রাষ্ট্রীয় আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার অন্তরালে এসব কি চলছে !!

আপডেট: আগস্ট ১৩, ২০২১
0

এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

“দুষ্টের দমন ও শীষ্টের পালনই” আইন শৃঙ্খলা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মূলনীতি। এ জন্য রাষ্ট্র জনগণের অর্থায়নে নানা ধরনের এজেন্সী লালন পালন করে, যারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। জনগণের অর্থায়নে রাষ্ট্র অনেক অনেক মূল্য দিয়েই এ বাহিনীগুলিকে লালন পালন করে। “মূল্যোর” সাথে তাদের অফিসিয়াল/নন অফিসিয়াল ক্ষমতাও অনেক, তাদের কোন প্রকার বেআইনী ও বির্তকিত কর্মকান্ড বা সীমালঙ্গন প্রকাশ পেলেও সাধারণ জনগণের কোন ক্ষমতা নাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বির্তকিত কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ বা জবাবদিহি করতে বাধ্য করার। বরং জনগণের মধ্যে কেহ কোন কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করলে কর্মকর্তা যদি বিরাগভাজন হন তবে প্রশ্ন কর্তার চৌদ্দ পুরুষের খবর হয়ে যাবে, যদি সে ব্যক্তির “মামার” জোর বা ক্ষমতাসীনদের রেফারেন্স না থাকে, আর যদি বিরোধীদলীয় কোন সমর্থক বা নেতাকর্মী হয়ে থাকে তবে তো আর কথাই নেই, ফলশ্রুতিতে প্রশ্নকর্তা টের পাবে যে কত ধানে কত চাল এবং এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা; এ ধরনের পরিস্থিতিতে সংবিধান একেবারে নিরব।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বৎসর অতিক্রম করতে চললো। পোশাকী বাহিনীর পাশাপাশি সাদা পোষাকী অনেক গোয়েন্দা বাহিনী বা ইন্টেলেজিন্সী রয়েছে যারা জনগণের বিপুল পরিমান ব্যয়ে লালিত পালিত, তবে এ গোয়েন্দা বাহিনী ঈমানদারীর সাথে দায়িত্ব কতটুকু পালন করে তা বিশ্লেষন ও বিচার বিবেচনার দাবী রাখে, কারণ ৫ (পাঁচ) বৎসর ব্যবধানে স্বাধীন বাংলাদেশে ২ জন রাষ্ট্রপতি পোষাকদারীদের দ্বারা নিশংসভাবে খুন হয়েছে, যার জন্য গোয়েন্দাদের নিকট আগাম কোন সংবাদ ছিল না; নাকি জেনেও তা প্রকাশ করে নাই, সে গোপনীয়তা এখনো গোপনই রয়ে গেল।

মাদক দেশ ছেয়ে গেছে, সরকার কোন প্রকারেই মাদক নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। কারণ সরিসার মধ্যেই ভূত রয়েছে। সম্প্রতিকালে মডেল, চিত্রনায়িকা ও বোট ক্লাব ক্যালেঙ্কারীতে পোষাকী বাহিনীর ভিতরের অনেক কথা প্রকাশ পাচ্ছে, যা শুনতে ও বিশ্বাস করতে মন চায় না, কিন্তু বাস্তবতার খাতিরে বিশ্বাস না করেও পারা যায় না। সরকারের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর মুজিব বর্ষে ঘোষনা করেছে যে, “মাদক মুক্ত বাংলাদেশই মুজীব বর্ষের অঙ্গীকার।” কিন্তু বিশেষ ঘোষনা দিয়েও সরকার কেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না তাহাও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় নিতে হবে। মডেল/নায়িকা চক্রের ছদাবরনে রাজধানীর অভিজাত মাদক আসর/আড্ডা জমার কথা পত্রিকান্তরে প্রকাশ পাচ্ছে যার পার্টিসিপেন্ট হচ্ছে ধনীর দুলাল/দুলালী ছাড়াও উচ্চ স্তরের লোকজন যাদের মধ্যে আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের লোকও বাদ পড়ছে না। এখানে গোয়েন্দাদের ভূমিকা অত্যান্ত প্রনিধানযোগ্য। কারণ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোথায় কি সংগঠিত হচ্ছে তার সংবাদ রাষ্ট্রের কানে গোপনে তুলে দেয়ার কাজই গোয়েন্দা বাহিনীর। কোন কোন সময় দেখা গিয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য গোয়েন্দাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রবল এবং এখনো সে ভূমিকা অব্যাহত আছে। রাষ্ট্রের নিকট সঠিক তথ্য তুলে ধরা সম্পর্কে গোয়েন্দা বাহিনীর ভূমিকা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ।

সম্প্রতি মাদক ক্যলেঙ্কারির ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুই রকম পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে, বোট ক্লাবে বির্তকিত নায়িকাকে ধর্ষনের চেষ্টাসহ জোরপূর্বক মদ পান করানো হয়েছে, অন্যদিকে র‌্যাবের প্রাথমিক তথ্য মতে ঐ নায়িকা ২০১৬ ইং সাল থেকেই মাদকে অভ্যস্ত এবং তার বাড়ী থেকে নানা বিধ দেশী বিদেশী মাদক ও মাদক সেবার সরঞ্জাম র‌্যাব উদ্ধার করেছে। এখন জনমনে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রথম ঘটনা কি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরঞ্জিত, নাকি দ্বিতীয়টি? মাদক সেবী মডেল/নায়িকা ও তাদের মদ্যপ সহযোগীদের গ্রেফতার করে তাদের সাথে সম্পর্কীত ধন্যট্য ব্যক্তি যাদের সাথে বিদেশ ট্রীপ হয়েছে, কারা তাদের দেহ পসারনী হিসাবে ভোগ করছে এবং কারা ছিল মাদক আসরের খরিদ্দার ও তাদের সহযোগীদের নাম/ঠিকানা জানার জন্য রিমান্ড চেয়েছে। এখন ডিএমপি কমিশনার বলছে যে, এমর্মে কারো নাম প্রকাশ করা হবে না, কারণ কারো বাসায় কারো যাওয়া কোন অপরাধ বা আইন বিরোধী কাজ নয়। এখানে কমিশনারকে প্রশ্ন করে বলতে চাই যে, মদের পার্টিতে অংশ গ্রহণ এবং অনৈতিকভাবে মেলামেশাকে তিনি কোন বিবেচনায় দেখেন? নিশি রাত্রিতে বোট ক্লাব মাদক ও ধর্ষণের চেষ্টায় মামলার সুপারভাইজিং অফিসারের সাথেই নায়িকা গাড়ীতে হাতির ঝিলে মদ্যপান ও অবাধ মেলামেশার জন্য সে পুলিশ অফিসারকে ঢাকাতেই অন্যত্র বদলী করা হয়েছে মাত্র। (পরবর্তীতে সুপারভাইজিং অফিসার হওয়ার কথা ডি.এম.পি অস্বীকার করে)। এখন ডি.এম.পি কমিশনার বলছে যে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোন সুযোগ নাই। এঘটনা যদি পুলিশ অফিসারের সাথে না হয়ে অন্যকোন সাধারণ নাগরিকের সাথে হইতো তবে গ্রেফতার ও রিমান্ড ছাড়াও পুলিশ এ ঘটনাটিকে ডি.এন.এ টেষ্টসহ ফরেনসিক রিপোর্ট পর্যন্ত গড়াতো। পুলিশের নীতি নির্ধারনী মহল এভাবেই পুলিশ বাহিনীকে বির্তকিত করে আস্থার প্রশ্নে জনগণের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উচ্চ পর্যায়ের মাদক সেবীদের বিষয়ে পুলিশের নমনীয় ভূমিকা মাদক সেবায় উচ্চ বিত্তদের উৎসাহিত করা ছাড়াও নষ্ঠা চরিত্রের নায়িকা ও মডেল হওয়ার রাস্তাকে প্রসস্ত করবে। মাদক সেবীদের নাম যদি প্রকাশ করা না হয় বা তাদের বিচারের আওতায় না আনা হয় তবে কেন তাদের (মাদক আড্ডায় যাতায়াতকারীদের) নাম জানার জন্য রিমান্ড চাওয়া হলো? তবে এটা কি ছিল নিরব চাঁদাবাজীয় একটি অভিনব কৌশল (!) উল্লেখ্য, কেহ চাঁদাবাজী করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে সম্মান হানির ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজী একটি সুন্দর কৌশল যা কেহ টের পায় না এবং বুঝতেও পারে না। নামী দামী লোকেরা নৈতিকতা ও আইনকে ভয় পায় না, ভয়পায় সম্মান হানিকে, তারা সাধারণত নিজ অপকর্মের জন্য পরিবার ও লোকজনের মূখো মুখি হতে চায় না, বরং টাকার উপর দিয়েই সব চালিয়ে দেয়।

রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার পাঁচ মিশালী নীতিমালা অবলম্বন করায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা অনৈতিক কর্মকান্ড ও মাদকের সম্প্রসারন নিয়ন্ত্রন হচ্ছে না। মোট জনসংখ্যার ৯২% মুসলমানকে মিথ্যা ও ছেলে ভুলানো সান্তনা দেয়ার জন্য সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে সংযোজিত হয়েছে “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম।” অথচ ইসলাম ধর্মের চারিত্রিক অনুশাসন’কে কোথাও অনুস্বরণ করা হচ্ছে না, যা প্রচার হচ্ছে তা হলো লোক দেখানো। জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা রক্ষার্থে সংবিধানের ১৮(১) (২) অনুচ্ছেদে মদ্য ও মাদক পানীয়সহ গনিকা বৃত্তি ও জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রীয় উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় উক্ত কোন নিষিদ্ধ কাজটি বাংলাদেশে সংগঠিত না হচ্ছে? এ বিষয়গুলি প্রধানমন্ত্রী (রাষ্ট্রনায়ক) কতটুকু জানেন তিনিই তা ভালো বলতে পারবেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুলিশকে যথাচ্ছোভাবে ব্যবহার করায় বাহিনীটি তাদের পেশাধারীত্ব ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ কর্মচারী বাহিনীতে পরিনত হয়েছে, ফলে দূনীতি অনৈতিক কর্মকান্ডে তারা পিছিয়ে নেই। ১১/৮/২০২১ ইং তারিখে অন-লাইন নিউজে প্রকাশ ফেনীতে ২০টি স্বর্ণের বার আতœসাতের অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শকসহ ৬ জন পুলিশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, কোনটা প্রকাশ পায়, অধিকাংশই প্রকাশ পায় না। ইন্সপেক্টর প্রদীপ দাস শুধু টেকনাফে নহে, এ ধরনের প্রদীপ বাংলাদেশের সর্বত্রই জ্বলছে।

সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিনত করেছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ ২০১৮ পাশ করে গণমানুষের কন্ঠকে রোধ করে সংবিধান প্রদত্ব মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করেছে। ডিজিটাল ইন্সটুমেন্ট মানুষের চরিত্র হননে যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তা নিয়ন্ত্রনে সরকার বাস্তবসম্মত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নাই, আইন যতটুকু কার্যকর করেছে ভিন্নমত প্রকাশনার কারণে। অথচ ফরেনসিক রির্পোট নেগেটিভ হওয়ার পরও বিএনপি করার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চার্জশীট দেয়া হয়েছে, দায়িত্ব নিয়েই এ কথা বলছি।

গায়েবী মোকদ্দমা সৃজন, মিথ্যা চার্জশীট প্রদানে পুলিশ গিনিস বুকে নাম লিখানোর মত রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে তাদের চৌকষ ভূমিকাও আছে। পুলিশ ১৬০ বৎসর পূরানো একটি মজবুত সংগঠন, সকল সরকারই এ বাহিনীকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করলেও বর্তমান সরকার করেছে নগ্নভাবে। পুলিশ বলছে যে, তারা জনগণের বন্ধু, কিন্তু জনগণ তা বিশ্বাস করে কি? লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা ঝরৎ জড়নবৎঃ চববষ বলেছেন “জনগণের আস্থাই পুলিশের সফলতা।” দেশবাসী একটি সফল আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দেখতে চায়, দায়িত্ব পালনে যারা থাকবে সকল বির্তকের উর্দ্ধে।

অন্যদিকে পেশাদার বাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশী মর্যাদাসম্পন্ন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের গৌরবজ্জল ভূমিকা রয়েছে। সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত পেয়ে নব নিযুক্ত সেনা প্রধান আশার আলো দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, সেনাবাহিনীর হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। আশায় রইলাম, কন্টকময় এ সমুদ্র যাত্রার পালে তিনি কতটুকু হাওয়া ধরাতে পারবেন? দেশ ও জাতি একটি সুস্থ্য জীবন ধারায় বাংলাদেশ দেখার জন্য চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত সকল বাহিনী সঠিক পেশাদারীত্বের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনবে, জনগণ তা প্রত্যার্শা করে।

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)