রাজনৈতিক পরিচয়ে কিশোর গ্যাংয়ে আতঙ্কিত জনপদ নারায়ণগঞ্জ

আপডেট: মে ২৮, ২০২২
0

পুলিশের লোক দেখানো অভিযান
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জে মাদকের পর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। ধারালো অস্ত্র হাতে দল বেঁধে চলা, পথের মধ্যেই প্রকাশ্যে কাউকে কুপিয়ে জখম করা স্বাভাবিক বিষয় তাদের কাছে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। রীতিমতো চলছে তাদের রামরাজত্ব। তাদেরকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় থেকে নানাহ অপকর্ম করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে শহরবাসির অফিযোগ কিশোর গ্যাং দমনে দেরিতে হলেও লোক দেখানো অভিযানে নেমেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে পাড়া-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। মে মাসের শুরু থেকে ২৪শে মে পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীদের হাতে ৩ জন নিহত, দুই সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

ওদিকে জেলার এমন কোনো পাড়া-মহল্লা নাই যেখানে হাত বাড়ালে মাদক পাওয়া যায় না। কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানের পেছনে মাদকের সহজলভ্যতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। আবার মিছিল মিটিংয়ে এই কিশোর গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করছেন স্থানীয় সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে, গত ২৪শে মে সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া চৌরাস্তা স্বপ্নদ্বীপ শপিং মলের সামনে ভোরের পাতা পত্রিকার সোনারগাঁ প্রতিনিধি ও জি.আর ইনস্টিটিউশন্স মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মশিউর রহমানের ওপর কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে।
সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা স্বপ্নদ্বীপ শপিংমলের সামনে তাদের বহন করা অটোরিকশা যানজটে আটকে থাকে। একপর্যায়ে হাবিবপুর গ্রামের লিটুর ছেলে কিশোর গ্যাংয়ের লিডার অন্তুর নেতৃত্বে ৭/৮ জনের একটি দল ৪টি মোটরসাইকেলযোগে উল্টো পথে এসে অটোরিকশার গতিরোধ করে অশ্লীল ভাষায় অঙ্গভঙ্গি করে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করতে থাকে।
মশিউর রহমান উত্ত্যক্ত করা ও উল্টোপথে এসে গতিরোধের বিষয়টি জানতে চাইলে তাকে টেনেহিঁচড়ে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ও কিল-ঘুষি মেরে মারাত্মকভাবে আহত করে।
এ সময় তিনি পার্শ্ববর্তী মার্কেটে গিয়ে আশ্রয় নিলে সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
১৭ই মে রাতে ফতুল্লার ইসদাইরে কিশোর গ্যাং সদস্যরা সিনিয়র-জুনিয়র বিরোধকে কেন্দ্র করে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে দশম শ্রেণির ছাত্র ধ্রুব দাস (১৫)কে। একইদিন বন্দরের রেললাইন এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
১৫ই মে রাতে শহরের দেওভোগ জিউস পুকুর পাড় এলাকায় মায়ের সামনে থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে রাতভর নির্মম নির্যাতন করে সুব্রত মন্ডল (১৮) নামে এক হোসিয়ারি শ্রমিককে ১৫/২০ জনের একটি কিশোর গ্যাং পিটিয়ে জখম করে।
এ সময় সন্ত্রাসীদের পায়ে ধরেও প্রাণ ভিক্ষা পায়নি সে। একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে মৃত ভেবে বাড়ির সামনে তাকে ফেলে রেখে যায়। ৬ দিন পর ২২শে মে রাতে হাসপাতালে মারা যায় সুব্রত। মৃত্যুর আগে সে খুনিদের নাম বলে গেছে।
তাকে নির্মমভাবে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই গ্যাংয়ের সদস্যরা হচ্ছে ইয়াবা সায়েম (৩০), সাজিদ ভূঁইয়া (৩৬), নাইম উদ্দিন বাবু (৩৫), দোলন (২৫), আল-আমিন (২৫), নোমান (২২), প্রণয় (২২), রাকেশ (২০), সুদেব (৩২), অনিক রাজিব (২৬) ও মানিক (২৫)। ১৪ই মে সন্ধ্যায় সিদ্ধিরগঞ্জে ৫নং ওয়ার্ডে শীতলক্ষ্যা ওয়ার্কওয়েতে আরাফাত হোসেন রিদয় (১৭)কে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
তার চিৎকার শুনে বন্ধু আরাফাত এগিয়ে আসলে তাকেও কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। এ ঘটনায় ৫ কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী সাকিব (২৫), ফাহিম (২৫), আল আমিন (২৪), মামুন (২৪) ও ফারুক (২৫)কে আসামি করে থানায় মামলা হলেও পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি।
একইদিন শহরের দেওভোগ পানির ট্যাঙ্কি এলাকায় মিরাজুল ইসলাম দীপু এবং বন্দরে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম রিফাতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা।
এরমধ্যে মিরাজুল ইসলাম দীপুকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ১৫ই মে পুলিশ নোয়াস নামে এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। বাকি ঘটনাগুলোতে কোনো গ্রেপ্তার নেই। গত ১৩ই মে রাতে নগরের গলাচিপা বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক অগ্রবাণী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রশিদ চৌধুরী ও পথচারী মো. জসিম।
আহত রশিদ চৌধুরীর ভাষ্য, বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্র হাতে মহড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকদিন আগে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায় অস্ত্র হাতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দুই যুবককে কোপাচ্ছে। সেই ভিডিও’র সূত্র ধরে তাদের পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়।
এর জের ধরে তার ওপর হামলা চালানো হয়েছে বলে তার ধারণা। এ ছাড়া মে মাসের শুরুতে শহরের নন্দীপাড়া এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ১০/১২ জন সদস্য প্রকাশ্যে এক যুবকের ওপর হামলা চালায়। এই হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম দিকে হামলায় আহত যুবক কিশোর গ্যাং সদস্যদের ভয়ে নিজেকে আড়ালে রাখলেও ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ১৪ই মে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করে। জানা যায়, কথিত সরকার দলীয় বড় ভাইদের প্রশ্রয়ে যুক্ত হয়ে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর সন্ত্রাসীরা।
প্রায় প্রতিদিনই থানা পুলিশের কাছে কিশোর গ্যাংয়ের মারামারি, চাঁদাবাজি, ভাংচুর, মাদক কারবার, ইভটিজিং ও ছিনতাইয়ের নানান অভিযোগ আসছে। স্থানীয়রা বলছেন, দল বেঁধে কিশোররা এসব অপরাধে জড়ানোর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না বাসিন্দারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও সদর থানা এলাকায় অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। গত এক বছরে বিভিন্ন সময়ের নানা ঘটনার সূত্র ধরে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী বাহিনীর সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে বা দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
যার কারণে দিন দিন কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের নৃশংসতা দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অনেকেই। এখনই এসব উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোরদের নানাভাবে প্রশ্রয় এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে নেয়ার কারণেই আজকে এই কিশোর গ্যাং কালচার তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে তা বিশাল আকার ধারণ করেছে। স্থানীয় পাতি নেতা এবং ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি চালানো নেতারা এখনো এদের ব্যবহার করে নিজের পেশিশক্তি বৃদ্ধি করে থাকে।
ফলে, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতা পেয়ে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. আমির খসরু বলেন, ইতিমধ্যে এই কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান শুরু হয়েছে। পাশাপাশি যে সকল জায়গাগুলোতে কিশোর অপরাধ হয় সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
কিশোর অপরাধে যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তাদেরকে আমরা পুনরায় কোনো অপরাধ পেলে আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। যারা নতুন করে এই পথে আসছে আমরা তাদের বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
সাথে (৩নং) ছবি আছে।