শরৎ তুমি নীলিমা-প্রিয়ার নীলা অবগুণ্ঠনে ঢাকা

আপডেট: আগস্ট ২২, ২০২১
0

ডেস্ক রিপোর্ট :
বর্ষা শেষ। নীল আকাশে উড়ছে পেঁজা পেঁজা তুলো। মাঠে ঘাটে জনপদ এমনকি শহরেও ভেসে যায় রোদ্র -ছায়ার খেলা। গাও-রোমে ছাতিম ফুলের গন্ধ চড়িয়ে পড়েছে দূর-দিগন্তে। কোথাও কোথাও আকাশ ছোঁয়ানো ধানক্ষেত. ধানের গর্ভে দুধ জমা হয়েছে। শরতের আকাশে ভাসে স্বপ্নরা্ ।

শরৎ থেকে বিমোহিত রং ছিটকে পড়ে কবিদের মনেও। কবিও শরৎ থেকে রং তুলে আঁকতে চান কবিতার শরীর অথবা শরৎকে দিতে চান আরো একটি অলংকার পরিয়ে। যেন দেবলীনার রূপের মতো ফোটে ওঠে শরতের মিহি রূপ; না হয় কবিই যেন শরতের রূপে হয়ে উঠতে পারেন দুধে ধোয়া এক ধবল মানব। তাই তো দাবানলের মতো তেজি আর ইস্পাতের মতো মজবুত বিদ্রোহী কবিও মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেননি শরতের শুশ্রী থেকে। আপ্লুত হয়ে রয়েছেন—

কোথাও কাশবন মেঘে মেঘে সাদা কোথাও বুনো ফুলের সমাহার

‘কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে/হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে/তৃতীয়া চাঁদের ‘শাম্পানে’ চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া/আকাশ-দরিয়া উতলা হলো গো পুতলায় বুকে নিয়া/তৃতীয়া চাঁদের বাকি ‘তেরো কলা’ আবছা কালোতে আঁকা/ নীলিমা-প্রিয়ার নীলা ‘গুল রুখ’ অবগুণ্ঠনে ঢাকা। (চাঁদনি রাতে, কাজী নজরুল ইসলাম)

রোদের ফাঁকে ফাঁকে ধূসর মেঘ উঁকি দিতে চায় শুরুর দিকে, ভয় দেখিয়ে ঝপাৎ করে নামতে চায় দুই-এক আজলা ফোঁটা। গুড়গুড় ডাক দিয়ে অকারণ মাতায় ভাদ্র মাস। কবিও রসিকতা করে লেখেন তার ছেলেখেলা

রোপা আমনের ক্ষেত

“ঘন কালো মেঘের আঁধার একটু হাসে একটু কাঁদে/রোদের সাথে লুকোচুরি খেলাটা বেশ জমিয়ে তোলে/এই যে এখন মনটা ভালো/কখন কী হয় সবাই ভিতু-এমনই যে শরৎ ঋতু।” (একটু হাসে একটু কাঁদে, আলাউদ্দিন আল আজাদ)

শরৎ যেন একটু বেখায়ালি। একটু চটপট। কখন কী করে বুঝে ওঠা যায় না। না হয় হয়তো ভুলতে পারে না সঙ্গের বোনকে। না হয় মাত্র বর্ষা পেরিয়ে আসা প্রকৃতি ভুল বসতই ঝরে যেতে চায় একটু-আধটু। স্বভাব বসত। এই দুই রূপ টানাটান শরৎও বেশ আনন্দের সুর লাগিয়ে দেয় কবি মনে। কবি পুরনোকে ধরে না। নতুন নিয়ে মাতে সুখে উল্লাসে। হঠাৎ দেখা চরিত্র তুলে রাখে পেনসিল খোঁচায় খাতার ভাঁজে—

“শরৎ এলো কী উল্লাসে কাঁপছে নদীর জল/পাখনা মেলে বেড়ায় খেলে প্রজাপতির দল!/ বাজল কাঁসর সাজল আসর চলরে সবাই চল/মন-গালিচায় বন গালিচায় নামল খুশির ঢল!!” (ভবানী প্রসাদ মজুমদার, শরৎ এলো কী উল্লাসে)

বিকেলের সোনালী রোদ্দুর ঢাকা শহরের বুকে

শরৎ এক অপূর্ব শ্রী ধারণ করে আসে শান্ত-স্নিগ্ধ-কোমল রূপ নিয়ে, যেখা নেই কোনো মলিনতা, আছে কেবল নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছাস। কী অপূর্ব রঙের খেলা, কী অপূর্ব মায়াবী রঙিন ভুবন সাজায় প্রকৃতি শরতের কালে, তা চোখে না দেখলে তার চিত্রপট কল্পনায় আঁকতে অপারগ যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকরও। শরতের নিজস্ব রূপবিন্যাসে সোনালি রোদে ধোয়া কুটির, খোলা হাওয়ায় কাশবন, নদীর তরঙ্গ-সবই যেন হয়ে অনন্যময়। তবে কি তার কোনো দুঃখ নেই? তারও আছে কিছু। কবিই তা দেখেন সব চোখের অতলে অন্য এক চোখ দিয়ে—

‘তুমি তোমার অসম্বৃত যৌবনকে ঢেকে রাখো/পর্দার মতো একখন্ড মেধের আড়ালে।/তুমি তোমার রূপসী চাঁদকে অনুপস্থিত রাখো,/ হে শরৎ, তুমি তোমার উদ্ধত সূর্যের উত্তাপে/নির্মল ঝিলের স্রোতগুলো আকাশে মিলিয়ে দাও;/আর আমি স্মৃতির দংশন থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচি।’ (শরৎ, নির্মলেন্দু গুণ)

তুলোর মতো থোকা থোকা সাদা মেঘ-সারি বেঁধে উড়ে যায় এক গাঁও থেকে আরেক গাঁয়ে, এক নগর থেকে আরেক নগরে, পানার মতো ভেসে চলা এ যে বক-পালক আহ্। কোদালি আকাশ জাল বিছিয়ে নিড়ান দেওয়া মাঠের মতো। তার ফাঁকে ফাঁকে সাহসী সূর্যটা কখনো হেসে উঠে কখনো মন ভার করে আড়াল হয় সাদা মেঘের আড়ালে—

“আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে/কী জানি পরান কী যে চায়!/ওই শেফালি শাখে কী বলিয়া ডাকে/বিহগবিহগী কী যে গায়!/আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে,/রহে না আবাসে মন হয়!/ কোন্ কুসুমের আশে কোন্ ফুলবাসে/সুনীল আকাশে মন ধায়!/আজি কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই/জীবন বিফল হয় গো/তাই চারিদিকে চায়, মন কেঁদে গায়—/‘এ নহে, এ নহে, নয় গো।”… (আকাঙ্ক্ষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

নদীর চর, বালুময় উদ্যান, ধুধু অঞ্চলজুড়ে কাশবন। নদীতে তরঙ্গ। উদাস কিশোর ঘাটের কাছে দাঁড়ায় ভাবুক মনে। জলে ঢেউ, মনে বাতাস। অবসর আসে অফুরান কাজের পরে। হোগলা পাতার কোলে হেলান দিয়ে কবি মন গাছের পাতায় লেখে না জানা কত শত কথা ব্যথা স্মৃতি। রাতের উজ্জ্বল আকাশ তলে কল্প আবেশে ওড়ে ওড়ে আসে কত না ছোট-বড় ভাবনা …

“শিউলি ফোটা-ভোরবেলার মতো শরৎকাল/সন্ধ্যা আকাশ/এই আকাশখানিরে ভালোবেসে আমার দুচোখ/ঝাপসা হয়ে আসে; কত শৈশব/কত শিউলি ফুলের মালা গাঁথা/কত নদীর জীবনীপাঠ,/আমি খুঁজতে খুঁজতে কোনো বিষাদ অরণ্যে হারিয়ে যাই।/সেখানে সাদা মেঘের চিত্রকলা, অক্ষরের মতো/শিশির বিন্দু/আমি চোখ ফেরাতে পারি না, মন ফেরোতে পারি না/ কড়জোর দাঁড়িয়ে থাকি;” (শরৎ সন্ধ্যার সংবেদনা, মহাদেব সাহা)

সতেজ শরৎকালের মোহনীয় রূপবৈভবে আছে বাঙালির প্রাণের বাঁশি। এ বাঁশির সুরে আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হয় উদার মুক্তির আহ্বান। বাঁধন ছিঁড়ে অফুরান সৌন্দর্যে ভেসে যেতে চায় মন। বৃষ্টির গৃহবন্দি জীবনের অবসান ঘটিয়ে অন্তরে-অন্দরে মূর্তমান হয় শরৎকাল। শরৎ যেন জননী জন্মভূমির রূপসী মানসকন্যা। বাংলার প্রাণের প্রতিমা।

লেখা : ডেস্ক রিপোর্ট, ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত