মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ১৭৬৩-১৭৭৫ সময়কালে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে কারখানার মেশিনের ব্যবহার ও যান্ত্রিক শক্তি দ্বারা মানুষের ‘কায়িক শক্তির প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রথম শিল্পবিল্পবের সূচনা হয়েছিল। ১৮৭০-১৯১৪ সময়কালে বিজ্ঞানী মাইকেল ফারাডে, বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিং, আলেসান্দ্রো ভোল্টাদের হাত ধরে বিদ্যুৎশক্তি আবিষ্কার হওয়ায় উৎপাদনকাজে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে শুরু হয় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব।
১৯৬৯ সন থেকে পরবর্তী সময়কালে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও মোবাইল আবিষ্কারের মাধ্যমে যোগাযোগের অভূতপূর্ব বিপ্লবের সময়টা ছিলো তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে শুরু হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জাগরণ। ক্লাউস সোয়াব ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ২০১৬ সনে তাঁর ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশন নামক বইয়ে সর্বপ্রথম চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন একটি বাস্তবতা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটছে মূলত ইন্টারনেটের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যোগের মাধ্যমে। এই বিপ্লবের যুগে আপনি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অবস্থান করেও ইনোভেটিভ কোনো আইডিয়া/স্টার্টআপের মাধ্যমে গোটা দুনিয়াকে নিজের প্রতিভার কথা জানান দিতে পারেন। সাথে রয়েছে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের হাতছানি। মুহূর্তেই হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল উদ্যোক্তা।
বর্তমানে কম্পিউটার, মোবাইল ও ইন্টারনেট ছাড়া একটা মুহূর্তও আমরা কল্পনা করতে পারি না। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর দুঃসময়ে জুম, স্ট্রিমইয়ার্ড, ওয়েবিনার, গুগল ক্লাসরুম, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি প্রভৃতি শব্দগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতাকেই যেন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও উৎকর্ষতা বাড়াতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন দেশ-বিদেশের ফ্রিল্যান্সার প্রযুক্তিবিজ্ঞানীরা। নানা প্রযুক্তি সেবা/পণ্য, উদ্যোগ বা স্টার্টআপের মাধ্যমে দিনদিন তারা আমাদের জীবনযাত্রাকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশেও আইটি ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে। দক্ষতার দিক থেকেও বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলেছে। দেশের অর্থনীতিতে সুপরিকল্পিত ও শক্তিশালী অবদান রাখার জন্য এই সেক্টরের দক্ষ এবং সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় এনে সংগঠিত করা ছিল সময়ের দাবি।
তৎপ্রেক্ষিতে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সফল উদ্যোক্তা তৈরি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবোরেশনকে সম্মৃদ্ধ করার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অধিকতর ভূমিকা রাখার নিমিত্তে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) নির্মিত হচ্ছে শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর। প্রায় ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৫ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত প্রকল্পটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়ে এখন উদ্বোধনের প্রহর গুণছে। এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এটি নতুন মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বলা হয়ে থাকে যে, ইনকিউবেটরে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে ৩০ ডলার আয় করা যায়। সেই হিসেবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে চুয়েটের এই শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর প্রকল্প।
ইনকিউবেটরের ইতিহাস:
১৯৫৯ সনের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাটাভিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্টারের মাধ্যমে ইনকিউবেটর সংক্রান্ত উদ্যোগ সর্বপ্রথম সফলভাবে শুরু হয়। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ২০১২ সনের দিকে ইনকিউবেটর কার্যক্রমের ধারণা শুরু হয়। সেই সময়ে তারা কয়েকদফা ইনকিউবেটর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। বেসরকারি উদ্যোগে বিজনেস ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেটশন (BIIC) লিমিটেড সংগঠনটিও ইনকিউবেটর নিয়ে কাজ করে। ২০১৬ সনের দিকে এসে মূলত ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের নিয়ে ইনকিউবেটর ধারণাটি হাইটেক পার্ক এবং মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের হাত ধরে আরও পরিচিতি পেতে শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০ হাজার আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর রয়েছে।আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল বিজনেস ইনকিউবেশন অ্যাসোসিয়েশনের ২০০৫ সনের তথ্যমতে, কেবল উত্তর আমেরিকায় বিজনেস ইনকিউবেটরের মাধ্যমে প্রায় ১০ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ চীনে ৭০০ এর অধিক এবং ভারতে ৭০ এর অধিক ইনকিউবেটর রয়েছে। চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ইনকিউবেটর স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে গড়ে উঠেছে নতুন-নতুন সফল উদ্যোক্তা।
মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম
জনসংযোগ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়