মহিলা পরিষদের ৫২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পেশাজীবি তরুণীদের সাথে অনলাইনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

আপডেট: এপ্রিল ৯, ২০২২
0

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ধারাবাহিকতায় আজ ৯ এপ্রিল ২০২২ শনিবার সকাল ১১.০০ টায় ‘বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করি, সমতার চেতনা প্রতিষ্ঠা করি’- এই প্রতিপাদ্যটির আলোকে পেশাজীবি তরুণীদের সাথে অনলাইনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনলাইন আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সভায় প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন সাংগঠনিক সম্পদক উম্মে সালমা বেগম এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।

‘বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করি, সমতার চেতনা প্রতিষ্ঠা করি’- প্রতিপাদ্যটির উপর মূল আলোচনা করেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও আবৃতি শিল্পী শারমিন লাকি। তরুন প্রজন্মের বিভিন্ন পেশাজীবী নারীদের মধ্যে আরো আলোচনা করেন থিংক স্পেস ইন্টারিওর স্টুডিও এর ইন্টারিওর আর্কিটেক্ট এন্ড কো ফাউন্ডার লাভা বিশ^াস নন্দিনী; দয়ীতার সত্ত্বাধিকারী সাইদা সুলতানা মিলি; ট্রান্সজেন্ডার অধিকার কর্মী ও নৃত্যশিল্পী সঞ্জীবনী, এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার, (উইমেন রাইটস এন্ড জেন্ডার ইকুয়ালিটি) ফৌজিয়া আফরোজ; ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের এডিশনাল ডেপুটি পুলিশ কমিশনার লায়লা ফেরদৌসী; কোডিজাইন সফটওয়ার ডেভেলপমেন্টের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হৈমন্তী খান, দলিত নারী ফোরামের প্রোগ্রাম অফিসার তামান্না সিং বারাইক

নির্ধারিত বিষয়ে মূল আলোচনা উপস্থাপনকালে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও আবৃতি শিল্পী শারমিন লাকি বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে বাংলাদেশের মহিলা পরিষদ সবসময় সাহসিকতার সাথে কাজ করছে। এতবছর সফলভাবে ও সার্থকভাবে সংগঠন যে পথ পাড়ি দিয়েছে তারজন্য প্রশংসার দাবিদার। তিনি এসময় বলেন যতদিন না নারীরা মর্যাদা পাবে, নারীদের আমরা মানুষ হিসেবে ভাবতে না শিখব ততদিন বৈষম্যকে দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য নারীকেও সচেতন ভাবে এগোতে হবে, পরিবার থেকেই এই বৈষম্যদূরের কাজ শুরু করতে হবে।

উপস্থিত আলোচকবৃন্দ বলেন, গোটাকয়েক নারীর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও আশেপাশের ঘটনা থেকে বোঝা যায় বেশির ভাগ নারী এখনো অনেক বৈষম্যের শিকার। একটি বৈষম্যের সাথে অন্য একটি বৈষম্যের জোরালো সম্পর্ক থাকে। গতানুগতিক পেশার বাইরে কাজ করতে যেয়ে দেখা যায় একটা মেয়ে চিরাচরিত নানা বাধার সম্মুখীন হয়। নারী আসলেই কাজ পারবে কিনা এমন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের মধ্যে দেখা যায়। প্রযুক্তিগত কাজের ক্ষেত্রে এখনো পুরুষের আধিপত্যই আছে। নারীর উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বে থাক্ াঅনেক পুরুষই মেনে নিতে পারেনা। মতামত নেয়াকে গুরুত্ব দেয়া হয়না। দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনেক রকমের বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয় যাকে বৈষম্যকারীরা সহজাত বলে মনে করে। তারা আরো বলেন, সমতা ও সাম্য এর ধারণা স্পষ্ট করতে হবে। পরিবারে সমাজে, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডারদের জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। অন্যদিকে দলিত জনগোষ্ঠী প্রায় ২০০ বছর ধরে বৈষম্যের শিকার , যা ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এখনও আন্দোলন করতে হয়। তারা পরিবারে ও রা®েট্র থাকা বৈষম্যের কথা তুলে ধরে বলেন নারীর ক্ষমতায়ন, সম্মান, সমানাধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে ৫০ বছর আগে যে বৈষম্যমূলক মনোভাব ছিলো তার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। অবস্থার উত্তরণের জন্য এসময় তারা বলেন সকল শ্রেণীর নারী পুরুষ সহ প্রত্যেকের জন্য সমান সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে, নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য এবং প্রকৃত ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের অবশ্যই আতœনির্ভরশীল হতে হবে। দলিতদের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করতে হবে, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে। পাশাপাশি নারী আন্দোলনের সাথে তরুণদের যুক্ত হতে হবে, অন্যায় ও অসমতার প্রশ্নে প্রতিবাদ করতে হবে, বৈষম্যকারীদের ভুল ধরিয়ে দিতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে।

সভার শুরুতে সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম বলেন, জন্মসূত্রে সকল মানুষ স্বাধীন এবং সমমর্যাদা লাভের অধিকারি- সার্বজনীন মানবাধিকারের এই দর্শনকে ধারণ করে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে সংগ্রামী তরুণীদের উদ্যোগে গঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নারীমুক্তি, নারী সমাজকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন, এবং নারী শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের জন্য আন্দোলন করেছে। সাংগঠনিক কাজে সবসময় তরুণদের অর্ন্তভ’ক্ত করার উপর গুরুত্ব দেয় সংগঠন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে যেমন জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে তরুণী ছাত্রী নেত্রীরা যেমন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আজকের তরুণীরাও তেমনি দৃঢ় সাহস আর মনোবল নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা সহ নারী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও গৃহীত কর্মসূচিসমূহ তুলে ধরে বলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী গণনারী সংগঠন হিসেবে নারীমুক্তি, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বহুমুখি পদ্ধতিতে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে সংগঠন। প্রতিষ্ঠার ৫২ বছরে এসে দেশের উন্নয়নের সকল স্তরে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও নারীর অংশগ্রহণের সাথে তার অধিকার ও মর্যাদা এর দিকটি প্রশ্নবিদ্ধ। নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিপোষণ এখনো একটি মৌলিক সমস্যা হিসেবেই আছে। নারীর অংশগ্রহণের সাথে অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে প্রকৃত উন্নয়ন হবে না। এসময় তিনি বৈষম্যকে দূর করতে প্রত্যেককে নিজ নিজ ক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করার পাশাপাশি মূলধারার আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, কাজের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে বৈষম্যের বিষয়ে একেক গোষ্ঠীর নারীদের একেক রকম চিন্তাধারা এখনো আছে, এর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র শ^াশত ধ্রুব সত্য নয়, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। নারীর অগ্রগতি নানা ধরণের হচ্ছে এক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্মসূচি গ্রহণ করে। নারীদের মধ্যে নতুন আত্মজাগরণের সৃষ্টি জাতীয় ও বৈশি^ক নারী আন্দোলনের একটা অর্জন। আজ নারী তার দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সকল ক্ষেত্রে গড়ে তুলতে সক্ষম নিজ নিজ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আরো বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজকে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বৈষম্য দূর করে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা দিতে হবে এবং তরুণদের সকল সংগ্রামে যুক্ত হয়ে নিজ নিজ পরিকল্পনার সমন্বয় করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।

আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি একক স্গংীত পরিবেশন করেন সঙ্গীত শিল্পী সৃষ্টি সেজুঁতি হালদার। সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করেন আফিয়া আখতার, লাবিবা ইবনাত সুপ্রভা ও সারাফ ওয়ামিয়া সুপ্রীতি। কবিতা আবৃত্তি করেন আবৃত্তি শিল্পী শুক্লা দাস গুপ্ত ও অন্বেষণা বণিক শ্রুতি এবং পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, সম্পত্তিতে সমঅধিকার, যৌন হয়রানি প্রতিরোধের উপর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের টিভিসি প্রদর্শন করা হয়।

উক্ত অনলাইন আলোচনা সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, জাতীয় পরিষদ সদস্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ও সংগঠনের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান