মোদীর বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট:বাংলাদেশের উপর কি প্রভাব!

আপডেট: জুন ৫, ২০২৪
0

ভারতের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ধারণা করা হচ্ছে জোটসঙ্গীদের নিয়ে আবারো সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এর ফলে গত দুটি সরকারের প্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদি যেভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেছেন সেটিতে কোনো পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা আছে কি-না কিংবা বাংলাদেশের ওপর ভারতের এবারের নির্বাচনে প্রভাব কেমন পড়বে তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে ভারত সরকারের সমর্থন পাচ্ছিল তা একইভাবে থাকবে কি-না তাও কারো কারো আলোচনায় আসছে।

আবার ভারতে মুসলমানসহ অন্য সংখ্যালঘুদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার দেখিয়ে এসেছে দেশটির নতুন সরকার সেই একই দৃষ্টিভঙ্গীই পোষণ করবে কি-না সেদিকেও চোখ থাকবে অনেকের।

যদিও রাজনীতিক, সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকদের ধারণা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা এখনই তারা দেখতে পান না।

উল্লেখ্য, ভারতের নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যে ফল পাওয়া গেছে তাতে বিজেপি এককভাবে ২৪০টি এবং কংগ্রেস ৯৯টি আসন পেয়েছে। তবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ২৯৩টি আসন।

ভারতের সরকার গঠনের জন্য ২৭২টি আসন দরকার হয়। বিজেপি এককভাবে এই পরিমাণ আসন না পাওয়া এখন তাদের জোট বা কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে।

ফলে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশীদের সাথে নতুন সরকারের সম্পর্ক এবং মুসলিমদের বিষয়ে বিজেপি সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি-না তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।

বাংলাদেশের ওপর প্রভাব
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অনেক উন্নতি হয়েছে।

তিনি বলেন, সামনের দিনে আমরা সম্পর্ক আরো উন্নত করবো। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যেসব বিতর্ক আছে সেগুলো সামনের দিনে কেটে যাবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি মাসেই ভারত সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। দলের নেতাদের ধারণা দেশটিতে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর এ সফরে উভয় পক্ষের সম্পর্ক আরো উন্নত হবে।

এখানে বলে রাখা ভালো ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত সরকারের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে।

বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা আরো জোরদার হয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন।

বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ভারত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশে ছিল।

এর মধ্যে চলতি বছরের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত ভারতের অবস্থানের কারণেই বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তারা আশা করেন ভারতের নতুন সরকার একটি বিশেষ দলের প্রতি সমর্থনের দৃষ্টিভঙ্গি তার পরিবর্তে বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবেন।

তিনি বলেন, ভারত গণতান্ত্রিক ধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে। অন্য দেশেও এ ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা ও জনমতের ইচ্ছার প্রতি তারা শ্রদ্ধা দেখাবে সেটাই আমরা আশা করি। কোন একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুকম্পা নয় বরং দেশের জনগণের ইচ্ছাকে তারা সম্মান করে দু’দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেবে এটাই সবাই চায়।

যদিও বিএনপির আরো দু’জন নেতা বলেছেন, ভারতে সরকার পরিবর্তন হলেও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের পরিবর্তন হয় না। সেখানে শুধু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াটা বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর বিষয়ে ভারত সরকারের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনার সূচনা করবে এমনটি তারাও মনে করেন না।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন,‘অপেক্ষা করতে হবে। দেখতে হবে ভারতের নতুন সরকারে কারা কীভাবে থাকছেন। বাংলাদেশের ওপর নতুন সরকারের প্রভাব বা নির্বাচনের ফলের প্রভাব বুঝতে আরও সময় লাগবে।’

কিন্তু নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে?
বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের এখনকার যে পররাষ্ট্রনীতি সেটিতে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন না বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এবং সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো: তৌহিদ হোসেন।

মোমেন বলেন, সরকার গঠন বা অন্য ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যাই হোক না কেন ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কটি এগিয়ে যাবে কারণ এই সম্পর্ক বহুমাত্রিক। নিজেদের প্রয়োজনেই উভয় দেশ ও সরকারের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে। কারণ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার সবসময় সচেতন থাকবেন।

মোমেন এখন জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

অন্যদিকে তৌহিদ হোসেন বলেন, নির্বাচনের ফল যেমনই হোক না কেন এখনো নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপিই ক্ষমতায় থাকবে এবং তারা যাদের সাথে জোট করতে যাচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি ইস্যুতে তাদের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না।

তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য কোয়ালিশন পার্টনাররা নিজেদের রাজ্য কেন্দ্রিক চিন্তা করার জন্য বেশি পরিচিত। ফলে পররাষ্ট্রনীতি বা বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে যে সম্পর্ক সেই নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

তিনি মনে করেন, ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট-সরকার গঠন করলেও তাতেও প্রতিবেশী নীতির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হতো না।

‘তারা সবাই ভারতের স্বার্থই দেখে। আরেকটা বিষয় মনে রাখা দরকার তা হলো গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের জন্য যেটুকু পজিটিভ হয়েছে তার কোনটিই কংগ্রেস সরকারের সময় হয়নি। আর এখন বাংলাদেশ-ভারত যে অবস্থা এর চেয়ে ভালো কিছু তো ভারতের জন্য হতে পারে না। তাহলে অহেতুক কেন চাপ তারা তৈরি করবে।’

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক সাহাব এনাম খান বলছেন ভারতের এবারের নির্বাচন থেকে একটি বার্তা বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদি পেয়েছেন তা হলো ধর্মীয় ও সামাজিক সংখ্যালঘুদের জন্য তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

তিনি বলেন, আবার কোয়ালিশন সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার এতদিনকার কোনো কোনো নীতির বিষয়ে আপষ করতে হতে পারে। বাংলাদেশের মতো ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠান ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবে গড়ে তুলতে হবে। সেটাই বিজেপির ভবিষ্যতের জন্য ভালো। আবার বাংলাদেশের ওপরও তার একটি প্রভাব পড়বে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারতে ধর্মীয় ও সামাজিক সংখ্যালঘুদের নিয়ে বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এলে তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। এতে করে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা আরো কমিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হবে বলেও মনে করেন তারা।

সূত্র : বিবিসি