‘শয়তান নারীদের জন্য ঘরের কাজকে ছোট করে দেখাতে চেষ্টা করে’

আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১
0

হযরত উমার (রাযি.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মেয়েদের মসজিদে আসতে বাধা দিও না। যদিও তাদের ঘর তাদের জন্য উত্তম”।

শাইখ আল আলবানী আবু দাউদ এবং আহমাদের এই হাদিসটি সহি বলেছেন! এই হাদিসের ব্যাখ্যা তাহলে কি দাঁড়াবে? পুরা দুনিয়াই যদি ঘর হয়, মসজিদ তাহলে কোথায়? আউটার স্পেস এ?!! আল্লাহু আকবার!

হিজাবী ফেমিনিস্টরা অনেক সময় মেয়েরাও যে কোন অংশে কম না, মেয়েদের নানামুখী কাজের উদাহরণ দিতে যেয়ে হযরত খাদিজা (রাযি.)এর ব্যবসার উদাহরণ, হযরত আয়েশা (রাযি.)এর ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধের, উদাহরণ টানেন। আমরা উত্তেজিত হই! কিন্তু কোন প্রেক্ষাপটে তারা এটা করেছিলেন সেটার দিকে নজর দেই না! জানতেও চাই না! রাসূল (সা.)এর সময়ে মেয়েরা এমন কি নামাজে ইমামতিও করেছেন বলে, উম্মু ওয়ারাকার উদাহরণ টানেন এই প্রসংগে! আমরা আবারো উত্তেজনায় ওয়াহ ওয়াহ করি। অথচ এই হাদিস অনেক উলামা দুর্বল বলেছেন। যারা সহি বলছেন তারাও এ ব্যাপারে একমত, ঘরে তারা সবাই মহিলা ছিলেন।

উলামাদের মতে উম্মু ওয়ারাকাহ এমন এক সময়ের নারী সাহাবী ছিলেন যখন হাতে গোনা কয়েকজন ছিল যাদের পুরো কুরআন মুখস্থ ছিল। তখনও পর্যন্ত কুরআন কোথাও লেখা হয়নি। তিনি তার নিজ পরিবারে সালাহ পড়িয়েছেন, যেখানে শুধু মহিলারাই ছিলেন। তিনি পাব্লিক প্লেস এ বা পুরুষদের উপস্থিতিতে ইমামতি করেননি। ইবন সা’দ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম তাঁকে বদরের যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেননি। তিনি শহীদের মর্যাদা পেয়েছিলেন যুদ্ধ করার জন্য নয়, বরং তার ঘরে সালাহ প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের জন্য।

ইমাম ইবনু হাযম রহিমাহুল্লাহ বলেন, এটাই একজন মানুষের দ্বীনদারী ও আল্লাহভীতি কমতি থাকার আলামত যে, সে মাসআলার ক্ষেত্রে এমন মত খোঁজে, যা তার খাহেশ অনুযায়ী হয়।”

আমরা তো দুনিয়াবী সব কিছুতে বেস্টটাই খুঁজি। এখন নারীদের ভেতর একটু বেস্টদের দিকে নজর দেই।

যারা দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত নারী, তারা কিন্তু কেউ জিহাদ/যুদ্ধ করেননি বা এই কারণেও দুনিয়াতে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়ার মর্যাদা পাননি!

হযরত ফাতিমা (রাযি.) ছিলেন আল্লাহর রাসূলের অত্যন্ত আদরের সন্তান। তিনি বলেছিলেন, ফাতিমা আমার দেহের অংশ, সে যাতে খুশি হয় আমিও তাতে খুশি হই। সে যাতে কষ্ট পায়, আমি তাতে কষ্ট পাই। তিনি ছিলেন দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত! চার সর্বশ্রেষ্ঠ নারীদের একজন, জান্নাতে হবেন নারীদের কর্ণধার! সুবহান আল্লাহ!! অথচ ফাতিমা (রাযি.) একাই সব কাজ সম্পাদন করার চেষ্টা করতেন। যাঁতা ঘুরাতে ঘুরাতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিল। মশক ভর্তি পানি টানতে টানতে বুকে দাগ পড়ে গিয়েছিল! রাসূল (সা.)এর কাছে যখন তার প্রাণপ্রিয় মেয়ে ফাতিমা ঘরের কাজের জন্য সাহায্যকারী চাইলেন, তিনি বলেছিলেন আমি তোমাকে এর চাইতে উত্তম কিছু শিখিয়ে দিই। তিনি চাইলে ১ জন না ১০ জন খাদেম দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি তাসবীহ শেখালেন..। কিন্তু এই অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ টানতে কেন যেন আমাদের ভাল লাগে না।

হযরত উম্মুল মু’মিনীন খাদিজা (রাযি.) ছিলেন অসম্ভব বুদ্ধিমতি। তার বাবা ছিলেন কুরায়িশ বংশের একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি তার বাবার ব্যবসায়ী দক্ষতা পুরোটাই পেয়েছিলেন। সেময়ে পুরুষ শাসিত সমাজে একজন মেয়ের পক্ষে ব্যবসা চালয়ে যাওয়া যথেষ্টই কঠিন ছিল।

বাবা মারা যাবার পর ব্যবসার ভার কাঁধে নেন এবং লোক লাগিয়ে সফলভাবে সেই ব্যবসা পরিচালনা করেন। কিন্তু সে সবই তাঁর (রাসূল সা.)এর সাথে বিয়ের আগে এবং ইসলামে আসার আগের কথা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে বিয়ের পর উভয়ের সম্মতিতে ব্যবসা ছেড়ে দেন এবং সব দান করে দেন। এখনকার সময়ে হলে হয়ত আমরা বলতাম, “এত ভাল ব্যবসা জানে, ছেড়ে দিয়ে কি ভুলটাই না তারা করল!! এত মেধা ভাল উদ্যোক্তা হতে পারত! কত লোকের কর্মসংস্থান হত!! আর বেশি বেশি সাদাকা করতে পারত!! ইসলামের তো উপকারই হত!!”

অভিজাত পরিবারে বিলাসিতায় বড় হওয়া খাদিজা (রাযি.) অত্যন্ত কষ্টের জীবন বেছে নেন। সংসার জীবনের আর্থিক কষ্ট তিনি খুবই ধৈর্য এবং সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেন। তাঁর পারিবারিক আভিজাত্য নয়, ব্যবসায়ী দক্ষতা এবং সফলতা নয়, তাঁর চরিত্রের মাহাত্ম্য, ধৈর্য এবং আচরণ আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা’লাকে সন্তষ্ট করে।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ( রাযি.) ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী এবং ইলমে পারদর্শী নারী। বলা হয়ে থাকে, শরীয়ার এক চতুর্থাংশ জ্ঞান তাঁর মাধ্যমেই এসেছে। রাসূলের সান্নিধ্যে থাকার ফলে তাঁর তাফসীর জ্ঞান তখনকার ইমামদেরও ধারণার ঊর্ধ্বে ছিল। হযরত আয়েশা (রাযি.)এর শান্তির “ঘরই” ছিল হাদিসের প্রথম দারস কেন্দ্র। তার জ্ঞান ছিল সরাসরি কুরআন এবং সুন্নাহ নির্ভর! দুই হাজারেরও বেশি হাদিস তিনি বর্ণনা করে গেছেন। যদি রাসূল(সা.)এর সাথে বিভিন্ন মাহফিলে উপস্থিত থাকতেন, তাহলে আরো বেশি হাদিস হয়তো পাওয়া যেত। তিনি বেশিরভাগ সময় ঘরেই কাটাতেন। পর্দার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও যত্নবান ছিলেন। এমনকি অন্ধ ব্যক্তির সামনেও পর্দা ছাড়া যাননি। একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে হযরত উসমান (রাযি.) হত্যার বিচার চেয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন, যেটা ইতিহাসে উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

জ্ঞানের দিক থেকে হযরত আয়িশা (রাযি.) তখনকার সব নারীদের চেয়ে তো বটেই, বরং অনেক সাহাবাদের থেকেও এগিয়ে ছিলেন। আবার দুনিয়াতে জান্নাতের সংবাদ পাওয়া জান্নাতি নারীদের ভেতর শ্রেষ্ঠত্বে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সকলের জীবনই ছিল আল্লাহমুখী, আখিরাতমুখী।

আমরা দ্বীনের শিক্ষা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি না নিজেদের ইগোর কারণে। শব্দগুলো মুখের ভেতরেই নড়াচড়া করে অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে না।

কেউ কেউ বাইরে কাজ করাটাকেই জীবনের স্বার্থকতা বলে মনে করতেই পারেন। কিন্তু শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করে নিজের ইজ্জত-আব্রুকে নিরাপত্তাহীন করে ঢালাওভাবে সবার জন্য সেটা প্রযোজ্য নয়- এটা বুঝতে হবে। একের জন্য হয়ত কাজটি ফরযে কিফায়া, আরেকজনের জন্য নয়! এখানে এনভায়রনমেন্ট হালাল হারাম এর প্রশ্নও আছে! আমার প্রধান দায়িত্বটি আমি অবহেলা করছি কিনা এটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।

বাইরে কাজ না করেও কারো জ্ঞানের পরিধি, হিকমা অনেক বেশি থাকতে পারে। শয়তান আমাদের চোখে ঘরের কাজকে ছোট করে দেখাতে চেষ্টা করে, এটা তার মিশনেরই একটা অংশ। কারণ, এই কাজের ভেতরে আল্লাহ বারাকাহ রেখেছেন। আবার ইলম শিক্ষা প্রত্যেকের জন্য ফরয। ঘরে থেকেই কেউ যদি হযরত আয়িশা (রাযি.)এর মত ইলম অর্জন আর ইবাদাতে সময় ব্যয় করতে চেষ্টা করে, তাহলে সে একসাথে ৫ জন শ্রেষ্ঠ নারীকেই অনুসরণ করল। আমরা বাইরে কাজ করলাম কি করলাম না সেটার চাইতে এটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের ভেতর ইলম চর্চা আছে কিনা, আমরা আখিরাতমুখী কিনা!! বাইরে কাজ করা না করা নিতান্তই একটা দুনিয়াবি বিষয়।

তর্কে অনেকেই পটু, আমার স্বল্প জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা দিয়ে তাদের জ্ঞানের গভীরতা মাপা আমার আয়ত্তের বাইরে। তবে শয়তান কিন্তু জ্ঞানীদেরকে জ্ঞানের মাধ্যমেই ধোঁকা দেয়! দিন শেষে গন্তব্য জান্নাত নাকি জাহান্নাম সেটাই আসল।

বুখারীর একটি হাদিস মনে পড়ছে, “হযরত উম্মে সালামা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীত অবস্হায় ঘুম থেকে জেগে বলতে লাগলেন, সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ তাআলা কতই না খাযানা নাযিল করেছেন আর কতই না ফিতনা অবতীর্ণ হয়েছে। কে আছে যে হুজরাবাসিনীদেরকে জাগিয়ে দেবে, যেন তারা সালাত আদায় করে। এই বলে তিনি তার স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্য করেছিলেন। তিনি আরও ইরশাদ করলেন, দুনিয়ার মধ্যে বহু বস্ত্র পরিহিতা পরকালে বিবস্ত্রা থাকবে”।

কোন রকমে ঈমান রক্ষা করা এই উম্মাহকে আল্লাহ আযযা ওয়াজাল সমূহ ফিতনার হাত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

সূত্র: উম্মাহ