সরকার হবে জাতীয় ঐকমত্যের : যুগপৎ আন্দোলনের ৩১ দফা খসড়া রূপরেখা

আপডেট: মে ৩০, ২০২৩
0

-প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে
-পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন নয়
-বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না
-বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ বাতিল করা হবে, থাকবে সবার জন্য স্বাস্থ্যকার্ড, সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসন
-স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে

সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ৩১ দফা যৌথ রূপরেখার একটি খসড়া তৈরি করেছে বিএনপি। ক্ষমতায় গেলে এই দফাগুলোই হবে ‘রাষ্ট্র মেরামত ও পুনর্গঠনের’ পাণ্ডুলিপি। গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোটসহ অন্যান্য জোট ও দলগুলোর মত নিয়ে এই খসড়া শিগগিরই চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। খসড়া রূপরেখায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। ঐকমত্যের ওই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে গ্রহণ করবে নানা পদক্ষেপ।

জানা গেছে, খসড়া রূপরেখার প্রথম দফায় সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে। যে কমিশন সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করা হবে গণভোট ব্যবস্থা।
তৃতীয় দফায় ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ দফায় রয়েছে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি।

পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।
ষষ্ঠ দফায় ‘উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন, সপ্তম দফায় আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে জড়িত এমন সব বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার বিষয়টি বলা হয়েছে। অষ্টম দফায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২, সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি বলা হয়েছে- ইভিএম নয়, সব কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।

দশম দফায় বাংলাদেশের সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা করার কথা বলা হয়েছে। বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য গঠন করা হবে একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত ‘বিচারপতি নিয়োগ আইন’ প্রণয়ন করা হবে। এর পরের কয়েকটি দফায় ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ ও ‘মিডিয়া কমিশন’ গঠন, আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ সংশোধন, বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে।
খসড়া রূপরেখায় সংবিধান অনুযায়ী ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সব ব্যক্তিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সুবিচার নিশ্চিত করা ও ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করার কথা বলা হয়েছে।

১৬ দফায় রয়েছে, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার, ১৭ দফায় মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমিকদের (প্রাইস ইনডেক্স বেইজড) ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, ১৮ দফায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল, ১৯ দফায় বৈদেশিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই দফা আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না।

২২ দফায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে।
২৫ দফায় রয়েছে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করার প্রতিশ্রুতি। ২৬ দফায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ও ‘বিনা চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু নয়’ এই নীতির ভিত্তিতে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হবে। জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হবে।

এর পরের কয়েকটি দফায় বলা হয়েছে, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। রফতানিমুখী কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প খাতকে প্রণোদনা দেয়া হইবে। দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সারা দেশে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট ও ক্ষতি মোকাবেলায় টেকসই ও কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতকে বৈশি^ক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মহাকাশ গবেষণা ও আনবিক শক্তি কমিশনের কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক সুযোগ সমৃদ্ধ করা হবে।

সর্বশেষ ৩১ দফা বলা হয়েছে, এক জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে শহরে ও গ্রামে কৃষিজমি নষ্ট না করে এবং নগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ হ্রাস করে পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়ণের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিত করা হবে

জানা গেছে, বিএনপি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই ৩১ দফা রূপরেখা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঘোষিত ‘১৯- দফা’, বেগম খালেদা জিয়ার ঘোষিত বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’ এবং তারেক রহমানের ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচির আলোকে প্রণয়ন করেছে। এর পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চ ও আন্দোলনে থাকা আরো একাধিক জোটের প্রস্তাবগুলোও এক্ষেত্রে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। বিএনপি ইতোমধ্যে কয়েকটি জোটের সাথে এই খসড়া রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেছে। অন্যান্য জোটের সাথেও আলোচনায় বসবে দলটি। এরপর তা চূড়ান্ত রূপ দেয়া হবে। জানা গেছে, এই রূপরেখা চূড়ান্ত হলে যুগপৎ আন্দোলন আবারো মাঠে গড়াবে।

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফার ভিত্তিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন শুরুর আগে রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারে গত ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপি। তবে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র প্রয়োজনীয়তা সামনে চলে এলে তা নিয়ে কাজ শুরু করে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরীকরা। যা এখন পরিসমাপ্তির দিকে এগোচ্ছে বলে দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, শিগগিরই রূপরেখা চূড়ান্ত করা হতে পারে। তবে এখন দফা একটাই। তা হলো পরিবর্তন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিশ্বাসী সকল দলের এখন সেই দফায় সরাসরি চলে যাওয়া উচিত।

মানবজমিন