স্নেহ ও সৌজন্যের মরূদ্যান সেই নারী

আপডেট: জানুয়ারি ১৫, ২০২৩
0

ডা.জাকারিয়া চৌধূরী:

ঘুরে ফিরে রহস্য-রোমাঞ্চ ভরা জীবন আমার। এগুলো এখন আর ভাবায় না । নিজেকে দুর্দান্ত ভাঙতে পারি। কিন্তু আমার জীবনে ছিলেন তিনি । তার মধ্যে আমি একটো স্নেহ ও সৌজন্যের মরূদ্যান খুঁজে পেতোম । বলছিলাম তার-ই কথা ……
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানা বাড়ি বেড়াতে যাবার একটা রোগ আমার ছিল। মামাতো ভাই রয়েল বয়সে আমার বড়। সে সূত্রে তার ঘনিষ্ঠতা আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের সাথে। সেটা ছিলও। আমি সম্ভবতঃ এই একটা জায়গায় হিংসুক ছিলাম। কিছুতেই রয়েলের সংসর্গ ছাড়তাম না। এখন বুঝি কেন আমি তার সাথে বেশি কমফোর্টেবল ছিলাম। সে শান্ত স্বভাবের এবং একজন সহনশীল মানুষ। এখনো সম্ভবতঃ তেমনই আছে। প্রিন্টিং বিসনেস করে। সফল ব্যাবসায়ী। তার সহিষ্ণুতা আমার চলার পথকে সহজ করে দিত। সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে যথারীতি মামার বাড়ি যাই। বিকেলে খেলছিলাম, এ সময় সন্ধ্যার কিছুটা আগে আগে আমাকে কেউ ডেকে নিয়ে গেল। ছোটো খালা আমাকে খুজছে। শুনে কিছুটা অবাক হলাম। আমাকে ছোটো খালা খুজছে, ওরা বড়লোক। আমাকে কেন ডাকছে !! কিছুটা ভয় আর আতংক নিয়ে তার সামনে গেলাম। সাদা সুতি শাড়ি, সবুজ পাড়ের উপর সাদা লতাপাতা আকা। সাদা শাড়ির পুরো অংশটায় সবুজ কালিতে যেন কেউ পেন্সিলে লতাপাতা একে রেখে গেছে। ম্যাচ করা ব্লাউজ সবুজ কালারের। আমার সকল খালা অপুর্ব রুপবতী নারী। সবাই স্লিমবিল্ট সাদা চোখ। আমাকে কাছে পেয়েই খালা এমন জোরে টেনে ধরলেন যেন বুকের ভেতর কোথাও লুকিয়ে ফেলতে চাইছেন। প্রথমে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন কিছুটা লজ্জা লাগলেও আনন্দে চোখে পানি এসে গেল।

এস এস সি এক্সাম শেষে সিলেটে বেড়াতে গেলাম খালার বাসায়। এই প্রথম নির্দিষ্ট কোনো বাসায় একা বেড়াতে যাওয়া। খুব ভোরে বাসার সকলে নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস এই পরিবারে। সে সময় আমি থাকি ঘুমে। খালু খুব ভোরে উঠে গোসল সেরে আটটার আগেই অফিসে চলে যায়। কেয়ারের বড় কর্তাব্যাক্তি। এই লোককে আমি কখনো এমনকি শৈত্য প্রবাহের সময়ও গোসল না করে অফিসে যেতে দেখিনি। তিনি কখনো এক মিনিট লেট করে অফিসে ঢুকেননি, আজানের পর এক মিনিট দেরি করেননি। পাংচ্যুয়ালিটি কি জিনিস, বুঝতে হলে উনার সাথে চলতে হবে। অফিস অনেষ্টি শিখতে হলে তিনি হবেন নির্ভুল মডেল। ছোটো খালা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ১১ টায় ভাত খায়। সে সময় আমি নাস্তা খাবার জন্য উঠি। যতদিন ছিলাম ততদিন একটা আইটেম টেবিলে কমন পেয়েছি। বাসি হয়ে যাওয়া ডাল পোড়া পোড়া হলে সেটিকে বাটিভর্তি করে আমার দিকে এগিয়ে দিতেন। খালতো ভাইবোন গুলো আপত্তি করত বাসি ডালের বিষয়ে। তিনি চুপ থাকতেন। আমিও চুপ থাকতাম এবং সেটা দিয়েই পেট ভরে ভাত খেতাম। আমি ভাবতাম, এই জিনিসটা আমার কত প্রিয় সেটা উনাকে কখনো বলিনি। রান্না ডাল পোড়া পোড়া করতে তিন চার দিন লেগে যায়। পরদিন থেকে টেবিলে দু’রকম ডাল আসলো। পোড়া ডাল, নতুন ডাল। আমি পোড়া ডালের সাথে মাছ মাংস এটা সেটা খাই।

সাল ১৯৯৮, আজ ভাত খাবনা বলে বের হয়ে যাচ্ছি। তখনও তিনি সিলেটের পাঠানটুলায় আছেন। খালা বললেন তোর পছন্দের তরকারি রান্না করেছি। দেখলে তুই যাবি না। খালা বললেই হল? হাহ। বের হয়ে যাব কিন্তু সামান্য কৌতুহল হল। দেখার জন্য আবার ভেতরে ঢুকলাম। আমার পছন্দ অপছন্দ তিনি জানবেন কিভাবে ? ওমা, একি ? বড় বড় পুটি শুটকি দিয়ে ভাজা ভর্তা, পোড়া ডাল, বাটি ভর্তি পুটি মাছ ভাজি। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকে পরখ করলাম। আমি জানি, খাওয়া বিষয়ে তাকে বলিনি কিছু। কিন্তু এই মহিলা সেটা বুঝল কি করে !! বিষ্ময়ভরা চোখে ফিরে তাকালাম। খালা বললেন, এবার চলে যা। আমি ধপ করে বসে পড়লাম। খাওয়া শেষে সবাই নিয়ম করে ভাত ঘুম ঘুমায়। খালা বললেন, আরও কিছুক্ষন থাক। তোকে গোপন একটা সিনামা দেখাব। দুপুর তিনটার দিকে জানলা থেকে পর্দা একটু ফাক করে দেখালেন বিরাট মারদাংগা একটা কালো লোক দাঁড়িয়ে আছে৷ তার তিনফুট উচ্চতার বউ তাকে বিছানা ঝাড়ু দিয়ে বেদম পেটাচ্ছে। খালার দিকে ফিরলাম রাগী চোখে। আমিও পুরুষ, আমার আতে ঘা লেগেছে। উনি হেসে ফেললেন। বললেন তোমার নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। আসলেই জানে। আমি যে রেগে যাব এটাও জানে। তার হাসির শেষ নেই…. বললেন বড় হইও। কেবল বয়সে বাইরো না। এই দামড়াকে আবার দেখ !! রওজ এটাই তার লাঞ্চ। আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম তার কন্ঠের আর্দতা দেখে। আমাকেও তাহলে কেউ না কেউ গুরুত্ব দেয় !! বিরাট সংসারে সবার ছোট হয়ে জন্মানো এক ধরনের পাপ। পলে পলে এর সত্যতা আজও উপলব্ধি করি।

আজ বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে দরজা ফাক করে আহসান ( খালার শিশু পুত্র ) আহসান বলল – আম্মু, এসছে আপনাকে দেখতে। প্রথম দুই মিনিট আমি তার কথা বুঝিনি। কারন খালার শারিরীক অবস্থা কোনোভাবেই চলাচল উপযোগী নয়। যখন বুঝলাম, ততক্ষনে নিজের অজান্তেই হেটে হেটে বাইরে চলে এসছি। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, যাকে তিনজনে ধরে বাথরুমে নিতে হয় সেই তিনি এসেছেন। মুখ আমার সবুজ কাপড়ের মাস্কে ঢাকা। তবু তিনি তার আগের হাসিটা ধরে রাখলেন !! সাথে খালু আছেন, খালতো বোন, আহসানের বউ বাচ্চা, আমি কোনোদিকেই তাকাচ্ছি না। কি করা উচিত বুঝতে পারছি না, কি বলা উচিত বুঝতে পারছি না। আমি সারাজীবন রিউমারের শিকার হওয়া প্রানী। ঘরে থাকলেও দোষ, বাইরে থাকলেও দোষ। দোষের জীবন থেকে বাচতে গত আট বছর হসপিটালেই থাকি। আহসান বলল, আপনাকে নিয়ে কোন মন্দ কথা শুনলে আম্মা কখনো বিশ্বাস করেন না। আপনাকে দেখার জন্য আজ এত বেশি ব্যাকুল হয়ে গেছেন, বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হল। আমি খালার হাত ধরে তাকিয়ে আছি। এই মহিলার মনে আমার এতো শক্ত বসতভিটে কখনো ভাবিনি। অথচ কত সময়, কত কান্ড করে তিনি এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘আপনার বিপদের কথা শুনেই আম্না কাদতে শুরু করেছেন। এখানে নিয়ে না আসাতক তাকে থামানো যায়নি’- আহসান বলে যাচ্ছে। খালা দুই হাতে মাথায়, মুখে তার হাত বুলাচ্ছেন…. আমার পেকে যাওয়া চুলে হাত বুলাচ্ছেন….. খালু,সহ অন্যরা কত কথা বলছেন… কানে কিছুই যাচ্ছে না। আজ আমি তার হাতে একটা আদুরে শিশু….. মায়ের অভাবে বেড়ে উঠা শিশুদের জীবন সম্পর্কে কোনো ধারনা-ই জম্মে না। আমি বুঝলাম আমাকে নিয়ে কেন এত রিউমার হয়…. বুঝলাম মা কিভাবে সন্তানকে আগলে রাখে। আমি কেন সমাজের সমান্তরালে চলতে শিখিনি তার উত্তরটাও পেলাম। আহা, আগে যদি বুঝতাম তাহলে ত কবে থেকেই খালার বাসায় উঠে যেতাম !! খালা খালু তাদের সন্তানেরা কেউই ত বদলে যায়নি। দেশটা সম্ভবতঃ বদলে গেছে। অথবা আমি সমাজের যোগ্য হয়ে বড় হয়ে উঠতে শিখিনি…. বয়সটা বেড়েছে সময়ের অপচয় আর নিন্দেমন্দে…..

খালা চলে যাচ্ছেন। তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমার কিছু একটা করা উচিত। কি করা উচিত জানি না। বলে ফেললাম, আপনি বেহেশতে যাবেন। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত অপরাধবোধে ভুগছি। এ রকম গ্রস কথা বলার আমি কে ? কেউ না। এখন নিজেকে বুঝাচ্ছি, ওই কথাটা বলে আমি তাকে খুশি করতে চেয়েছি। হয়ত অনিচ্ছাকৃত ভুল। অথবা মনে মনে তার জন্য বেহেশত আশা করে দোয়া করেছি। মা খালাদের সাথে কেমন আচরন করতে হয়, এ বিদ্যেও তো আমার নেই। আমি স্থবির হয়ে আছি। আমি অপার হয়ে বসে আছি…. কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে নিশ্চিত করুক খালা আসলেই বেহেশতে যাবেন। মনে একরাশ আতংক কিলবিল করছে….