জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম:
দীর্ঘ ৭ বছর ধরে তার নিজের সামান্য চাকুরির বেতনের টাকার একটি অংশ দিয়ে বিভিন্ন রাস্তার ধারে বৃক্ষরোপনের পেছনে ব্যয় করে আসছেন। তিনি হলেন বৃক্ষ প্রেমিক আনোয়ার হোসেন।তার বাড়ি বাড়ী কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের টাপুরচর গ্রামে। তিনি কুড়িগ্রামের টাপুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি পদে কর্মরত। তার এই বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা এলাকাবাসীর প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
গ্রামীণ ও শহরের সড়কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন তিনি। শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে গড়েছেন ফুলের বাগানও। শুধু তাই নয় এসব গাছ ও ফুলের বাগান নিজ হাতেই পরিচর্যা করে যাচ্ছেন তিনি। রোপন করা সাড়ে সাত হাজার গাছের মধ্যে এখন প্রায় চার হাজার গাছে ফল ও ফুল ধরেছে।
আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোটবেলা থেকে প্রকৃতির প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসা থেকে ৭ বছর থেকে নিজের হলোখানা ইউনিয়ন সহ কুড়িগ্রামের বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ফল-ফুলসহ ভেষজ গাছ লাগানো শুরু করেন। কাজের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এলাকাবাসীর কাছ থেকে সামান্য জমি নিয়ে নিজের নার্সারিতে শুরু করেন চারা রোপণ। সেই সাথে বৃক্ষরোপন এর পরিধি আরও বাড়তে থাকে।
আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, গাছের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই ছোট বেলা থেকেই বৃক্ষরোপন করে আসছি। এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সাড়ে সাত হাজার গাছ লাগিয়েছি। আমি একজন সরকারি কর্মচারী। সামান্য বেতন যা পাই তার থেকে প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে বৃক্ষ রোপনের পেছনে ব্যয় করি। শহরের তারামন বিবি সড়কে দীর্ঘ ৮ কিমিঃ সেখানে প্রায় ৫০০ বিভিন্ন গাছের চারা রোপন করেছি। যেগুলোকে গাছে অনেক ফল ধরতেছে। এছাড়াও হলোখানা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কুড়িগ্রাম পৌরসভা প্রায় ৬ কিমি রাস্তা জুড়ে ফল ও ফুলের গাছ রোপন করেছি। সবচেয়ে সৌন্দর্য বর্ধনে কুড়িগ্রাম বাস টার্মিনাল থেকে সার্কিট হাউস রাস্তাতে সোনালু গাছ লাগিয়েছি সেগুলোতে ফুল ধরছে। অন্য দিকে কুড়িগ্রাম পৌর শহরের রোড ডিভাইডারগুলোতে বর্জ্য অপসারন করে ফুল ও ফুলের গাছ লাগিয়েছি। বাংটুর ঘাট এলাকা ও ধরলা নদী রক্ষা বাঁধে ৩০০ চারা রোপন করেছি। কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদরাসা হতে বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন হোটেল অর্নব প্যালেস পর্যন্ত কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগিয়েছি। এছাড়াও বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী ঝাকুয়াটারী মসজিদ মাঠে বৃক্ষ রোপন করেছি।
তিনি আরও বলেন, এই গাছ লাগানোর পেছনে সমাজের অনেক মানুষই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। আমি যদি সরকারী কিংবা বেসরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা পাই তাহলে কুড়িগ্রাম জেলার পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশে বৃক্ষরোপ করতে চাই। আমার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমি কুড়িগ্রাম জেলাবাসীকে অনুরোধ করব, আসুন আমরা বেশী বেশী করে গাছ লাগিয়ে কুড়িগ্রাম জেলাকে সমৃদ্ধ করি। বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দূর্যোগের প্রবণতা কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করি। প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে আমরা লাগানো বৃক্ষগুলি অনেক ভূমিকা পালন করবে। ২০১৯ সালে কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদরাসায় বজ্রপাতে মাদরাসা ভবন সহ গুরুত্বপূর্ণ নথি সমুহ পুড়ে গিয়েছিল। আমার তখন থেকেই বোধ গম্য হয়েছে বজ্রপাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তাল গাছের বীজ রোপন করতে হবেআমি সেই চিন্তা থেকেই কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে তাল গাছের বীজ রোপন করেছি।
আনোয়ার হোসেন বৃক্ষরোপনের আহবান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা প্রত্যেকেই বৃক্ষরোপণের কাজে এগিয়ে আসি। তাহলেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলের যে সব মানুষ ফল কিনে খেতে পারেন না তারা অামাদের লাগানো গাছের ফল খেয়ে ফলের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন। অামি অসংখ্য ফল ও ফুলের চারা রোপন করেছি। আমি যত বেঁচে থাকব ততদিন আমার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গত ৪-৫ বছরধরে গ্রাম থেকে শহর এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে আনোয়ার হোসেন কৃষ্ণচুড়া, বকুল, বট, সোনালুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপন শুরু করেন। এক পর্যায়ে শহরের শোভা বর্ধনের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ ও সড়ক বিভাগের অনুমতি নিয়ে শহরের রোড ডিভাইডার গুলোতে গড়ে তোলেন ফুলের বাগান। তাঁর এসব কাজে সহযোগীতার জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে উৎসাহ ও উদ্দীপনা বাড়াতে গড়ে তুলেছেন ওরাকল লাইব্রেরী।
একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিম্ন পদে চাকুরি করা এই যুবকের প্রকৃতির প্রতি অসীম ভালোবাসা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। পাশাপাশি তাকে দেখে নতুন প্রজন্ম বৃক্ষ রোপনে উজ্জিবত হলে পরিবেশ ও প্রকৃতি আরও সুরক্ষিত হবে বলে মনে করছেন এখানকার মানুষজন।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান হাবীব বলেন, আমি দীর্ঘ দিন ধরে অানোয়ার ভাইয়ের সাথে গাছ লাগানোর কাজে নিয়োজিত আছি। এ পর্যন্ত আমরা কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছি। আমাদের এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারনে আমাদের এ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি কিংবা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের গাছ লাগানোর এ কার্যক্রম সুদূর প্রসারী হবে।
টাপুর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আ.ন.ম. আব্দুল খালেক বলেন, ‘বৃক্ষপ্রেমী আনোয়ার হোসেন আমাদের টাপুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এমএলএসএস। সে পরিবেশকে সৌন্দর্যমন্ডিত করণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য দীর্ঘ দিন থেকে নিজ খরচে গাছ লাগিয়ে আসছে। শুধু আমাদের হলোখানা ইউনিয়নেই সে কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে। তার লাগানো গাছে যেমন পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি চলন্ত পথিক তার লাগানো গাছের ছায়ার নিচে বসে অাশ্রয় নিচ্ছে। এতে সে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। সে গাছ লাগিয়ে আমাদের পরিবেশকে সমৃদ্ধ করছে। যে কাজটি অামাদের সকলের করা উচিত সে কাজটি আনোয়ার একাই নিজের বেতনের টাকা দিয়ে করছে। আমাদের সকলের উচিত আনোয়ারের মত করে বৃক্ষ রোপনে এগিয়ে আসা।
কুড়িগ্রাম পুলিশ লাইন স্কুলের শিক্ষক হাফিজুর রহমান বিপ্লব বলেন, কুড়িগ্রাম সদরের হলোখানা ইউনিয়নের খলিফার মোড় হতে বীর প্রতীক তারামন বিবির বাড়ী পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার দু’ধারে বনজ, ফলজ ও ওষধি গাছ লাগানো সহ আমাদের এলাকার বিভিন্ন অলিতে গলিতে শত শত গাছের চারা নিজের বেতনের টাকা কর্তন করেন রোপন করেছেন ছোট্ট পদের একজন চাকুরীজীবি আনোয়ার ভাই।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যাক্ষ ও উদ্ভিদবিদ মোঃ মির্জা নাসির উদ্দিন বলেন, আনোয়ার হোসেন আমাদের সবার কাছে একটি প্রেরণার উৎস। গাছ লাগানোর ফলে কুড়িগ্রাম শহরে একদিকে যেমন শোভাবর্ধন হচ্ছে অন্যদিকে এ শহরের পরিবেশ আরও উন্নত হচ্ছে।
###/