মনোরমা বসু মাসিমাঃ শোষণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত

আপডেট: মার্চ ৮, ২০২১
0

রাহাদ সুমন,বিশেষ প্রতিনিধি॥ বরিশালের পূর্বনাম চন্দ্র দ্বীপ। এটি ছিল তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের একটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে বরিশালের অবদান নানাদিক দিয়ে শ্রেষ্টতম। বরিশালের বানরীপাড়া ছিল সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের তীর্থস্থান। মূলত বরিশালের বানরীপাড়ায়ই বিপ্লবীদের প্রধান ঘাটি ছিলো। এর পরের অবস্থান পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে বরিশালের বানরীপাড়া ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে। নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী কমিউনিষ্টরা। তাঁদের মধ্যে মনোরমা বসু মাসিমা অন্যতম। বানরীপাড়া ও স্বরূপকাঠীর বুক চিড়ে বয়ে গেছে সন্ধ্যা নদী। নদীর দুই কোল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য গ্রাম। নরোত্তমপুর তার মধ্য একটি। বানরীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের নরোত্তমপুর গ্রামে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের বহু নেতা-কর্মী ও সংগঠকের জন্ম। এ গ্রাম বানরীপাড়া উপজেলার দেশপ্রেমিকদের তীর্থস্থান। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার প্রত্যন্ত গাঁয়ের যে কিশোরী অংশগ্রহণ করেছিলেন সারা জীবনে আর সে পেছন ফিরে তাকায়নি। অশ্বিনীকুমারের শিষ্যা সেই কিশোরী কালক্রমে হয়ে ওঠেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেত্রী। বিট্রিশ শাসকের রাজরোষে পড়ে জেল খেটেছেন। ভারতের স্বাধীনতার পরে সেই নারী আবার জড়িয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে।

উপ-মহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নারীমুক্তি আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম পথিকৃত মনোরমা বসু মাসিমার জন্ম ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর। বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার নরোত্তমপুর গ্রামে। মা প্রমোদ সুন্দরী। বাবা নীলকন্ঠ রায়। তারঁ জন্মের ১১ বছর পর বাবা নীলকন্ঠ রায় মারা যান। মনোরমার একটি ছোট ভাই ছিল। বিধবা মা দুই সন্তানকে তাই বেশী লেখাপড়া করাতে সক্ষম হননি। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী স্কুল। এরপর তাঁর আর স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে বরিশালের গৌরনদীর বাঁকাই গ্রামের জমিদারপুত্র চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় । চিন্তাহরণ বসু ছিলেন উদারমনা ও প্রগতিবাদী। স্বামীর সহযোগিতায় ও সমর্থনে মনোরমা বসু স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। সংসারধর্ম পালনের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজেও যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯০৫ -১১ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। মিছিলের মধ্যে তিনি মানুষের হাতে হলদে সূতার রাখী বেধে দেশমাতৃকার জন্য বিপ্লবী কাজে উৎসাহ যোগাতেন। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের ফাঁসি তাকে প্রচণ্ডভাবে দুঃখ দেয় এবং আলোড়িত করে। মনে মনে শপথ নেন, এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তিনি ভবিষতে রাজনীতি করবেন।

Monoroma Basu did not get any institutional education, she was very liberal in her thoughts and activities. Considering the conservative zamindar family as detrimental for proper upbringing of her children and for her active involvement in political activities, she left the village and started living in Barisal town.

১৯২১-২২ সালের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলের কর্মকাণ্ডে মাসিমা আকৃষ্ঠ হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। ১৯২৪ সালে মহাত্মা গান্ধী বরিশালে আসেন। এ সময় মনোরমা বসু মহাত্মা গান্ধী’কে দেখার জন্য বরিশালে আসেন। মহাত্মা গান্ধী’র প্রাণবন্ত বক্তব্য শুনেন। আরো শুনেন মুকুন্দদাসের ‘মাতৃপুঁজা’ যাত্রাপালার সেই মরণজয়ীথ ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’ জাগরণী সঙ্গীত। এরপর থেকে মাসিমা মুকুন্দদাসের কাশিপুরের কালী মন্দিরে যাওয়া আসা শুরু করেন। সেখানে পেয়ে যান শতদলবাসিনীকে। শতদলবাসিনী মুকুন্দদাসের সহধর্মিনী ছিলেন। তিনি মাসিমা’কে আদর-স্নেহ দিয়ে গড়ে তুলতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে পড়লেন নারী সমাজকে সচেতন করে গড়ে তোলার কাজে। তখন থেকে মাসিমা কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে থাকেন। এ সময় মাসিমা বরিশাল শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

১৯৩০ সাল। তখন সারা ভারত জুড়ে চলছিল আইন অমান্য আন্দোলন। বঙ্গ প্রদেশেও এর উত্তাল ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। এই আন্দোলনে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ মনোরমা বসুকে গ্রেফতার করে। জীবনের প্রথমবারের মতো কারাবন্দী হন তিনি। এসময় তার ৬ মাস জেল ও ১৫০ টাকা জরিমানা ধার্য করে ব্রিটিশ বিচারক। প্রায় ছয় মাস পর মুক্তি পান। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আরও সক্রিয়ভাবে শুরু করেন রাজনীতি। গড়ে তুলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। সেই সঙ্গে পূর্ণোদ্যমে শুরু করেন মহিলাদের সংগঠিত করার কাজ। এই জন্য তিনি গড়ে তোলেন মহিলা সমিতি। এই সমিতি পরিচালনাকালে তিনি বিপ্লবী গুরুপের সাথে পরিচিত হন। ১৯৩৩-৩৪ সালে তিনি পাশাপাশি নিজ বাড়ির বারান্দায় চালু করেন মেয়েদের বিদ্যালয়। নিজের মেয়েসহ আরো ৫ জন মেয়েকে নিয়ে শুরু করেন স্কুলের কার্যক্রম। নিজের ব্যবহৃত ৫ ভরি সোনা ও মুষ্ঠি চাল বিক্রি করে এই স্কুলটি নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই বিদ্যালয়ই বিখ্যাত ‘মাতৃমন্দির’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
চল্লিশ দশকের আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে মনোরমা বসু ভীষণভাবেই কর্মব্যস্ত থাকেন। কখনো ব্রিটিশ বিরোধী জনমত গঠনে, কংগ্রেসের কাজে, মহিলাদের সংগঠিত করার কাজে, মেয়েদের শিক্ষাদানে ও মানুষের অধিকার স্বাধীনতার আন্দোলনে যুক্ত থাকেন। তাঁর প্রাণপণ চেষ্ঠায় বরিশালে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও তিনি এ দশকে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের কাজেও যুক্ত ছিলেন।
১৯৪৩-৪৪ সাল। ব্রিটিশ শাসকদের অবহেলার কারণে সারা বাঙলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম-বাংলার আনাহারী মানুষ খাবারের জন্য ছুটছে কলকাতার দিকে। ওলিতে-গলিতে, রাজপথে-ফুটপথে অগনিত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায়-যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খুঁজে ফিরছে ডাস্টবিনে- নর্দমায়। এ সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজেও তিনি নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে দাঁড়ান আর্তমানুষের পাশে। সমগ্র বরিশাল জুড়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজে শত শত মহিলাদের নিয়ে মানুষের পাশে দাড়ান।

সারা বাঙলায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে তোলেন বরিশালের দুই কৃতি নেত্রী মণিকুন্তলা সেন ও যুঁইফুল বসু। তাঁদের সহযোগিতা মাসিমা বরিশালের গ্রামাঞ্চলেও এই সমিতির কাজ ও সংগঠন বিস্তৃত করেন। মূলত বরিশালে মাসিমার নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে ওঠে। তিনি বরিশাল জেলার সম্পাদক ছিলেন ও সংগঠক ছিলেন।
১৯৪৪ সালের মে মাসে বরিশালে নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের সকল কাজ তাঁর নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের সম্মেলনেও মাসিমা একজন সংগঠকের ভূমিকা রাখেন। এই সম্মেলনের পর তিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে মহিলাদের নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। শুধু বরিশালে নয়, বরিশালের বানারীপাড়া, পার্শ্ববর্তী পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি, নাজিরপুর, কাউখালী, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, মাটিভাঙ্গার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৪৭ সাল। দেশভাগ হল। জন্ম নিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান। এ সময় পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। মাসিমাকে দেশ ত্যাগের জন্য অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশমাতৃকাকে ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না বলে মনস্থির করলেন। নিজ মা-মাটিতে অবস্থানের জন্য অনড় থাকেন মনোরমা বসু।

১৯৪৮ সালের ৫ জুন হঠাৎ চালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এর প্রতিবাদে বরিশালে আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। হাজার হাজার মানুষ এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশ সমবেত হয়। ব্রজমোহন কলেজের ছাত্ররা যোগ দেয় বিক্ষোভে। অচিরেই শুরু হয় লাঠিচার্জ। গ্রেপ্তার করা হয় মনোরমা বসু মাসিমাকে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণের ফলে ভেঙে দেওয়া হয় মাতৃমন্দির। চার বছর কারাভোগ শেষে ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল মুক্তি পান।
১৯৫০ সালে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধালো। দাঙ্গা বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুললো কমিউনিষ্ট পার্টি। এ সময় বরিশালের প্রায় সকল কমিউনিষ্ট নেতাকে সরকার গ্রেফতার করে। মুকুল সেন ও জগদীশ আইচকে গ্রেফতার করতে সরকার ব্যর্থ হয়।

মুক্তিলাভের পর মনোরমা বসু মাসিমা ৫২’র মে মাসে ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ভেঙে ফেলা মাতৃমন্দিরকে পুনরায় গড়ে তোলেন। এ সময় বিপ্লবী সত্যেন সেন গানের মাধ্যমে বরিশালে মনোরমা বসু মাসিমার ‘মাতৃমন্দির’র জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। কমিউনিষ্ট পার্টি তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করে।

সাথে সাথে শুরু করেন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নানা কার্যক্রম। যুক্ত হন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কাজে। ১৯৫৪ সালে তাঁর স্বামী চিন্তাহরণ বসু মারা যান। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর পরই মনোরমা বসু মাসিমাকে ঘিরে আবার শুরু হয় পুলিশি হয়রানি ও ষড়যন্ত্র। কৌশলে গ্রেপ্তার এড়ান তিনি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন তিনি আত্মগোপনে থাকেন। ইতোমধ্যে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসে সদস্য পদ পান। আত্মগোপনে থাকাকালীন সময়ে বরিশালের বিভিন্ন জায়গায় পার্টির কাজে নিজেকে নিয়েজিত করেন। পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর ওপর থেকে গ্রেফতারী পরোয়ানা উঠে যায়। এরপর তিনি নিজ বাড়িতে মাতৃমন্দির আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লী কল্যাণ অমৃত পাঠাগার ও মুকুল মিলন খেলাঘর গড়ে তুলেন।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১৯৫৯ সালে আগস্ট মাসের মধ্যে একটি শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত এই রিপোর্টে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থ বরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। এতে আইয়ুব শাহীর ধর্মান্ধ, ধনবাদী, রক্ষণশীল, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাসংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল। ছাত্র ইউনিয়ন আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে একুশ উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। প্রকৃতপক্ষে ছাত্র ইউনিয়নই ছিল আন্দোলনের মূল পরিচালক। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। এ সময় বরিশালে মাসিমা শত শত ছাত্রীদেরকে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে দেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নকে এবং শিক্ষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার ব্যাপারে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯৬২-৬৮ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার আইয়ুব খান বিরোধী সকল আন্দোলনে তিনি ছাত্র-যুব ও পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এ সকল আন্দোলনে তিনিই একমাত্র মহিলাদেরকে সংগঠিত করণে আবদান রাখেন।

১৯৬৪ সালের দাঙ্গাবিরোধী কর্মকাণ্ডে মাসিমা জোরদার দায়িত্ব গ্রহণ করে তা যথাযথভাবে পালন করেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তার ভূমিকা চিরস্মরণীয়। তিনি সমগ্র বরিশাল জুড়ে এ সময় আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে ত্রাণকার্য বিতরণ ও আর্তমানুষের সেবায় নিজেকে নিয়েজিত করেন। ৭০’র নির্বাচনে তিনি পার্টির প্রার্থীর পক্ষ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। এ সময় তিনি পিরোজপুরের নিরোদ নাগের সাথেও পার্টির কাজ করেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোতে মহিলাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মনোরমা বসু। স্বাধীনতার পর বরিশালেই তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মনোরমা বসু মাসিমার দেশপ্রেম, সমাজসেবা, মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তিনি ’মাসিমা’ হিসেবে পরিচিত হন। মূলত শত শত মেয়েরা যাদেরকে মাসিমা আদর-স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, তারাই তাঁকে মায়ের মত আপন ভেবে ‘মাসিমা’ বলে ডাকতো।

স্বাধীনতার পর মাসিমা পাকবাহিনীদের ভেঙ্গে দেয়া মন্দির ও স্কুল পুনরায় পুনর্গঠন করেন। ৭২ সালে তিনি বরিশালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের শাখা তৈরী করেন। মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে তিনি বরিশালে সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। ৭৩’র নির্বাচনে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন। ৭৪’র দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় আসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। ওই বছর ৮ মে তিনি মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে রাশিয়া সফর করেন। ৭৫’র বাকশালে যোগদানের বিরোধীতা করেন।

১৫ আগষ্টের পর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ও অস্থিরতার জন্য পার্টির সিদ্বান্তে আত্মগোপনে যান। আত্মগোপনে থেকে তিনি খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, মহিলা সমিতি ও উদীচীসহ আরো অনেক গণসংগঠনের কাজে যুক্ত থেকে ওই সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সরাসরি যুক্ত থাকতে না পারলেও নেতা-কর্মীদের উৎসাহ যোগাতেন প্রতিনিয়ত। ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর চির বিপ্লবী এ মহিয়সী নারী সবাইকে কাঁদিয়ে চির অচেনার দেশে পাড়ি জমান।

###
রাহাদ সুমন,বানারীপাড়া
তারিখঃ ০৮-০৩-২০২১ ইং