রাজধানীর উন্নয়নে দুই সিটির সঙ্গে রাজউকের সমন্বয়ের বিকল্প নেই — বাপার সেমিনারে বিশেজ্ঞদের মত

আপডেট: জুন ৮, ২০২১
0

বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২১ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র উদ্যোগে আজ ৭ জুন, ২০২১ সোমবার সকাল ১১.০০ টায় “ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় পরিবেশ ভাবনা”-শীর্ষক এক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।বাপা’র নগরায়ন ও নগর সুশাসন বিষয়ক কমিটির আহবায়ক, পরিকল্পনাবিদ স্থপতি সালমা এ শফি’র সভাপতিত্বে এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাপা’র নগরায়ন ও নগর সুশাসন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক, অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

সভায় অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন, মোঃ আশরাফুল ইসলাম, নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকল্প পরিচালক, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্প, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

সভায় নির্ধারিত আলোচক হিসাবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন, শরীফ জামিল, সাধারণ সম্পাদক, বাপা, স্থপতি ইকবাল হাবিব, যুগ্ম সম্পাদক, বাপা এবং সহ আহবায়ক, নগরায়ন ও নগর সুশাসন বিষয়ক কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এবং সহ-আহ্বায়ক, গণপরিবহন, গণপরিসর ও ঐতিহ্য বিষয়ক কমিটি, বাপা এবং পরিকল্পনাবিদ হিশামউদ্দিন চিশতী, পরামর্শক, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্প।

এছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, স্থপতি জেরিন হোসেন, পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক গোলাম রহমান, বাপা’ার কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খান এবং বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক, শারমীন মুরশিদ প্রমূখ।

স্থপতি সালমা এ শফি তার বক্তব্যে বলেন, রাজউকের গর্ভনেন্স পরির্তন করতে হবে। রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনের কাজের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। দুটি দুইমেরুরর হলে সেখানে কখনও উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি কমিউনিটি ভিত্তিক পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ড্যাপ পরিকল্পনার দাবী জানান।

অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ঢাকা মহানগর এলাকার খসড়া বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাটি ঢাকা ও তার আশপাশে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার ভূমি ব্যবহার, আবাসন, পরিবহন, পানিনিষ্কাশন, অর্থনৈতিক কর্মক, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, সামাজিক ও নাগরিক সেবা ইত্যাদি প্রদানের জন্য একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা। রাজধানী ঢাকা দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ঢাকার পরিসর যেমন বেড়েছে, তেমনি বাসযোগ্যতা কমেছে আশংকাজনকভাবে। এটি এমন সময়ে প্রণীত হচ্ছে, যখন বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, নিউ আরবান অ্যাজেন্ডা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করছে। সব বিচারে এই পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা দলিল।

মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সিএস এবং আর এস রেকর্ডে যত খাল আছে তার সবগুলোই রাজউকের আওতায় নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন বর্তমানে ঢাকা শহরের প্রায় ৭৪% এলাকা মিশ্র এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি বলেন আমাদের সবার লক্ষ্য সুন্দর সমৃদ্ধ শহর গঠন এবং ড্যাপ পরিকল্পনায় পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা প্রনয়ন করা হচ্ছে।

শরীফ জামিল বলেন, যে কোন সমন্বিত পরিকল্পনা প্রনয়নে বাস্তবতার চেয়ে আদর্শগত অবস্থানকে গরুত্ব দিতে হবে। সব ধরণের কাজে পরিবেশের বিষয় অগ্রগণ্য থাকা উচিত, কারন পরিবেশ বিপর্যয় শুধু মানবিক বিপর্যয় তৈরী করছে না বরং এটি এখন পৃথিবী টিকে থাকার প্রশ্ন। কাজেই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে। অকার্যকর ল্যান্ডিং ষ্টেশনে রাস্তা নির্মাণ কিংবা নদী-খাল-পুকুর-জলাশয় এবং প্লাবন অঞ্চলসহ অবশ্যই পূনরুদ্ধার করার মত গুরুত্বপূর্ন বিষয়কে মিশ্র এলাকা বা অন্য কোন নাম দিয়ে ড্যাপে অন্তভূক্ত করাকে তিনি ড্যাপ প্রনয়নে দর্শনগত ত্রুটি হিসেবে উল্লেখ্য করেন। তিনি মনে করেন প্রস্তাবিত এই ড্যাপে ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেয়ে যারা পরিবেশ ধ্বংস করে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাশালী হয়েছে তাদেরকে পূর্নবাসনের চেষ্টা রয়েছে। একজন দখলদারকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তাকে অংশিজন বানিয়ে পরিকল্পনা প্রনয়ন কখনও গ্রহণ যোগ্য নয়।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আমরা রাজউককে সত্যিকারের একটি জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চাই। রাজউকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ছাড়া একটি পরিকল্পিত ও জনকল্যাণমূখী ড্যাপ কখনও সম্ভব হবে না। তিনি ভূমি দস্যুদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবী জানান।

অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, টেকসই নগর গড়তে আমাদের অবশ্যই আদর্শিক বা নীতিনির্ধারনীর জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের কৃষি, জলাশয়, উদ্যান প্রভৃতি এলাকাসহ পরিবেশগত অন্যান্য সংবেদনশীল বিষয়গুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি ড্যাপ পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়নে রাজউকের বোর্ড এর পুনগঠন করার দাবী জানান।

ড্যাপ প্রকল্পের পরামর্শক হিশামউদ্দিন চিশতী বলেন, মানুষের চিন্তার জায়গাটি পরিবর্তন করতে হবে। শহর মানেই শুধু ইটপাথরের অট্রালিকা এখানে অন্য কিছুর স্থান নাই- এই ধরনের ভাবনা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। ড্যাপ পরিকল্পনায় জনসাধারণ ও অংশীজনদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে তিনি মতামত প্রদান করেন।

ওয়েবিানর থেকে বাপা ১৪ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরে…..
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ভূমি ব্যবহারে মিশ্র ব্যবহার প্রস্তাবনাসমূহকে পূনর্বিবেচনার মাধ্যমে আবাসিক এলাকার বসবাসের নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
১ .বন্যা প্রবাহ এলাকার ভূমি ব্যবহার শ্রেণীর পরিবর্তন না করে পূর্বের ভূমি ব্যবহার শ্রেণীতে রেখে সংরক্ষণ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

২.কৃষি এলাকায় ইকো রিসোর্ট বা বাসস্থান করবার প্রস্তাবনা বাতিল করবার মাধ্যমে কৃষি এলাকাসমূহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৩.সরকারের গেজেটভূক্ত বেদখলকৃত খাল, জলাশয়সমূহ তালিকাসহ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া।

৪ .ভারবহন ক্ষমতা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যা সুনির্দিষ্ট করবার উদ্দ্যেশ্যে প্লটপ্রতি বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা (ডুয়েলিং ইউনিট) নির্ধারণ করবার মাধ্যসে টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করত হবে।
৫ .অঞ্চলভিত্তিক ভিন্নতাকে বিবেচনায় নিয়ে বন্টভিত্তিক উন্নয়ন এর ক্ষেত্রে একর প্রতি ডুয়েলিং ইউনিট সংখ্যা নির্ধারণ করে জনঘনত্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
৬. প্রস্তাবিত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আওতাধীন সব এলাকার ঐতিহাসিক স্থাপনাসহ আদালত কর্তৃক ঘোষিত সকল ঐতিহাসিক স্থাপনাকে হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে তা সংরক্ষণের প্রস্তাবনা সংযোজন করতে হবে।

৭ .ইতিমধ্যে যারা পূর্বের ড্যাপের ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করে অনুমোদনহীনভাবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান অথবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বা ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের কারণে বেটারমেন্ট ফি নেয়ার ব্যবস্থা করা।

৮ .যত্রতত্র শিল্প কারখানা যেন গড়ে না উঠে সেজন্য শিল্প এলাকা সুনির্দিষ্ট করা এবং যে শিল্প কারখানাগুলো আবাসিক এলাকাতে রয়েছে সেগুলোকে সুনির্দিষ্ট করার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

৯ .অন্তর্ভূক্তিমূলক ও টেকসই ঢাকা শহর গড়ে তোলতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সর্বোচ্চ প্রাধিকার দিয়েই নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত।

১০ .ইকোপার্ক-এর সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকতে হবে।

১১ . রাজউকের এখতিয়ারভূক্ত এলাকায় সকল ঐতিহাসিক ব্যবস্থাপনাসহ আদালত কর্তৃক ঘোষিত ২২০০ স্থাপনাকে ঐতিহাসিক স্থাপনা/হেরিটেজ সাইট হিসেব করে তা সংরক্ষনের প্রস্তাবনা সংযোজন করতে হবে।

১২ .মিশ্র বানিজ্যিক এলাকার ভবনের আবাসিক ও বানিজ্যিক ব্যবহারের অনুপাত তা ব্যবহারের ধরণ এবং সড়ক বিন্যাস ও প্রভাব বিবেচনা নিয়ে মিশ্র এলাকার প্রস্তাবসমূহ সুনির্দিষ্ট করতে হবে।

১৩.নদী ট্রাস্কফোর্স কতৃক দেওয়া খালের সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রস্তাবে উল্লেখ করতে হবে।

১৪ .জনজীবনে স্বস্তিবিনষ্টকারী, পরিবেশ বিধ্বংসী রাসায়নিক গুদাম, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানা স্থানান্তর করে উপযুক্ত স্থানে নিতে হবে।