মে মাসে সড়কে প্রাণ গেছে ৫৬২ জনের

আপডেট: জুন ৩, ২০২১
0

নিজস্ব প্রতিবেদক:
গত মে মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৪১টি। নিহত ৫৬২ জন এবং আহত ৫৪৯ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৮৩, শিশু ৬৬। ২২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২১৭ জন, যা মোট নিহতের ৩৮.৬১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৫১.৭০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৬.১৫ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৮৬ জন, অর্থাৎ ১৫.৩০ শতাংশ।

এই সময়ে ৮টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত এবং ১৬ জন আহত হয়েছে। ৫টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত এবং ১ জন আহত হয়েছে। এছাড়া ঈদে ঘরমুখো যাত্রায় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাটে ফেরি থেকে হুড়োহুড়ি করে নামার দুটি ঘটনায় ৬ জন নিহত এবং ৩১ জন আহত হয়েছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:

দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২১৭ জন (৩৮.৬১%), বাস যাত্রী ৯ জন (১.৬০%), ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি যাত্রী ৩৭ জন (৬.৫৮%), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স যাত্রী ৩২ জন (৫.৬৯%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-ইজিবাইক-অটোরিকশা-টেম্পু) ৭৮ জন (১৩.৮৭%), নসিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-চান্দের গাড়ি যাত্রী ৩৪ জন (৬.০৪%) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৮ জন (১.৪২%) নিহত হয়েছে।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৭৯টি (৪০.৫৮%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৫৮টি (৩৫.৮২%) আঞ্চলিক সড়কে, ৬৩টি (১৪.২৮%) গ্রামীণ সড়কে, ৩৫টি (৭.৯৩%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি (১.৩৬%) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন:

দুর্ঘটনাসমূহের ৭১টি (১৬.০৯%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬৯টি (৩৮.৩২%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৪৮টি (৩৩.৫৬%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৪৪টি (৯.৫৭%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৯টি (২.০৪%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৬.০৭ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-রেকার ৩.২৫ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৭.৯৫ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ৫.০৮ শতাংশ, মোটরসাইকেল ৩০.৬৩ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু) ১৮.৩৮ শতাংশ, নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-চান্দের গাড়ি ৬.৫১ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ২.০৮ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৭৬৭টি। (ট্রাক ১৩৮, বাস ৩৯, কাভার্ডভ্যান ২০, পিকআপ ৪২, ট্রলি ৯, ট্রাক্টর ১৫, মাইক্রোবাস ৩৩, প্রাইভেটকার ২২, এ্যাম্বুলেন্স ৪, জীপ ১, র‌্যাবের পিকআপ ১, রেকার-১, মোটরসাইকেল ২৩৫, থ্রি-হুইলার ১৪১(ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৫০ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-চান্দের গাড়ি) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ১৬টি।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫.৪৪%, সকালে ৩১.৫১%, দুপুরে ১৮.৫৯%, বিকালে ২১.০৮%, সন্ধ্যায় ৭.৯৩% এবং রাতে ১৫.৪১%।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৬.০৭%, প্রাণহানি ২৫.৬২%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬.৫৫%, প্রাণহানি ১৬.১৯%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৬.০৯%, প্রাণহানি ১৭.৪৩%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৯৩%, প্রাণহানি ৭.৮২%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.০৭%, প্রাণহানি ৯.৬০%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.৬১%, প্রাণহানি ৯.৯৬%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.৭৫%, প্রাণহানি ৮.৫৪% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৮৯%, প্রাণহানি ৪.৮০% ঘটেছে।

ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১১৫টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৪৪ জন। সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে। ২৬টি দুর্ঘটনায় নিহত ২৭ জন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ৩২টি দুর্ঘটনায় ৪১ জন নিহত। সবচেয়ে কম পঞ্চগড় জেলায়। ৩টি দুর্ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি।

আহত ও নিহতদের পেশাগত পরিচয়:

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৩ জন, র‌্যাবের কর্মকর্তা ১ জন, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ১জন, আনসার ভিডিপি কমান্ডার ১ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ২ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১১ জন, বিএডিসি’র নির্বাহী প্রকৌশলী ১ জন, পোস্ট মাস্টার ১ জন, আইনজীবী ৩ জন, চিকিৎসক ২ জন, ইংল্যান্ড প্রবাসী ১ জন, স্থানীয় সাংবাদিক ৪ জন, ব্যাংক কর্মকর্তা ৫ জন, গার্মেন্টস কর্মকর্তা ১ জন, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন ৬ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ৮ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৭ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩২ জন, প্রবাসী শ্রমিক ১ জন, পোশাক শ্রমিক ১৪ জন, কৃষি শ্রমিক ৪ জন, টিউবওয়েল মিস্ত্রি ১ জন, মটর মেকানিক ১ জন, পরিবহন শ্রমিক ২ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৬ জন, ইটভাটার শ্রমিক ২ জন, ডিসিসি’র পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধি ৩ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১১ জন এবং চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন, ঢাকা কলেজের ১ জনসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৮৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাংসদ এবং কালীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান- এরা দুইজন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:

১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন;

২. বেপরোয়া গতি;

৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা;

৪. বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা;

৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল;

৬. তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো;

৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;

৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;

৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি;

১০ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

সুপারিশসমূহ:

১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;

২. চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;

৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;

৪. পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;

৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে;

৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;

৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে;

৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে;

৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে;

১০.“সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

মন্তব্য:

গত এপ্রিল মাসে ৩৯৭টি দুর্ঘটনায় ৪৫২ জন নিহত হয়েছিল। গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছিল ১৫.০৬ জন। মে মাসে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছে ১৮.১২ জন। এই হিসাবে প্রাণহানি বেড়েছে ২০.৩১ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ৩৩.০৭ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৪৫১ জন, অর্থাৎ ৮০.২৪ শতাংশ।

ট্রাক, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ট্রাক এবং মোটরসাইকেল সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম হুমকি হয়ে উঠেছে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের মাত্রাও চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে মে মাসের অধিকাংশ সময় ট্রেন, লঞ্চ ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ ছিল। এই পরিস্থিতির মধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষ ঈদ উদযাপনের জন্য ট্রাক, পিকআপ, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, নসিমন ইত্যাদি যানবাহনে গন্তব্যে গিয়েছে এবং ঈদ পরবর্তীতে একইভাবে কর্মস্থলে ফিরেছে। ফলে পুরো মাসজুড়ে সারা দেশের সড়ক ও নৌ-পথে অস্থির অবস্থা বিরাজমান ছিল। এসব কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। অবশ্য বেশ কিছুদিন যাবৎ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার উর্ধমুখী। কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।