত হবে তার হৃদয়-মন। বাহ্যত নিজের শ্রমে-ঘামে কিংবা অর্থ-মেধায় অর্জিত সফলতাকেও যখন সে আল্লাহর দান বলে বিশ্বাস করবে, তার স্তরে উন্নীত নয় এমন কাউকে দেখে তখন তার মনে অহংকারের পরিবর্তে যোগ হবে কৃতজ্ঞতার এক নতুন মাত্রা। পরম বিনয়ে সে মনে মনে বলবে- সকল কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহর, যিনি আমাকে তাঁর অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। বাস্তবিক অর্থেই যে নিজেকে এভাবে মিশিয়ে দিতে পারে মাটির সাথে, মাটির পৃথিবীতেই আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মানের আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট ঘোষণা-
مَنْتَوَاضَعَلِلَّهِرَفَعَهُاللهُ،فَهُوَفِينَفْسِهصَغِيرٌ،وَفِيأَعْيُنِالنَّاسِعَظِيمٌ.

আল্লাহর জন্যে যে বিনয়ী হয় আল্লাহ্ তাকে সমুন্নত করেন; তখন সে নিজের চোখে তুচ্ছ হলেও মানুষের চোখে অনেক বড় বিবেচিত হয়। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস- ৭৭৯০)।

‘রাহমান’-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে… । (সূরা ফুরকান- ৬৩)।

আরেক আয়াতে হাঁটা-চলাতে বিনয়-নম্রতার আদেশ করা হয়েছে এভাবে-
وَلَاتَمْشِفِیالْاَرْضِمَرَحًااِنَّكَلَنْتَخْرِقَالْاَرْضَوَلَنْتَبْلُغَالْجِبَالَطُوْلًا.

ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না, তুমি তো কখনোই পদভারে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত সমান হতে পারবে না। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৭)।