সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল-পায়রা তালতলি কয়লা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বন্ধের আহবান বাপার

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
0

নিজস্ব প্রতিবেদক:
সুন্দরবনের পাশে রামপাল, তালতলি ও পায়রায় নির্মিতব্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ সহ অন্যান্য সকল লাল ক্যাটাগরীর মারাত্নক বন ও নদী ধ্বংসকারী প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তদস্থলে বৃহৎ বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা যেতে পারে।

সুন্দরবন দিবস ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পালন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি’র যৌথ উদ্যোগে আজ রোববার বিকেল ৫টায় “সুন্দরবন রক্ষায় করণীয় ও দাবী ” শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা ‘জুম’ প্লাটফর্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সভায় এ আহবান জানানো হয়েছে।

বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি’র সভাপতি সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে এবং বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল এর সঞ্চালনায় এতে নির্ধারিত আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাপা নির্বাহী সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. আব্দুল মতিন, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, অধ্যাপক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাপা’র বন, জীববৈচিত্র, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্বালানী বিষয়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ, জেন্ডার ও পরিবেশ বিষয়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শারমীন মুরশিদ, যুব বাপা/ যুব আন্দোলন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব এ্যডভোকেট রাওমান স্মিতা প্রমূখ।

এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সংহতি বক্তব্য রাখেন বাপা’র কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খান, বেনের অষ্ট্রেলিয়ার সমন্বয়কারী কামরুল আহসান খান, বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবির, ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, বাপা কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুর, বাপা হবিগঞ্জ শাখার সভাপতি অধ্যাপক ইকরামুল ওয়াদুদ, বাপা মহেশখালী শাখার সভাপতি মোসাদ্দেক ফারুকী, বাপা মংলা শাখার সাধারণ সম্পদক নূর আলম শেখ, বাপা পাথরঘাটা থেকে শফিকুল আলম খোকন, বাপা নির্বাহী সদস্য রফিকুল আলম ও ফরিদুল ইসলাম প্রমূখ।

সুলতানা কামাল বলেন, মানুষের জীবন যাপন প্রকৃতির উপর আত্নসম্পকীয়। যারা পরিবেশ ও বন ধ্বংস করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের এ আন্দোলন। সুন্দরবন দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস। নতুন প্রজম্মের মধ্যে সুন্তরবনের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে পাশা পাশি দেশ ও সেখানকার স্থানীয়দের মধ্যে সুন্দরবন বিষয়ে ব্যপক সচেতনতা চালাতে হবে। তিনি সুন্দরবনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নিকট সরকার কতৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বিষয়ে পূঃণ বিবেচনার আবেদন জানান।

ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের স্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন। শত সহশস্র বছরের প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে এই বন। এটা তৈরী করা হয়নি। সুন্দরবনকে ধংস করার জন্য এক শ্রেণির লোক উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আর সরকার সেটিকে আশ্রয় প্রশয় দিয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন প্রাকৃতিক দূর্যোগে আমাদের ঢাল হিসেবে কাজ করে। তিনি বাপার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে সুন্দরবনের বন আজ ধংস প্রায়। শিল্প বর্জ্য নদীতে এবং বনের মধ্যে মিশে যাওয়ার ফলে নদীতে মাছ কমেছে এবং বনের গাছ কমেছে, বনের মধ্যে চারা অঙ্কুরোদগম ঠিক মত না হওয়ার কারনে। বনের পানি ও গাছের সঙ্গে সম্পৃক্ত যত প্রাণী আছে তাদের জীবন চক্রের পরিবর্তন হচ্ছে।

ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, গত দুইশত চল্লিশ বছরে ছয় হাজার স্কয়ার কিলোমিটর এবং গত সাতাশ বছরে ছিয়াত্তর স্কয়ার কিলোমিটর সুন্দরবন ধংস হয়ে গেছে। সুন্দরবন রক্ষার জন্যে তিনি তথ্য ভিত্তিক জনসম্পৃক্ত সমন্বিত পরিকলপনা গ্রহন ও বাস্তবায়নের আহবান জানান।

আজকের অনুষ্ঠান থেকে সভার সভাপতি সবার পক্ষ থেকে নিম্মোক্ত দাবীসমূহ তুলে ধরা হয়ঃ
1. সুন্দরবন তথা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ, তাদের জীবিকা, সকল বন, গাছপালা, জীব বৈচিত্র্য ও নদ-নদী- জলাশয় রক্ষা করতে হবে।

2. জাতিসংঘ নির্দেশিত স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা সমূহের মধ্যে বিশেষ করে ৬ নম্বরে ২০২০ সালের মধ্যে নদনদী ও জলাশয় দখল ও দূষণমুক্ত রাখা। ২০৩০ সালের মধ্যে নদনদী ও জলাশয়সমূহে সকল প্রকার বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করা, ১২ নম্বরে প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্বশীল আচরণ ও প্রতিবেদন এবং টেকসই পর্যটন ইত্যাদি বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে অবগত ও সম্পৃক্ত করার নিমিত্তে তথ্য উপাত্ত সংকলন ও প্রশিক্ষণ, ১৩ নম্বরে নদী ও জলাশয় সম্পৃক্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি প্রশমন ও মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণকে প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রশিক্ষণ প্রদান, ১৪ নম্বরে উপকূলের নদনদী ও জলাশয় দূষণমুক্ত রাখার মাধ্যমে স্থলভাগ থেকে সংগঠিত সামুদ্রিক দূষণের হাত থেকে সম্পদের সংরক্ষণ ও এর টেকসই ব্যবহার ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

3. সুন্দরবন অঞ্চলের লবণাক্ততা হ্রাস করতে গঙ্গা-পদ্মা নদী-ব্যবস্থায় অভিন্ন আন্তঃদেশীয় নদীসমূহে পানির অববাহিকা-ভিত্তিক ন্যায্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

4. পানিতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ নিধন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বিষ প্রয়োগকারী চক্রকে সনাক্তকরে কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে কার্যকর ও নির্মোহ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মৌয়ালী ও বাওয়ালীদের যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

5. অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট নির্মাণ ও জোয়ার-ভাটার পানি নিয়ন্ত্রণের নামে খালগুলোকে ড্রেনে রুপান্তর বন্ধ করতে হবে। শিল্পায়নের নামে নদী, খাল ও জলাশয় ভরাট বন্ধ করতে হবে।

6. নদীর প্রস্থের তুলনায় কম প্রশস্থ ব্রীজ নির্মান করে নদীকে সংকুচিত করা এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস বন্ধ করতে হবে।
7. সুন্দরবন অঞ্চলে সকল স্রোতস্বিনী নদী-খাল দখল ও ভরাট বন্ধ করতে হবে।
8. সুন্দরবনে আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে ফেলা বন্ধ করতে হবে। আগুন লাগানোর সাথে জড়িত চোরাকারবারী, দখলদার এবং তাদের সহযোগী বন ও পরিবেশ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের অপকর্ম কঠোরভাবে দমন করতে হবে।

9. সুন্দরবন নির্ভর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও প্রয়োজনে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
10. নদী থেকে বালি উত্তোলন ও বড় পরিসরে ড্রেজিং নদী ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত এবং জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এসকল অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
11. কলকারখানার বিষাক্ত পানি দিয়ে সকল নদী দূষিত হচ্ছে, এই বিষ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনের স্পর্শকাতর পরিবেশে সকল প্রকার শিল্পায়ন বন্ধ করতে হবে।

13. সুন্দরবন ওর্য়াল্ড হেরিটেজ হিসেবে জাতিসংঘে বিবেচিত একটি অমূল্য সম্পদ। এর জন্য ক্ষতিকর সরকারী -বেসরকারী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো’র সুপারিশে পরিচালিত সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে চলমান কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা যথাযথ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
14. বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল জুড়ে প্রস্তবিত নির্মাণাধীন সকল পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প বাতিল করতে হবে এবং সমগ্র উপকুলে বিজ্ঞান সম্মত ও জনসম্পৃক্ত কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।