`লোকলজ্জার ভয়ে আমরা নিজেদের মধ্যবিত্ত বললেও আমরা আসলে মারাত্মক গরীব’

আপডেট: জানুয়ারি ৩০, ২০২৩
0

ডাঃ মোঃ জাকারিয়া চৌধুরী

অন্যের কথা মন দিয়ে শুনুন; সে যাই বলুক না কেন ?
খুব ভালভাবে মন দিয়ে প্রতিটা শব্দ শুনুন। মনে করার চেষ্টা করুন, তার বলা কোন শব্দ অতীতে শুনেছিলেন কিনা ! শুনলে সেটা কোন প্রেক্ষিতে শুনেছিলেন !! মনে করুন। মানুষ কোন না কোনো শব্দ কমন ইউজ করে। আপনার চিন্তার জগৎ এদিকে সামান্য হলেও এটেনশনে রাখুন।

আপনি খেয়াল রাখুন নিজে কি বলছেন ! যা বলছেন তা প্রাসঙ্গিক তো !! আপনার কথায় অন্যকে শ্রুদ্ধা দেখানোর মানসিকতা আছে কিনা নজর রাখুন।

কাউকে খাটো করবেন না।

মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছ্যিল্য করবেন না।

কে কেমন স্ট্যাটাস বিলং করছে সেদিকে নজর দেয়ার দরকার নেই। সে যে কাজে এসেছে তার সে কাজের সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন আছে কিনা চেখে দেখুন। অকারন আড্ডা দিয়ে জীবন থেকে ১৬% সময় চলে যায়। ১০০ বছরের একজন মানুষ গড়ে ২৬ বছর ঘুমায়, ১৬ বছর আড্ডা দেয়, কর্মে অক্ষমতা থাকে ২০ বছর। এভাবে-ই জীবন থেকে ৭২ শতাংশ সময় চলে যায়, মানে ৭২ বছর। এবার ভাবুন তো, জীবনের বাকি সময়টা কিভাবে পার করেছেন ? বাকি রইল ২৮ বছর। এ সময়ে আপনি জীবনের পড়াশোনা করেছেন, সংসার করেছেন, সংসার সমরে অবিরাম লড়েছেন, নিজেকে স্টাবলিশ করতে চেয়েছেন, শিশুদের গোলামী করে বড় করেছেন। আপনার অসমর্থ অক্ষম বয়সে সেইসব বড় শিশুদের হাতে জিম্মি হয়ে ময়লা নোংরায় যা তা খেয়ে না খেয়ে মরেছেন !!

স্ত্রী’কে সন্তুষ্ট করতে বেসামাল লড়েছেন। ডান বাম ন্যায় অন্যায় নীতি নৈতিকতা কোন কিছুর-ই ধার ধারেননি। জীবনের শেষ সময়ে এসে শুনছেন, এসব করার জন্য আপনাকে কেউ কিছু-ই বলেনি, বাধ্য করা তো দূর কি বাত !!

কেউ যদি আপনাকে কথা বলবার স্পেস না দেয়, অপেক্ষা করুন।

মানুষ নিজেই তার অতীত কান্ড, বর্তমান কি কি করছে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রকাশ করে দেয়। আপনি কেবল মন দিয়ে শুনুন। মন দিয়ে কথা শোনার উপকারিতা অনেক। একটা গল্প বলি শুনুন।

আজ থেকে সাত বছর আগে একজন উচ্চ মার্গের মানুষ কেবল একবার উচ্চারন করেছিল – আমার ক্যারিয়ারের কি হবে ? অথচ এর আগের সাত বছর তার এ বক্তব্যকে অস্বীকার করে গিয়েছিল। তিনি সব সময় আমাকে শোনাতেন, তিনি ভীষন নির্লোভ !! আমি আসমান ভেঙ্গে পড়েছিলাম, কত সামান্যে মানুষ বিক্রি হয়ে যায় তা দেখে। তিনি তার স্বপ্নের সেই ক্যারিয়ার গড়তে হেন কোনো অপরাধ নেই যা করেননি। হেন কোনো মিথ্যা নেই যা তিনি বলেনি !!

একদিন সন্ধ্যায় নামাজে দাঁড়িয়ে তিনটা প্রশ্নের তিনটা মিথ্যা উত্তর দিয়ে নামাজ পড়েছিল। এ ঘটনায় আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই এবং নিজের অজান্তেই বলে ফেলি, এভাবে নামাজ পড়ার মত নৃশংস আমি নই। এজন্যে যদি বাকি জীবন লোকে আমায় নাস্তিক বলে-বলুক। আমার কোন ক্ষেদ নেই। আমাকে কেউ কখনো নাস্তিক বলেনি, যিনি মিথ্যাগুলো বলেছিলেন তিনি ছাড়া। প্রভুর সামনে এতটা উদ্ধত হবার মানসিক শক্তি আমার নেই, ছিল না আগেও। মানুষ তার জবান দিয়ে নিজের কর্মকান্ড কোনো না কোনোভাবে প্রকাশ করে যায়, আমরা তাদের কথা মন দিয়ে শুনিনা। আমরা অপেক্ষা করি কখন সে থামবে !! কখন আমি কথা বলার স্পেস পাব। নিজেকে জাহির করব। এখন ভাবছি, এত কথা বলার দরকার কি !! নিজের মনে যত কথা জমে আছে তা-ই ত শত জনমে লিখে শেষ করতে পারব না !!

জানেন, আমি ইচ্ছে করে টাকা জমাতাম না, এখনো জমাই না। টাকা যখন ছিল না, সমাজে আমরা রাজ পরিবারের সম্মান পেয়েছি। আগে যে বাড়িতে থাকতাম, সে বাড়ি আহ পরিত্যাক্ত এক শ্মশান। এই যে, গত প্রায় দু’মাস প্রায় বিছানায় পরে আছি, এতে আমার মোটেও খারাপ লাগেনি। আমার একবারও ইচ্ছে করেনি ভাল কোনো ডাক্তার দেখাতে। যদি কুড়ি হাজার টাকার দরকার হত, সেটা আমার নেই। কেন নেই, সেজন্য আমার কোনো দুঃখবোধও নেই। আমি আজীবন স্বপ্ন দেখেছি, যখন ক্ষমতায় যাবো তখন শত জনমের টাকা আয় করে নেব। কিন্তু গত ক’মাসে বিএনপি আয়োজিত অন্ততঃ আটটা মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে আমার মনে সেই ভয়টা আবার বাসা বেধেছে। নামাজির কান্ড দেখে যে ভয় আমি পেয়েছিলাম সে ভয়টা যেন আবার ফিরে এসেছে। বরিশাল যাবার পথে যখন দেখলাম হত দরিদ্র প্রায় দুটি কন্যা নাও বেয়ে দরিয়া পাড়ি দিচ্ছে, আমার মনের প্রথম ভাবনাটা ছিল, মেয়ে দুটোকে লঞ্চে তুলে নেই। ওরা পানিতে পরে গেলে পরে আর খুঁজে পাব না।

রাজশাহী গিয়ে কালা-ই রুটি খেয়েছিলাম হাসের মাংসের সাথে। একদিন পর বুঝলাম, যে কালাই রুটি আমরা হাসের মাংস দিয়ে খাই, রাজশাহীর লোকেরা কিন্তু সেটা খায় না। ওরা রাস্তার পাশে রুটি খায় কাচামরিচ বেটে। এবং হাজার হাজার মানুষের এটা-ই নিত্য খাদ্য। এতো সুন্দর একটা সবুজ শহরের কি করুন অভাব !! পটুয়াখালী থেকে হেটে, রিক্সায়, ট্রলারে কত কষ্ট সয়ে একজন বয়স্ক লোক এসেছিলেন বরিশালের বেলস পার্কে। উনি জানালেন তিনি নিজ কানে শুনতে চান চালের দাম কমবে কিনা !! তার আর কোনো চাওয়া নেই। তাকে জিগেস করলাম- এ কথা তিনি কার মুখ থেকে শোনার আশায় আছেন ? তিনি বললেন বড় বড় নেতারা তো আর মিথ্যে বলবে না, নাকি বলবে !! তাকে একথাটা বলতে পারলাম না, যাদের কথা বিশ্বাস করতে এসেছেন তারা কেউ একে ফজলুল হক নয়। তারা ভাবে, যে যত বড় নেতা সে ততবড় দেশপ্রেমিক। এই ভয়ংকর ভুলটা আমি চাইলেই ভাংগিয়ে দিতে পারতাম। করিনি। আহারে বুড়ো মানুষটা তার পাচটা মেয়েকে খাওয়াতে পারছে না, নিজেও খেতে পারছে না। ভেজা মাঠের মাটিতে বসে নিজেই নিজের পা টিপছে। কালু – মিরাজের মায়ের কথা ত কতবার বলেছি। বিভিন্ন বাসা বাড়িতে ঠিকে ঝি’য়ের কাজ করে দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ চালানোর চেষ্টা করতো !! একজন ১৪ এবং অন্যজনের বয়েস ১৮। তাদেরকে তুলে নিয়ে যাবার পর থেকে আজতক তাদের একজনও ফিরে আসেনি। একজন মানুষ কাদতে কাদতে অন্ধ হয়ে হয়ে যেতে পারে আমি ডাক্তার হয়েও জানতাম না।

আমাদের দেশটা কেবল ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেট এই তিনটা জেলা শহরেই আবদ্ধ না। এদেশে হাজার হাজার থানা উপজেলা আছে, ইউনিয়ন গ্রাম আছে যেখানে আসলে কিছু নেই। খাদ্যের নিশ্চয়তা নেই। বাসস্থান শিক্ষা তো দূর কি বাত !! আসলে আমাদের অনেক টাকা দরকার, এরচে বড় দরকার সেগুলোর সঠিক বিনিয়োগ। স্টহিক প্লেসে সঠিক লোকের পদায়ন। ক্যামেস্ট্রিতে মাস্টার্স করা ছেলেমেয়েদের যেন ব্যাংকে জব করতে না হয়-এটা নিশ্চিত করা। এদেশের মানুষ মোটেও ধনী হয়নি। এরা মান্যিগুনী মানুষের মুখে মিথ্যা শুনতে শুনতে মিথ্যাকেই বিশ্বাস করে বসে আছে। যেসব শিশুরা এখনো পৃথিবীতে আসেনি, তাদের ঘাড়ে আমরা জনপ্রতি ৯৬ হাজার টাকা অগ্রিম ঋন নিয়ে রেখেছি। সে জন্ম নিলে এ পরিমান রিইন তাকে শোধ করতে হবে সুদ সমেত। আবার জন্ম না নিলে এ টাকা শোধ করে যেতে হবে তার পিতামাতাকে। এভাবে চলতে থাকলে দেশটার কি ভয়ংকর সর্বনাশ হয়ে আছে, বুঝতে পারছেন !! রাজশাহী অঞ্চলে আমি নিজে না গেলে এ সত্য বিশ্বাস করানো কঠিন হতো। আমরা আসলে গরীব ! মারাত্মক গরীব। আমি শুনেছি, লালমনিরহাটে দেড় বছরের শিশুরা শুকনো মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খায়। কুড়িগ্রামের ডিপ স্টেটে মাসে একদিন হাট বসে। রংপুরের লোকেরা এক ধরনের সবুজ পাতা শুকিয়ে রেখে দেয়। কালাই ডালের বড়ি বানিয়ে টিনে তুলে রাখে। মংগা ক্ষুধা বন্যা এদের নিত্য সঙ্গী। অভাবের দিলে এসব খেয়ে বেঁচে থাকতে তারা বাধ্য হয়, অভাব শেষ হলে এসবের সাথে গরম ভাত জুটে।

রংপুরের কামরুলের কথা কি কারো মনে আছে ? গংগাচড়ার কামরুল ইসলাম। বিএনপি’র শতভাগ একনিষ্ট কর্মী ও নেতা ছিল। একজন ফেমাস অনলাইন এক্টিভিস্ট ছিল। তার বউ খুব সম্ভব কোনো এক প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার। ছেলেটা অভাবে অভাবে এত বেশি ঋন করে ফেলেছিল যে, পুলিশ প্রায়ই তার মাস্টার বউটাকে থানায় নিয়ে আটকে রাখত। সে কখনো এসব বলেনি। কিন্তু আমি জানি এটাই সত্য। মাত্র ৪৩-৪৪ বছর বয়সেই এসসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক কামরুল হুট করে মরে গেল। সারা বাংলাদেশের কেউ তাকে মনে রাখেনি। অথচ তার মনে সব সময় কিলবিল করেছিল সারাটা বাংলাদেশ।

আমাকে আপনারা মাফ করবেন। আমি দীর্ঘদিন রাজনীতি করে চুরির মতলবে ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, আজ আমি ১০০ টাকা চুরি করার অর্থ সেই রাতে দেশের কেউ না কেউ না খেয়ে ঘুমিয়েছে। আমি খুব জরুরী কথা বলছি। আমার সব জামাকাপড় ফুটপাতের। বিশ্বাস করুন, আমি ভাল আছি। পার্টির প্রয়োজনে যতবার আমি বড় বড় হোটেলে গিয়েছি, ততবারই সেখানকার বয় বেয়ারা দের কাছ থেকে চেয়ে জুতো নিয়ে হোটেলে ঢুকেছি। আমার একটুও লজ্জা লাগেনি। আমি ভয়ে ফরিদপুরের কথা বলছি না।

অন্যান্য জেলাগুলোর নামটা মনে আনছি না। লোকলজ্জার ভয়ে আমরা নিজেদের মধ্যবিত্ত বলি, আমরা আসলে গরীব। মাতাত্মক গরীর। দেশ রাতারাতি ধনী হয়ে যাবে না, শিক্ষার মানটা যদি পঞ্চাশগুন বাড়িয়ে দেয়া যায়, মানসিক দৈন্য দশা অনেকটাই কেটে যাবে। আমাদেরকে কয়েক প্রজন্ম শিক্ষা এবং আয়ে নিজেদের জীবন বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থের প্রবাহ সামষ্টিক না হওয়া পর্যন্ত আমরা গরীব। যে অল্পকিছু মানুষ ধনী সেজে বসে আছে, তাদেরকে আমার মানুষ না ভাবলেও দিন ভালোই যাবে। আমি পরজগতে বিশ্বাস করি। সেখানে আমি সব অপরাধ কবুল করে নেব। তবু মানুষের টাকা চুরি করেছি এ কথা যেন না আসে। আমার প্রভু আমাকে ঠিক এ জায়গাটাতে পরিপূর্ণ অন্ধ রাখুন। আমিন। ইয়া কানাবুদু ওয়া ইয়া কানাস্তায়িন।

লেখক, কলামিষ্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক,
নির্বাহী সম্পাদক, দেশ জনতা ডটকম