লোক দেখানো উন্নয়নের বিজ্ঞাপন দিয়ে ভর্তি থাকে মিডিয়াগুলো এটাই ফ্যাসিজমের বৈশিষ্ট—আবু রুশদ

আপডেট: জুলাই ৬, ২০২২
0

সিনিয়র সাংবাদিক আবু রুশদ বলেছেন , ” আমাদের যে লোক দেখানো উন্নয়ন বা হেডম দেখানোর উন্নয়ন, চটকদার বিজ্ঞাপনে ভর্তি করে রাখে গনমাধ্যমের পাতা কিংবা মিডিয়া হাউজগুলো। এগুলো-ই ফ্যাসিজমের মৌলিক বৈশিষ্ট। শত বছরের নিয়মিত দুর্যোগ দেখেও আমরা এত যে উন্নয়ন করেছি তার ফানুশ দেখা গেল সিলেটের বন্যায়। সমন্বিত ব্যাবস্থাপনার শিক্ষা ও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের উদাহরন কি বাংলাদেশে আছে ? কার্যক্ষেত্রে নাই কোথাও। আর এটাই বাস্তবতা।”

জনপ্রিয় অনলাইন দেশজনতা ডটকমকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন।

## Abu Rushd আবু রুশদ বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক। লেখক, সাংবাদিক রুশদ তার জীবনের দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। লিখেছেন অসংখ্য বই। মানবাধিকার এবং কথা বলার স্বাধীনতা যেখানে রুদ্ধ সেখানেই যোদ্ধা হয়ে দাঁড়িয়ে পরেন সাবেক সেই সেনাকর্তা। জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল ‘দেশ জনতা’র সাথে (https://deshjanata.com ) একান্তে কথা বলেছেন দেশের দূর্যোগ,দুর্ভোগ, সুশাসন, গনতন্ত্রসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়া নিয়ে।
স্বাক্ষাতকারটি গ্রহন করেছেন দেশ জনতার নির্বাহী সম্পাদক ডাঃ জাকারিয়া চৌধুরী।
দেশজনতা ডটকমের পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাতকারটি হুবুহু তুলে ধরা হলো————
প্রশ্ন : কেমন আছেন ?

রুশদঃ কেমন আশা করেন ? নানান রেসট্রিকশান, নানান চাপ, আঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছে। এটাকে যেমন ইচ্ছে ভেবে নিতে পারেন।

প্রশ্ন : কেমন আছে বাংলাদেশ ? সিলেটে বন্যা হচ্ছে। এটা কি স্বাভাবিক বন্যা বলে মনে করছেন ?

সিনিয়র সাংবাদিক আবুস রুশদের সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করছেন ডা. জাকারিয়া চৌধুরী

রুশদঃ হ্যাঁ, সিলেটে বন্যা হচ্ছে। বাংলাদেশ কেমন আছে সে এক মস্ত প্রশ্ন। আপনি জানতে চেয়েছেন, সিলেটের বন্যা স্বাভাবিক কিনা ! আমি মনে করি, ভারতের চোখ দিয়ে দেখলে এটাই স্বাভাবিক। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদী ৫৪ টি। সেগুলোও যখন উপচে পরে তখন যা হবার তাই হয়। তারা তাদের দেশে বন্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করবে কোন কারনে ? তারা তাদের জাতিকে রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন তাই করে। দুনিয়ার সবাই এটা-ই করে।

প্রশ্ন : তাই বলে একটা জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া আর নিজের জাতিকে রক্ষা একই সাথে দুটি বিষয় কি নৈতিক ?


রুশদঃ

এটা দুনিয়ার সব রাষ্ট্র-ই কাছে দুর্বল রাষ্ট্রেকে বিভিন্নভাবে ডমিনেট করতে চায়। দেখুন, বর্ষাকালে ভারত সব সময়েই তাদের অতিরিক্ত পানি ড্রেনেজ করে দেয় আমাদের মত ভাটির দেশে। এখন ভাটির দেশ যদি এতোকাল বন্যা মোকাবেলা করতে পারে এবার পারছে না কেন ? সেটা ভাবুন। অতীতে দেখা গেছে,এই পানি সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা হয়ে ময়মনসিংহের হাওড় গুলো ভরাট হয়ে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই নেমে যেত। এবার সেটা যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না ? কারন আমরা ইটনা-মিঠামাইন ধরে যে রাস্তা নির্মান করেছি, সেটা এখন বন্যার পানি চলার পথে ফাঁস হয়ে দাড়িয়েছে। বন্যাকে দীর্ঘমেয়াদি করতে এই একটা রাস্তা বা বাধ-ই যথেষ্ট। তিস্তার গজলডোবা বাধ খুলে দিলে উত্তরাঞ্চল ভেসে যাবে। সমস্যা যা হবে তা হবে আমাদের। এই সমস্যা মোকাবেলার সাহস আমাদের নেই। অথচ সাউথ এশিয়ার অন্য কোন কান্ট্রি ভারতের হাতে এভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে না। দেশপ্রেম সব জাতিগোষ্ঠীতেই আছে।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কিন্তু আপার ডেল্টার দেশ নয়, এটি লোয়ার ডেল্টায় অবস্থিত। পানির স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি অনুযায়ী এটি লোয়ার ডেল্টার দিকেই মুভ করে। এটা ন্যাচার…… আমরা বন্যা মোকাবেলায় এমন কোন কোন প্রস্তুতি আমাদের আছে ? ভারত কি করল সেটা নিয়ে কান্নাকাটির চেয়ে ভাবুন আমাদের এত অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রস্তুতি নেই কেন ? বা থাকলেও তা কতটুকু??

প্রশ্ন : এভাবে উদ্দেশ্যমুলকভাবে পানি ছেড়ে দেয়া, অভিন্ন নদীতে বাধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি শুণ্য করে ফেলা আন্তর্জাতিক নদী আইন কি বলে ?

রুশদঃ লংঘন তো আছেই। তারপরও মানুষ করে। এর প্রেক্ষিতে নেপাল কি করেছে ? ভুটান এমনকি মালদ্বীপও ভারত খেদাও আন্দোলন করছে।

প্রশ্ন : যে সিন্ধু নদী ভারত থেকে সরাসরি পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে ভারত সেটির উজানে বাধ দেয়ার চেষ্টা করেছিল । আপনার মনে আছে নিশ্চয় !

রুশদঃ
হ্যা। পাকিস্তান সেটি কাউন্টার করে ঠেকিয়ে দিয়েছে। আমরা তো কাউন্টার করি না। একমাত্র জেনারেল জিয়ার সময় আমাদের গংগা বাধ দেবার কথা ছিল। সারা দেশব্যাপী খাল খননের মত যুগান্তকারী কর্মসুচী হাতে নিয়েছিল। এর ইম্পপ্যাক্ট হয়েছে বহুদুর। এর মাধ্যমে দেশের বিরাট অংশে সেচ সুবিধার আওতায় এসছে তারচে বেশি দ্রুত গতিতে বন্যার পানিকে নদীর মাধ্যমে নিষ্কাষন করে সাগরে নিয়ে গেছে। জিয়ার আমলে বন্যায় মানুষ ভেসে যায়নি…… আমরা হচ্ছি আবেগী জাতি। ধরলাম এইটা অবৈধ …এখানে আমাদেরকে বুঝতে হবে ভারত তার নিজের স্বার্থ-ই আগে দেখবে। আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ শুরুর বহুকাল আগে থেকেই বন্যায় হাজারো লাশ ভেসে যাওয়ার ভুরি ভুরি উদাহরন এখানে আছে। হয়েছে টা কি ? ভারত কি সেজন্য মাফ চেয়েছে ?

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন ভারত যদি এ সমস্যায় পড়ত তাহলে তারা কিভাবে তা সামাল দিত। ভারত এ সমস্যা ফেস করছে তো ! চীন উজানে ব্রক্ষ্মপুত্রে বাধ দিতে চায়, ভারত সেটা ঠেকিয়ে দেয়। তারা জাতিসংঘে চীনের বিরুদ্ধে হইচই হেলে দেয়। আমরা কি সেটা খেয়াল করি ? বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৪ সালে ফারাক্কার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এবং এ ভাষনের কারনে ধরা হয় খালেদা জিয়া ভারতের বিরাগভাজন হয়েছিলেন

প্রশ্ন : সিলেটে দুটো উন্নয়ন প্রকল্প চলমান ছিল। এগুলোকে ভারত ভালো চোখে দেখবে না বলে ভাবা হয়। এ বন্যা একটা ফ্ল্যাশ আউট প্রকল্প…… আপনি কি এভাবে চিন্তা করেন ?

রুশদঃ
সেইভাবে ভাবার দরকার নেই। আপনি বরং এর অন্য দিকটা দেখেন। আমাদের যে লোক দেখানো উন্নয়ন বা হেডম দেখানোর উন্নয়ন, চটকদার বিজ্ঞাপনে ভর্তি করে রাখে গনমাধ্যমের পাতা কিংবা মিডিয়া হাউজগুলো। এগুলো-ই ফ্যাসিজমের মৌলিক বৈশিষ্ট। তারা কি করে ! তারা চটকদার কিছু উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে চায়। রাত আটটায় দোকান শপিং মল বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ আসে বিদ্যুত সাশ্রয়ের কথা বলে। আবার ঢাকাল ল্যাম্পপোষ্ট গুলোর দিকে তাকানা। দেখবেন সারি সারি ঝাড় বাতি পেচিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো সারারাত জ্বলে… এর ফায়দা কি ? এটাকে কি উন্নয়নের কোনও ক্লজে ফেলা যাবে ? উন্নয়ন হতে হবে টেকসই। সাসটেইনেবল উন্নয়ন যাকে বলে। এ বন্যায় নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে, আমাদের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কোন লেভেলের !! আজকে আল্লাহ না করুন, ঢাকায় একটা ভুমিকম্প হোক। দেখবেন এই অন্ধের দেশে চশমা বিক্রির উন্নয়নের আফটারম্যাথ। আহত নিহতদের উদ্ধারে বছরের পর পর বছর লেগে যাবে। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের জন্যে আমরা কি কম সময় পেয়েছিলাম ! মোটেও না। অথচ তাজরিন গার্মেন্টস, রানা প্লাজার মত ভয়াবহ ট্যাজেডিকেও উন্নয়ন চমক আর কথার ফুলঝুরি দিয়ে দাবিয়ে রাখা হয়েছে।বন্যা, যে জিনিসটার মুখোমুখি হয়ে আসছি শত শত বছর ধরে সেখানে আজকে হলেও আমাদের জানার প্রয়োজন রয়েছে এসব জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি আসলে কতদুর ! আমার তোমনে হয় বন্যাকে আমরা চিরস্থায়ী করে ফেলেছি।


প্রশ্ন : এখন যদি প্রতি বছর সিলেট একবার করে ডুবে অথবা ঢাকায় পানি লকড হয়ে যায় তখন এর সমাধান কি হবে ?


রশিদ :
এই যে সিলেটের বন্যায় সেনা নিয়োগ হল। সেখানে শুরুতেই দেখা গেল সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় র‍্যাফট নেই। সেনাবাহিনী অতি উপদ্রুত এলাকায় যেতে পারছে না। আরে বাবা, আর্মির শান শওকত দেখানোর আগে তাদের হাতে যদি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট টুলস না থাকে তাহলে তো খুব বেশি কাজে তারা আসতে পারছে না। নৌ বাহিনীও এলো, সমস্যা কমল না বরং প্রকট হলো। তারপর কি হলো ! বিমান বাহিনী এসে এখানে সেখানে খাদ্য ফেলল। কেউ পেল তো বস্তা, বস্তা কারো মাথায় পড়ল !! শত বছরের নিয়মিত দুর্যোগ দেখেও আমরা এত যে উন্নয়ন করেছি তার ফানুশ দেখা গেল সিলেটের বন্যায়। সমন্বিত ব্যাবস্থাপনার শিক্ষা ও কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের উদাহরন কি বাংলাদেশে আছে ? কার্যক্ষেত্রে নাই কোথাও। আর এটাই বাস্তবতা।


জাকারিয়া :
সাক্ষাতকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

আবু রুশদ :আপনাকেও ধন্যবাদ