সুবিধাবাদী হলে তিনি আর বুদ্ধিজীবী থাকেন না: ডয়চে ভেলেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আপডেট: জুলাই ১০, ২০২১
0

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, বুদ্ধিজীবীকে কখনও সুবিধাবাদী হতে পারেন না৷ বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে পরিবর্তনের পক্ষে থাকা৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে বুদ্ধিজীবী নিয়ে এমন ব্যাখা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক৷

তার মতে, ‘‘এখানে নানা ধরনের অসুবিধা আছে৷ আমাদের দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করে৷ সেই ভয়টা হল, আমি যদি আমার মত প্রকাশ করি এবং সেই মত অন্যের কাছে নিয়ে যেতে চাই তাহলে আমার বিপদ হতে পারে৷ নানা রকমের বিপদ হতে পারে৷ আমার জীবিকার উপর একটা বিপদ আসতে পারে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আমার উপর নজরদারি করতে পারে৷”

বুদ্ধিজীবীর আসলে সংজ্ঞা কী?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বুদ্ধিজীবী আসলে বিশেষ কোন পেশাজীবী নন৷ বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন সেই রকমের মানুষ তারা পৃথিবীটাকে বা তাদের জগৎটাকে বুদ্ধির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন৷ দ্বিতীয়ত, এই ব্যাখ্যাকে তারা অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চান৷ ব্যাখ্যা করবেন এবং ব্যাখ্যা অন্যের কাছে পৌঁছে দেবেন এবং তার সঙ্গে আরেকটা চেতনা থাকে তা হল এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা৷ কাজেই বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা তেমন মানুষকেই বোঝাবো তারা বুদ্ধির সাহায্যে পরিবেশ পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেন, সেই ব্যাখ্যাকে অন্যের কাছে নিয়ে যেতে চান এবং ভেতরে আকাঙ্খা থাকে অবস্থার একটা পরিবর্তন করা৷ যেমন ধরা যাক সক্রেটিস৷ সক্রেটিস দার্শনিক ছিলেন৷ তাকে আমরা আদর্শ বুদ্ধিজীবী বলতে পারি৷ তিনি ব্যাখ্যা করতেন এবং তরুণদের মধ্যে সেই ব্যাখ্যা পৌঁছে দিতে চাইতেন৷ তার লক্ষ্য ছিল, বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে বদলাবেন৷ এভাবেই আমি বুদ্ধিজীবীদের দেখি৷

পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে পার্থক্য কী?
শ্রমজীবী হলেন তারা পৃথিবীটাকে দেখে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কিন্তু তারা ব্যাখ্যা করতে পারে না৷ ওই ব্যাখ্যা করার জায়গাটাতে বুদ্ধিজীবীরা আছেন৷ শ্রমজীবী মানুষ অনুভব করে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানে কিন্তু ব্যাখ্যাটা তারা করতে পারে না৷ পার্থক্যটা মূলত এখানে৷

বুদ্ধিজীবী হলে সুবিধা কী? কোন ভাতার ব্যবস্থা আছে বা কোন বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়?

না না বুদ্ধিজীবী হলে কোন সুবিধাই নাই৷ বরং অসুবিধা বেশি৷ ওই যে আমি সক্রেটিসের কথা যে বললাম বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাকে তো প্রাণই দিতে হয়েছে৷ কোন সুবিধা নেই৷ এরা নিজেদের উপরই নির্ভর করে৷ বুদ্ধিজীবীরা কারো কাছ থেকে প্রাপ্তির আশা করে না৷ তারা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকার কারণে তা থেকে যে আয় উপার্জন হয় সেটার উপরই নির্ভর করেন৷ তারা পৃষ্ঠপোষকতা আশা করে না এবং এটার উপর নির্ভরও করে না৷

সাধারণত যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন তারাই তো বুদ্ধিজীবী? তাহলে তো বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অনেক৷ শিক্ষক-সাংবাদিক অনেকেই এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়েন৷

বুদ্ধির চর্চা করলেই বুদ্ধিজীবী হবেন এটা আমার মনে হয় না৷ বুদ্ধির চর্চা তো ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকেরা করছেন, সাংবাদিকেরা করছেন, এমন কী আইনজীবীরাও করছেন৷ কিন্তু ওই যে আমি বললাম, এটার একটা ব্যাখা করতে হবে৷ তারা ব্যাখা করবেন এবং সেটা অন্যের কাছে নিয়ে যাবেন তাও সেটা কোন কিছু বিনিময়ে না৷ নিজের ভেতরের অনুপ্রেরণা থেকে এটা করবেন৷ তার আকাঙ্খা থাকবে এই ব্যবস্থাটার বদল করা দরকার৷ এটা একটা আদর্শ ব্যবস্থা নয়৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক তাহলে বুদ্ধিজীবী নন?
না, তা বলা যাবে না৷ কোন পেশার কাউকেই পেশাগতভাবে বুদ্ধিজীবী বলা যাবে না৷ বুদ্ধিজীবী হবেন ব্যাক্তিগতভাবে৷ একজন শিক্ষক অবশ্যই বুদ্ধিজীবী হতে পারেন৷ কিন্তু তিনি শিক্ষক বলেই যে বুদ্ধিজীবী সেটা না৷ তিনি একটা বিষয় পড়াচ্ছেন, সেই বিষয়ের মধ্যেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকেন৷ এমনকি তিনি যদি তার বিষয়ের বাইরে গিয়ে পৃথিবীটাকে ব্যাখ্যাও করতে চান তাহলেও আমি তাকে বুদ্ধিজীবী বলব না৷ যদি না তিনি তার ব্যাখ্যাকে কথার মধ্য দিয়ে, লেখার মধ্য দিয়ে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চান বা চেষ্টা করেন৷ এই ব্যবস্থাটাকে বদলাতে অতি সামান্য হলেও যদি ভূমিকা না রাখেন৷

আমরা দেখি, অনেকেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর বুদ্ধিজীবী হয়ে যান৷ এটা কতোটা যৌক্তিক?
তিনি হতে পারেন৷ অবসর নিয়েছেন বলেই যে তিনি বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিজীবী হবেন না তা নয়৷ অবসর নেওয়ার আগেও হতে পারেন৷ এটা আসলে পেশার সঙ্গে যুক্ত না৷ পেশাজীবী আর বুদ্ধিজীবী এক না৷ এটাকে পার্থক্য করতে হবে৷ পেশার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন তো অবশ্যই থাকবে৷ একজন বিজ্ঞানী বা একজন আইনজীবী তিনি তো বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন করেন৷

বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এখন নানা ধরনের সমালোচনা আছে৷ তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা থাকলেও করেন না৷ অনেকটা সুবিধাবাদী পরামর্শ দেন৷ এটা কতটা ঠিক?

এটা তো অবশ্যই যৌক্তিক না৷ তিনি যদি সুবিধাবাদী হন এবং সক্রিয় না হন তাহলে আমি তাকে বুদ্ধিজীবী বলব না৷ বুদ্ধিজীবীকে সক্রিয় হতে হবে৷ তিনি সুবিধার জন্য কাজ করবেন না৷ তিনি সক্রিয় না হলে আমরা কী করে বুঝব তিনি পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন৷

বুদ্ধিজীবীরা কী বাস্তবে সাধারণ মানুষের কথা বলেন?
এখানে নানা রকমের অসুবিধা আছে৷ আমাদের দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করে৷ সেই ভয়টা হল, আমি যদি আমার মত প্রকাশ করি এবং সেই মত অন্যের কাছে নিয়ে যেতে চায় তাহলে আমার বিপদ হতে পারে৷ নানা রকমের বিপদ হতে পারে৷ আমার জীবিকার উপর একটা বিপদ আসতে পারে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আমার উপর নজরদারি করতে পারে৷ আরেকটা হল যে, আমাদের তো গরীব পশ্চাদপদ সমাজ এখানে সুবিধার খুব অভাব৷ কাজেই সুবিধাবাদিতা এসে যায়, একটা সুবিধা পেলাম আর সরকারে যারা আছে তাদের মতকেই সমর্থন করলাম৷ এটা যখন তিনি করেন তখন আর তিনি বুদ্ধিজীবী থাকেন না৷ বুদ্ধিজীবীর কাজই হল পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করা৷ বিদ্যমানের পক্ষে থাকলে তাকে আমি বুদ্ধিজীবী বলব না৷

বুদ্ধিজীবীরা তো পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলবেন? তাহলে ভয়-ভীতি উপেক্ষা করাও তো বুদ্ধিজীবীদের কাজ?
হ্যাঁ, অবশ্যই৷ এখানে যে বুদ্ধিজীবীরা তাদের কাজটা করতে পারছেন না৷ কারণ বাস্তব অবস্থাটা কিন্তু অনেক শক্তিশালী, ব্যক্তিগত অবস্থানের তুলনায়৷ বাস্তব অবস্থা মানুষকে আটক করে ফেলে বা সীমিত করে ফেলে৷ তখন মানুষ আর তার বাইরে যেতে পারে না৷ বুদ্ধিজীবীরা যদি কথা না বলেন তাহলে পরিস্থিতি বদলাবে কীভাবে? তাহলে আমরা পরিবর্তন কীভাবে পাব?

বুদ্ধিজীবীদের কী কোনো ভাতা দেওয়া উচিত? আমরা তো দেখি অনেকেই কষ্ট করে জীবন-যাপন করেন?
অবশ্যই না৷ তিনি তো কোনো না কোনো পেশায় থাকবেন৷ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তো তার কোন আলাদা চিহ্ন নেই৷ বুদ্ধিজীবী কিন্তু পেশাজীবী হতে পারেন৷ পেশাজীবী হতে তো কোন অসুবিধা নেই৷ কিন্তু সব পেশাজীবী মাত্রই বুদ্ধিজীবী না৷ তারাই বুদ্ধিজীবী যারা পেশার বাইরে যেতে চান৷ কিন্তু তিনি তার জীবিকার জন্য পেশার উপর নির্ভর করবেন৷ উপার্জনের যে উৎস সেখানে কাজ করবেন৷ সেগুলো তো তাকে করতে হবে৷ ভাতা দিয়ে তো তাকে পালন করা যাবে না৷

বুদ্ধিজীবীরা কী শুধু সরকারের সমালোচনাই করবে? না কী পরামর্শও দেবে?
হ্যাঁ, পরামর্শ দেবে৷ পরামর্শ আসলে সমালোচনাই৷ পরামর্শ হল, সরকার যে কাজটা করছে, সেটার পক্ষে বলা না৷ পরামর্শ মানে হল, আরেকটা কিছু করা৷ আপনি যেটা করছেন সেটা পূর্ণ হচ্ছে না বা সঙ্গত হচ্ছে না৷ আসলে পরামর্শ আর সমালোচনার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই৷ সমালোচনাও এক ধরনের পরামর্শই বটে৷

মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, বলা হয় এখন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাও কমে গেছে, চরিত্রও অনেকটা বদলে গেছে৷ এটা কী ঠিক?

এটা অবশ্যই ঠিক৷ মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের একটা দ্বন্দ্ব ছিল৷ এখানে বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন৷ সামনেই ছিলেন৷ কিন্তু এটাও ঠিক অনেক বুদ্ধিজীবী কিন্তু বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেননি৷ তাদের অনেকে কিন্তু সরকারের সমর্থকও ছিলেন৷ যারা সরকারকে সমর্থন করেছিলেন তাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমরা গণ্য করব না৷ তখন তো একটা পরিবর্তনের আকাঙ্খা ছিল৷ পকিস্তানি রাষ্ট্র মানুষকে নিপীড়ন করেছে৷ অধিকার আদায়ের জন্য সমস্ত শ্রেণীর মানুষই সংগ্রাম করছে৷ সেই সংগ্রামের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরাও যুক্ত হয়েছেন৷ আমরা বলতে পারব না যে, তারা আলাদা করে কোন ভূমিকা পালন করেছেন৷ ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ, রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষুব্ধ, শ্রমিক বিক্ষুব্ধ, কৃষক তার ফসলের মূল্য পাচ্ছে না, কোন স্বাধীনতা নেই৷ এসবের জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করা হচ্ছে৷ এখন তো সেই বিক্ষোভ নেই৷ এখন যে রাষ্ট্র, সেটা তো আমাদের নিজেদেরই রাষ্ট্র৷ তবে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ আছে৷ সেটা সংগঠিত আকারে প্রকাশ পাচ্ছে না৷ সেজন্য বুদ্ধিজীবীরাও তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না৷

বর্তমান সময়ে বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র কী বদলে গেছে? তারা কোন দলের পক্ষ হয়ে কথা বলেন?
আমি প্রথমেই যে সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, সেখানে ইঙ্গিত করেছি যে, পরিবর্তনের পক্ষে না হলে একজন মানুষ যতই বুদ্ধির চর্চা করুন না কেন তিনি বুদ্ধিজীবী হবেন না৷ যদি তিনি সুবিধা নিয়ে কথা বলেন বা বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে বলতে থাকেন তাহলে তিনি বুদ্ধিজীবীর যে ভূমিকা সেটা পালন করছেন না৷ বুদ্ধিজীবীকে আমরা সুবিধাবাদী হিসেবে কখনই দেখব না৷ সুবিধাবাদী হলে গেলে আমরা বলব যে, তিনি আর বুদ্ধিজীবী নেই৷ মুখাপেক্ষি হয়ে গেলে মনে করব তিনি আর বুদ্ধিজীবী নেই৷ এজন্যই আমরা বলছি যে, বুদ্ধিজীবীর কাজ হচ্ছে পরিবর্তনের পক্ষে থাকা৷

সূত্র: ডয়চে ভেলে।