কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ
পারভেজ মোশাররফ নামের এক যুবক পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল পুড়ে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল উৎপাদন করছেন। তার এই উদ্ভাবনী কাজ দেখতে বাড়িতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার লোকজন।এতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে ওই এলাকায়। পারভেজের তৈরি করা তরল জ্বালানি অদূর ভবিষ্যতে খনিজ সম্পদে প্রভাব ফেলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
তার পুরোনাম পারভেজ মোশারফ। সে উপজেলার পাথরডুবী ইউনিয়নের মইদাম গ্রামের কৃষক বদিউজ্জামানের পুত্র। পারভেজ মইদাম মহাবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেনীর ছাত্র।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে তার বাড়ীর উঠানেই একটি আবদ্ধ ড্রামে পরিত্যক্ত পলিথিন রেখে আগুনে তাপ দিয়ে পলিথিন গলিয়ে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন তৈরি করেছেন। এসব জ্বালানি দিয়ে মটর সাইকেল চালিয়ে এলাকার মানুষকে অবাক করে দিয়েছে। এছাড়া মাটি ও পানিতে ওই তরল পদার্থ ফেলে আগুনে প্রজ্বলিত করে পেট্রোল কিনা সেটাও প্রমাণ করেছেন। তার উদ্ভাবিত পেট্রোল ও অকটেন ব্যবহারকারী এলাকার কিছু মটর সাইকেল চালক বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।। আর ডিজেল দিয়ে চলছে কৃষি উৎপাদনে পাওয়ার টিলার ও সেলো মেশিন।
বিস্তারিত জানতে পারভেজ মোশাররফের সাথে কথা বললে তিন বলেন, সে মইদাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাশ করি। পরে তার এলাকায় নব্য প্রতিষ্ঠিত মইদাম মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেনিতে ভর্তি হই। আড়াই বছর আগে ইউটিউবে তৌহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তৈরির একটি ভিডিও দেখি। পরে সেখান থেকে রিসার্চ করে আমি করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল পুড়ে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল তৈরির চেষ্টা করি। সেসময় প্রায় ১২০ লিটার জ্বালানি তেল সংগ্রহ করি। পরবর্তী সময়ে সারা দেশে করোনা ভাইরাসের মহামারী শুরু হলে তার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর তার কয়েকজন বন্ধুর উৎসাহ ও সহযোগিতায় গত ১৯ আগস্ট থেকে পুনরায় জ্বালানি উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু করি।
পারভেজ আরো বলেন, পরিত্যক্ত পলিথিন যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে এগুলো সংগ্রহ করে একটি আবদ্ধ প্রকোষ্ট ড্রামে ভিতরে রেখে আগুনে অতিমাত্রায় তাপ প্রয়োগ করে গলিয়ে ফেলা হয়। বাস্পায়িত হয়ে ডিজেল এবং নল দিয়ে বের হয়ে পেট্রোল অকটেন তৈরি হয়। সর্বশেষ পাইপ দিয়ে গ্যাস বের হলে সেখানে আগুন দিলে আগুন লেগে থাকতো। যত তাপমাত্রা বেশী দেয়া হত তত বেশী তরল পদার্থ নির্গত হয়। সেই সাথে গ্যাস বের হয়। এসব সংগ্রহীত তরল পদার্থ ছাকনি দিয়ে পরিশোধন করা হয়।
পারভেজের দাবী , এই তরল পদার্থ গুলো হাইড্রোকার্বন তাই এগুলো ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও এলপি গ্যাস। তিনি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সুযোগ না পেলেও প্রাথমিকভাবে মাটিতে ঢেলে আগুন দিয়ে পরীক্ষা করে এর সত্যতা পেয়েছি।
তিনি বলেন কয়েক হাজার টাকা খরচ করে বাজার থেকে তেলের একটি বড় টিনের ড্রাম , একটি মাঝারি প্লাস্টিকের ড্রাম, ছোট দুইটি ড্রাম ও কন্টেইনার, প্রায় ৭ ফুট স্টিলের পাইপ ও কয়েক হাত প্লাস্টিকের ফিতা কিনে কাজ শুরু করছি। পরিত্যাক্ত পলিথিন ৩০ টাকা কেজি দরে কিনে নেই। এরপর বিশেষ প্রক্রিয়ায় পলিথিনগুলো টিনের ড্রামে ভরে প্রায় আধাঘণ্টা ড্রামের নিচে খড়ি দিয়ে জ্বাল দেন। এতে প্রায় ১ মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয়। এরপর ড্রাম থেকে নির্গত গ্যাস স্টিলের পাইপ দিয়ে এসে প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে রাখা পানিতে ঠাণ্ড হয়ে প্রেট্রোল এবং ডিজেল ছোট কন্টেইনারে জমা হয়। ১০ কেজি পলিথিন থেকে প্রায় ৭ লিটার জ্বালানি পাওয়া যায়। প্রতি লিটার জ্বালানি ১০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।এর মধ্যে উছিষ্ট পলিথিনের ছাই ফটোসষ্ট্যাট মেশিনের কালি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। তার এই উদ্ভাবনী শক্তিকে সরকারিও বেসরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতা করলে এই প্রতিভা বিকশিত করা সম্ভব বলে তার ধারনা।
কথা হয় ওই এলাকার হাবিল উদ্দিন ও রুবেলের সাথে তাারা বলেন,আমরা পারভেজের জালানি দিয়ে মটর সাইকেল চালিয়ে দেখেছি।এতে মটর সাইকেলের কোন সমস্যা হয়নি।তারা বলেন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে পারভেজের এই আবিস্কৃত জালানী দিয়ে আমরা নিজ দেশের কাজে লাগানো যাবে।তবে এর জন্য প্রয়োজন পৃষ্টপোষকতা।
পাথরডুবী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সবুর বলেন, আগে জানতাম পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এ পলিথিন থেকে যে জ্বালানি তেল তৈরি করা হয় তা জানতে পেরে খুব ভালো লাগছে। পলিথিনের এ ধরনের পুনর্ব্যবহারই পারে পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত পারভেজের পাশে দাঁড়ানো।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ড. মোঃ সাইফুর রহমান সরকার বলেন,পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হতে জ্বালানী পদার্থ যথা ডিজেল, পেট্রল বা অক্টেন উৎপাদনে পারভেজের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এ ধরণের উৎপাদন বানিজ্যিকভাবে করা গেলে তা যেমন পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়ক হবে তেমনি জ্বালানীর চাহিদা পূরণেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে। প্রকৃতপক্ষে, সারা বিশ্বের বৈজ্ঞানিকগণ পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য হতে জ্বালানী উৎপাদন বিষয়ে গবেষণা ও পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তারা অনেকাংশে সফল হয়েছেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য হতে বিভিন্ন জ্বালানী উৎপাদনের প্লান্ট রয়েছে।
প্লাস্টিক বা পলিথিন হলো মূলত দীর্ঘ কার্বন শিকলযুক্ত বৃহৎ অণু। জ্বালানী হলো কার্বনযুক্ত তুলনামূলক ছটো আকারের অণু। দীর্ঘ কার্বন শিকল প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্যে ভেঙ্গে জ্বালানী পাওয়া যায়। তাপ প্রয়োগে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায় এবং যথাযথ প্রভাবক ব্যবহারে প্রক্রিয়াটি সহজতর হয়। এটি মূলত পলিমার পদার্থের তাপীয় ভাঙ্গন (ডিপলিমারাইজেশন) প্রক্রিয়া। তবে এখানে মূল চালেঞ্জ হলো উৎপাদন খরচ কমানো যা যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, পারভেজ মোশাররফের পলিথিন পুড়ে পেট্রোল তৈরির বিষয়টি শুনেছি । এটি একটি ভাল উদ্যোগ। তবে এর কার্যকারিতা কতটুকু ও পরিবেশবান্ধব কি-না তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ণয় করা হবে। পরিবেশ বান্ধব হলে তা আরো উন্নতভাবে তৈরি করতে তাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
##
আমিনুর রহমান বাবু
০১৭১৬২৫৬৫৩২
২২.০৮.২০২২
