যে দুই শর্তে মু’মিনের সকল কাজই ইবাদত হিসেবে গন্য হয়

আপডেট: জুন ২৫, ২০২১
0

সকলেই এক আল্লাহর বান্দা। তাই শুধু তাঁরই বন্দেগী বা দাসত্ব করতে হবে। অন্য কোন কাজ করা যাবে না। কারণ তা আল্লাহর বিধান বিরোধী। ইরশাদ হচ্ছে- “আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত- ৫৬)।

তবে কি আমাদের ঘর-সংসার, সমাজ-রাষ্ট্র ও বিশ্ব জাহান অচল হয়ে যাবে? সেখানে আমাদের কোন ভূমিকা থাকবে না। হ্যাঁ, অবশ্যই থাকবে। আমরা সর্বত্র থাকব। রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে শুরু করে অর্থ, রাষ্ট্র, সমর, কৃষিসহ যে কোন ধরনের ছোট বড় জায়েয কাজে আমরা অংশ নেব। অর্থাৎ আমরা সবই করব, কিন্তু ইবাদত বানিয়ে করব। ইবাদত বহির্ভূত কোন কাজই করব না। আল্লাহ তাআলার কাছে আমরা প্রতিনিয়ত নামাযে এই ওয়াদাই করে থাকি- “একমাত্র তোমারই ইবাদত করি” বলে। (সূরা ফাতিহা)।

মু’মিনের প্রতিটি কাজই ইবাদত বা সাওয়াবের হয়ে থাকে, যদি তাতে দু’টি শর্ত পাওয়া যায়। এক সাথে শর্ত দু’টি থাকতে হবে। এর কোন একটি অনুপস্থিত থাকলে আমল বাতিল বা গুনাহের হয়ে যাবে। যদিও তা নামায, রোযা বা অন্য কোন ইবাদত হোক না কেন। যেমন- কেউ যদি নিষিদ্ধ সময়ে নামায এবং নিষিদ্ধ দিনে রোযা রাখে, তাহলে তা অবশ্যই সাওয়াবের না হয়ে গুনাহের হবে। কেন হবে? কারণ এতে আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম লঙ্ঘিত হয়। তাহলে বোঝা গেল, কোন কাজ ইবাদত হওয়ার জন্য প্রধান শর্ত হল আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মোতাবেক হওয়া। আর দ্বিতীয় শর্ত হল, নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য সহীহ থাকা। আল্লাহর ওয়াস্তে না করে অন্য কোন দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে করলে তা যত ভাল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজই হোক না কেন, তা ইবাদত হবে না।

এ সম্পর্কে একটি সুপ্রসিদ্ধ হাদীস সকলেরই জানা থাকার কথা। তা হল, সকল কাজকর্মের ফলাফল নির্ভর করে নিয়্যাতের উপর। বুখারী শরীফের সর্বপ্রথম এই হাদীসটির পরের অংশে বলা হয়েছে- অতএব, যে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে হিজরত করে, তার হিজরত আল্লাহ-রাসূলের দিকেই পরিগণিত হয়। আর যার হিজরত দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে বা কোন নারীকে বিয়ে করার জন্য হয়, তার হিজরত সে দিকেই গণ্য হবে, যার দিকে সে হিজরত করেছে। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ দ্রষ্টব্য)।

কত গুরুত্বপূর্ণ কথা! জিহাদের বিধান আসার আগে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ছিল যে হিজরত, সেই হিজরতের মত আমলেও দুনিয়াবী উদ্দেশ্য থাকার কারণে সাওয়াব হয় না। এভাবে যে ইল্ম অর্জন করা ফরয এবং যে জন্য সামান্য সময় ব্যয় করা সারা রাত জেগে ইবাদত করার চেয়ে উত্তম, আর যে তালিবে ইল্মের জন্য ফেরেশ্তারা পাখা বিছিয়ে দেয়, গভীর পানির মাছ ও গর্তের পিঁপড়া পর্যন্ত দোয়া করে, সেই ইল্ম অর্জনেও দুনিয়াবী উদ্দেশ্য এসে গেলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায়। (মিশকাত শরীফ দ্রষ্টব্য)।

এ জন্য প্রতিটি কাজে ইখলাস বা সঠিক নিয়্যাত থাকা অপরিহার্য। কোন আমলে রিয়া বা লৌকিকতা থাকলে সাওয়াব পাওয়ার আশা করা যায় না। (সূরা কাহ্ফ- ১১০ দ্রষ্টব্য) বরং লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করলে র্শিক পর্যায়ের পাপ হয়ে যেতে পারে। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের জন্য আমি যে জিনিসের ভয় বেশী করি, তাহল ছোট র্শিক অর্থাৎ- রিয়া। (আহমদ দ্রষ্টব্য)।

আবার শুধু নিয়্যাত ঠিক থাকলে হবে না, কাজও ঠিক থাকতে হবে। দুই শর্তের কোন একটি না থাকলে নেক কাজ হয় না। যেমন, অনেকে বলে থাকে, ‘আরে মন হল আসল, নিয়্যাত ঠিক থাকলে সবই ঠিক, আল্লাহ মনই দেখবেন।’ না, কথাটি পুরোপুরি ঠিক না। আল্লাহ শুধু মন দেখবেন না। সাথে আমলও দেখবেন। যেমন- কেউ যদি খালেস নিয়্যাতে গরীব-দুঃখীদের দান করার জন্য চুরি করে এবং এ থেকে সে নিজে ভোগ নাও করে, তবুও তা পুণ্যের কাজ হবে না। কারণ, তার মন ঠিক আছে, কিন্তু কাজ ঠিক না। এ জন্য দু’টিই ঠিক থাকতে হবে। আল্লাহ দু’টোই দেখবেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও ধন-সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের মন ও কাজের দিকে। (মুসলিম শরীফ দ্রষ্টব্য)।

এ জন্য আমরা যা করব এ দু’শর্তের ভিতরে থেকেই করব। কেউ কুস্তি, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ, শুটিং, ব্যায়াম বা এ জাতীয় কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চাইলে নিতে পারবে, কিন্তু শর্তদ্বয় মেনে। যেমন- এসবে যদি সতর তরক না হয়, প্রয়োজনীয় দ্বীনি বা দুনিয়াবী কোন কাজে বিঘ্নসৃষ্টি না করে, উপরন্তু নিয়্যাত শুধু প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে মন ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য হয়, তবে তাতে কোন দোষ হবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকেও এমনি অনুমোদন পাওয়া যায়। তিনি সুস্থ হাসি-কৌতুকও করেছেন। সুতরাং তাঁর অনুমোদিত বিষয়ে অবশ্যই সাওয়াব হবে। আর যথাসাধ্য শক্তি ও সমরাস্ত্র প্রস্তুত এবং যুদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য তো মুসলিম মুজাহিদগণ ফরয ইবাদতের সাওয়াব পেয়ে থাকবেন। (সূরা আন্ফাল- ৬০ দ্রষ্টব্য)।

এভাবে আমাদের ঘুমানো পর্যন্ত ইবাদত হবে, যদি তাতে উক্ত শর্তদ্বয় থাকে। ঈশা ও ফজরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করলে সারা রাতের ঘুমও তো নফল ইবাদতের সমতুল্য হয়। কেউ রাতে উঠে ধর্মীয় পড়াশোনা বা নামায আদায় করার জন্য যদি আগে বা দিনে ঘুমায়, তবে তার ঘুমও সাওয়াবের হবে। আবার কেউ খারাপ নিয়্যাতে ঘুমালে তার ঘুম গুনাহের হবে। যেমন- গভীর রাতে জুয়া খেলতে যাবে নিয়্যাত করে মন ফ্রেশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়লে তার ঘুম গুনাহের হবে।

তাহলে বোঝা গেল, প্রতিটি মুবাহ্ বা জায়েয কাজকে আমরা সৎ নিয়্যাতের দ্বারা ইবাদত বানাতে পারি। কিন্তু নাজায়েয কাজে সৎ উদ্দেশ্য যোগ করলেও তা সাওয়াবের হবে না। মুবাহ্ কাজেই নিয়্যাতের তারতম্যের কারণে পাপ বা পুণ্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ- সাওয়াবের নিয়্যাত করলে সাওয়াব আর খারাপ নিয়্যাত করলে গুনাহ্ হয়। কিন্তু মু’মিনের কোন কাজ সাওয়াব মুক্ত হওয়া উচিত নয়। আর এমন কাজও নেই যাতে সাওয়াব বা গুনাহ্ হওয়ার ব্যবস্থা নেই। জায়েয কাজে নিয়্যাত সাওয়াবের থাকলে অবশ্যই সাওয়াব হবে। যেমন- মায়ের দিকে তাকানো জায়েয বা মুবাহ্।

তাই কেউ নেক নিয়্যাতে মমতার সাথে তাঁর দিকে তাকালে মকবুল হজ্বের সাওয়াব পাবে। কিন্তু খারাপ বা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালে হবে গুনাহ্। পক্ষান্তরে বেগানা মহিলার দিকে তাকানো নাজায়েয। তাই তার দিকে নেক নিয়্যাতে তাকালেও সাওয়াব হবে না। বরং গুনাহ্ই হওয়ার কথা।

সুতরাং আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মান্য ও ইখলাস দ্বারা আমরা প্রতিটি কাজকে ইবাদত বানাতে পারি। আর এমনি করলে আমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে থাকতে পারব। আল্লাহ তাআলাও সেই নির্দেশই দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে- “হে মু’মিনগণ! তোমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাক্বারাহ্- ২০৮ নং আয়াত)।

– মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী, উস্তাদুল হাদীস ওয়াল ফিক্বহ, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ