সাংবাদিক নিপীড়ক মন্ত্রী-আমলাদের যত নথিপত্র

আপডেট: মে ২০, ২০২১
0

সোহেল সানি

আজ যা ঘটে কাল তা ভুলে যাই। তাই বিদেশী পর্যটক বা ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন গ্রন্থে বাঙালিদের অভিহিত করেছেন ‘আত্মবিস্মৃত জাতি রূপে।’ সাংবাদিক সহযোদ্ধা নির্যাতিতা রোজিনা ইসলাম ইস্যুটিও দ্রুত ভুলে যাবো। আমরা জানি বন্দীদশাও নিঃসন্দেহে একটি নিপীড়নমূলক শাস্তি। সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম যা ভোগ করছেন। জেলবন্দীর প্রারম্ভে পদস্থ নারী আমলা কাজী জেবুন্নেসার হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। সাংবাদিক সমাজ শুধু নয়, সর্বমহল থেকে নিন্দা ও প্রতিবাদ হচ্ছে। এটা আশার কথা। কিন্তু এই চিত্রটি আমাদের অস্থিমজ্জা থেকে উধাও যাবে।

শুধু উধাও হবে না রোজিনার মন থেকে। যেমন আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলেও রোজিনার পরিণতিতে অতীতের লোমহর্ষক স্মৃতির আয়নায় নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেছেন, সাংবাদিক আমিনুর রহমান তাজ, আনিসুর রহিম আর তপন বিশ্বাসের মতো অনেকেই। যারা সরাসরি মন্ত্রী কর্তৃক নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আজকের কাগজের আমিনুর রহমান তাজকে দুর্নীতির রিপোর্ট করতে গিয়ে জেলখাটা শুধু নয়, চাকুরিহারা হতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন আমিনুর রহমান তাজ। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে জনকণ্ঠের সাংবাদিক তপন বিশ্বাসকে নিজ কামরায় বেদম প্রহার করেছিলেন প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোজাম্মেল হোসেনের হুকুমে সাংবাদিক আনিসুর রহিমকে বেদম প্রহারের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। ২০০০ সালের ২৮ অক্টোবরে দৈনিক যুগান্তরে “মন্ত্রীর হুকুমে সাংবাদিক প্রহার” শীর্ষক সম্পাদকীয়টির শুরু হয়েছিল এভাবে-
“কি করিয়া হুকুম তামিল করাইতে হয় তাহার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করিলেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোজাম্মেল হোসেন।

তিনি সাংবাদিকদের পিটাইয়া হাড়গুঁড়া করিয়া ফেলিবার নির্দেশ প্রদানের ৩৬ ঘন্টার মধ্যে দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্র- এর সম্পাদক আনিসুর রহিমকে বেদম প্রহার করা হইয়াছে। দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে দেবহাটার চেয়ারম্যান আনিসুল হকের নেতৃত্বে ১৫/২০ জন সন্ত্রাসী প্রেসক্লাবে ঢুকিয়া সাংবাদিক আনিসুর রহিমকে খোঁজ করে। সেইখানে তাহাকে না পাইয়া সন্ত্রাসীরা দৈনিক সাতক্ষীরা চিত্রের অফিসে যায় এবং অফিস ভাংচুর করা ছাড়াও আনিসুর রহিমকে পিটাইয়া আধমরা করিয়া বীরদর্পে চলিয়া আসে। এই ঘটনার মধ্য দিয়া প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল ডাক্তার প্রমাণ করিলেন যে তিনি যাহা বলেন তাহা করিয়া ছাড়েন। এই ব্যাপারে তিনি যে লক্ষ্মীপুরের তাহের চেয়ারম্যান অপেক্ষা একধাপ আগাইয়া রহিয়াছেন ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। একজন মন্ত্রীর সহাস্য উপস্থিতিতে তাহের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের হাত-পা ভাঙিয়া মেঘনা বক্ষে নিক্ষেপ করিবেন বলিয়া হুংকার ছাড়িয়াছিলেন। এই হুংকার কার্যকর হইবার পূর্বেই মোজাম্মেল বাহিনী সাংবাদিক পিটানো শুরু করিয়া দিয়াছে। একের বাহুবল অন্যকে উৎসাহিত করে।

সাংবাদিক সম্পাদকদের অন্তত বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সাধুভাষার এই সম্পাদকীয়টি যুগান্তরের তৎকালীন সম্পাদক প্রয়াত গোলাম সারওয়ারের নিজের লেখা। কি কারণে তাঁর নামটি এসে গেলো, সেই প্রসঙ্গের অবতারণার আগে সম্পাদকীয়টির পরবর্তী লাইনটির সংযোগ স্থাপন করে দিচ্ছি। তাতে বলা হয় যে, ” মোজাম্মেল বাহিনীর ‘সাফল্যে’ উৎসাহিত হইয়া তাহের বাহিনী মাঠে নামিয়া পড়িলে মেঘনা নদীর তলদেশে কোনও সাংবাদিকের অন্তিম শয্যা রচিত হওয়া অসম্ভব নহে। প্রতিমন্ত্রীর প্রথম নির্দেশ পালিত হওয়ায় আমরা ধরিয়া লইতে পারি যে তাহার দ্বিতীয় নির্দেশও বাস্তবায়িত হইবে। সন্ত্রাসীদের তিনি আশ্বাস দিয়াছিলেন যে সাংবাদিক পিটাইলে মামলা গ্রহণ না করিবার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া আছে। অতএব পুলিশ যত মিঠা কথাই বলুক, সাংবাদিক আনিসুর রহিমের ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসীদের একজনকেও যে ধরা হইবে না ইহা আমরা অভিজ্ঞতা হইতে অনুমান করিতে পারি।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোজাম্মেল কিছুদিন পূর্বে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অশালীন ভাষায় গালমন্দ করিয়া দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহকগণ প্রচন্ড প্রতিবাদে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা ছাড়া আর কিছুই করিতে পারেন নাই। ইহাতে হয়ত প্রতিমন্ত্রীর সাহস বাড়িয়া দুঃসাহসে পরিণত হইয়াছে এবং তিনি সাংবাদিকদের হাড্ডি গুঁড়া করিবার জন্য নিজস্ব বাহিনী লেলাইয়া দিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে এই ধরনের মাত্রাছাড়া দুঃসাহস সরকারের ভাবমূর্তি ধুলায় মিশাইয়া দিতে পারে। এই ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধান করিলে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বন্যার সময় ত্রাণ কার্য পরিচালনায় চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির
খবর সাংবাদিকগণ ফলাও করিয়া প্রচার করিয়াছেন-ইহাই তাহাদের একমাত্র অপরাধ।…. সাতক্ষীরাসহ কোনও কোনও এলাকায় প্রায় শত বৎসর পর বন্যা হইল।

বহু বৎসর পর রিলিফ চুরির সুযোগ পাইয়া এই অঞ্চলের কেহ কেহ কতটা বাড়াবাড়ি করিয়া ফেলিয়াছে আমরা সেই সম্পর্কে মন্তব্য করিতেছি না। এই বাড়াবাড়ির একটা বড় ভাগ প্রতিমন্ত্রীর ভাঁড়ার পর্যন্ত পৌঁছাইয়াছে কিনা সেই ব্যাপারেও নিরুত্তর থাকা আমরা শ্রেয় মনে করি। তবে ইহা বিলক্ষণ বোঝা যায় যে, নিশ্চিত লাভের গুড় হাতছাড়া হইবার উপক্রম না হইলে কাহারও পক্ষে এইভাবে চেতিয়া উঠার কথা নহে।
গোলাম সারওয়ার দৈনিক সমকালের সম্পাদক থাকা অবস্থায় প্রয়াত হয়েছেন (প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোজাম্মেলও প্রয়াত)। কিন্তু তাঁর দুই দশক আগের সম্পাদকীয়টি পাঠক মন থেকে বিস্মৃত হলেও প্রয়াত হয়নি। বরং অনুসন্ধানী সাংবাদিক কারাবন্দী রোজিনা ইসলাম নির্যাতিত আনিসুর রহিমের উত্তরাধিকার।

“প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে এই ধরনের মাত্রাছাড়া দুঃসাহস সরকারের ভাবমূর্তি ধুলায় মিশাইয়া দিতে পারে।” মর্মে যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের ভবিষ্যত বানীটি পরবর্তী বছরের পহেলা অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ফলাফলে ফুটে উঠেছিল।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ওপর দোষ চাপিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কোনপ্রকারই গ্রহণযোগ্য নয়। অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসাকে “খামসি” মেড়েছেন মর্মে রোজিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ খাড়া করেছেন, তাতে মনে হয় তার হাতে মেডিকেল রিপোর্ট রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরকারের গুপ্ত নথিপত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তিপত্র, যা প্রকাশ হলে সেই সব দেশের সঙ্গে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কথা শুনে আমার মনে একটি প্রশ্নের উদ্রেক করেছে – তাহলো, এতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথিপত্র (প্রকারান্তরে বৈদেশিক চুক্তিপত্র) কেন একজন উপসচিবের টেবিলে ফাইল বন্দী অবস্থায় থাকলো? রাষ্ট্রীয় নথিপত্র রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষণাগার থাকার কথা। অথবা এটি যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হবে তাহলে তা কেন মন্ত্রী বা সচিব মহদাশ্রয়ে রাখা হলো না। সচিবের এপিএস বা উপসচিবের কক্ষে টেবিলের ওপর এভাবে রাষ্ট্রীয় নথিপত্র রাখা এবং কক্ষটি খোলা রাখা কি দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ নয়? মন্ত্রী নিজে বলতে পারেননি কক্ষটিতে সিসি ক্যামেরা আছে কি নেই। এরকম গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র যে কক্ষটিতে থাকবে সেই কক্ষটিতে প্রবেশাধিকারও কেন সংরক্ষিত নয়? এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা উচিত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়েছে যে আমলাতন্ত্রের কাঠগড়ায় সাংবাদিকতা দাঁড় করাতে পেরে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির চিত্র যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তাতে সংশ্লিষ্ট আমলারা তার এক হাত নেবেন – এটা পূর্বপকল্পিত কিনা সেটাও বিচারিক আদালতে প্রশ্ন ওঠা উচিত। সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার কে এস নবীর বাসভবন থেকে বিতাড়িত নাবালক নাতিদের গেইটের সামনে রাত্রিযাপনের খবর ছড়িয়ে পড়লে মহামান্য হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চের বিচারকদ্বয় নজিরবিহীন একটি আদেশ দিয়েছিলেন প্রশাসনের প্রতি। ওই আদেশ কার্যকর করা হয়েছিল। শিশু সন্তানদের বাসভবনে ফিরিয়ে দেয়াসহ তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়েও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।

রোজিনা ইসলামকে আদালত কারাগারে পাঠানোর আদেশদানের পর আমার মনে একটি স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল। ভাবছিলাম উচ্চ আদালতের বিচারপতির কোন বেঞ্চই এখন স্বপ্রনোদিত হয়ে রোজিনা ইসলাম জামিন দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ন্যায় বিচারের স্বার্থে কতিপয় নির্দেশনা আরোপ করতে পারেন। কেননা ন্যায় বিচারের জন্য জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগই।

দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা শুধু নয় বিভিন্ন মহল থেকেই সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবি করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রোজিনা ইসলামের প্রতি সহমর্মিতা বর্ষিত হচ্ছে। মন্ত্রী ও নেতাদের একেকজনের বক্তব্য একেক রকম। প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সেই দুই দশক আগের সম্পাদকীয়টির শেষ কটি লাইন জুড়ে দিচ্ছি ” কে রুষ্ট হইলেন অথবা কে তুষ্ট হইলেন তাহা বিবেচনা করিলে সাংবাদিকদের চলে না।

পেশা হিসাবে সাংবাদিকতা সত্য প্রকাশে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার দাবি পূরণ করিতে গিয়া যুগে যুগে দেশে দেশে সাংবাদিকগণ চরম নির্যাতনের শিকার হইয়াছেন। বন্ধু শত্রুতে পরিণত হইয়াছে, স্বজন মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে, অকালে জীবন বিসর্জন দিতে হইয়াছে, তাহার পরেও সাংবাদিকরা থামিয়া যান নাই। বাংলাদেশ এই বাস্তবতার বাহিরে নহে। সাংবাদিকদের ধনবল নাই, বাহুবল নাই। সুদৃঢ় মনোবলে বলীয়ান হইয়া সাংবাদিকগণ সত্য প্রকাশের জন্য কলমযুদ্ধে লিপ্ত। ইহাতে ক্ষুব্ধ হইয়া কেহ যদি অসি লইয়া আমাদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে তবে আমরা মসী হাতে তাহার মোকাবিলা করিব।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।