স্বাধীনতার ৫০ বছর বাংলাদেশের নয়,বঙ্গবন্ধু যেমন স্বাধীনতার স্থপতি বাংলাদেশের নন

আপডেট: এপ্রিল ৩, ২০২১
0
bongobondhu

সোহেল সানি

ইতিহাসের বিকৃতি। দেখার কেউ নেই। জাতির সংকটে- বিপর্যয়ে আমাদের যে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীটিকে প্রতিবাদী ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখেছি – সেই তাঁরা একে একে সবাই পরপারে চলে গেছেন। কে করবে প্রতিবাদ?

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা রীতিমতো দুঃখজনক। প্রকারান্তরে ইতিহাস বিকৃতির চমৎকার উৎসব হয়ে গেল সুবর্ণজয়ন্তীকে উপলক্ষ করে।
ইতিহাসের জনক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, “ইতিহাসের বড় দুঃখ, ইতিহাস পড়ুয়ারা ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন না।”

আমাদের বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবের চেহারা দেখে নেপোলিয়নের কথাই মনে পড়ছে। যাহোক, নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে সুবর্ণ জয়ন্তী। এতে দারুণ এক রোমাঞ্চকর মাত্রার সন্নিবেশ ঘটায় “মুজিব শতবর্ষ”- অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী। স্বাধীনতার ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ও ‘মুজিব শতবর্ষ’ সমার্থক। কেনো সমার্থক। এই কারণে যে, স্বাধীনতার জন্মদিন ২৬ মার্চ – ১৯৭১ এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবের জন্মদিন ১৭ মার্চ-১৯২০ সাল।
আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র”- এ বর্ণিত শব্দার্থে “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ”

এর নামকরণকারী ও স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় উচ্চ আদালত হাইকোর্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর যে, ঐতিহাসিক ভাষণটি জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক “বিশ্বের ভাষণ” রূপে সমাদৃত, সেটিও স্বাধীনতা ও মুজিবের জন্মমাসেই অর্থাৎ ৭ মার্চ – ১৯৭১ সালেই প্রদত্ত। এসব কারণেই সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব ও মুজিব শতবর্ষ উৎসব উদযাপন ঐতিহাসিক গুরুত্বলাভ করে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুবর্ণের এ আগমণে কিছু অ্যাপসভিত্তিক প্রোফাইল ছবি তৈরি করা হয়েছে। রাস্তায় সাঁটানো পোস্টারে বিকৃতি ঘটেছে বঙ্গবন্ধুকে ও বাংলাদেশকে উপস্থাপনে।

“৫০ বছর বাংলাদেশ” শীর্ষক সুন্দর রংচঙে আঁকা অ্যাপসের সঙ্গে বহুমন্ত্রী, নেতা সেলিব্রিটি নিজেদের ছবিসহ ফেইসবুক প্রোফাইলে আপলোড করেছেন। কেউ কেউ পোস্ট কিংবা স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন বাংলাদেশের স্থপতি। প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি। আবার এটাও বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। বাংলাদেশের স্থপতি আর স্বাধীনতার স্থপতি গুলিয়ে ফেলাটা ইতিহাসের চরম বিকৃতি। বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর নয়। বাংলাদেশ বঙ্গ, বাঙ্গালা, বাংলা, বেঙ্গল, অবিভক্ত বাংলা, পূর্ববাংলা, পূর্ববঙ্গের (এমনকি পূর্ব পাকিস্তান) দেড় লক্ষ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য রয়েছে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতায় অর্জিত। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বরে অভ্যুদয় ঘটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স ৫০ বছর, বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর নয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের আগ পর্যন্ত বাংলার স্বাধীনতা ছিলো। অস্তমিত হয় নবাব সিরাজুদ্দৌলার পলাশী যুদ্ধের পরাজয়ে।

উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বর্তমান ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” নামে জন্ম গ্রহণ করেছিল। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গ ও পূর্ববাংলার স্থলে পূর্বপাকিস্তান নামকরণ করার প্রতিবাদ করে “বাংলাদেশ” নামকরণের প্রস্তাব পেশ করেন। এর আগে কবি নজরুল ইসলাম “বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি প্রবন্ধও লিখেন।

বঙ্গ- থেকে “বাঙ্গালা” ও পরে “বাঙ্গলা” বা বাংলা শব্দটির প্রচলন করেন শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ। ১৩৪২ খৃষ্টাব্দে সুলতান আলী শাহকে হত্যা করে ইলিয়াস সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করেন। তিনি সমগ্র এলাকাকে বোঝানোর জন্য তিনি বঙ্গকে বাঙ্গালা ও পরে বাঙ্গলা (বাংলা) প্রচলন করেন। ইলিয়াস শাহকে “শাহ বাঙ্গালিয়ান” খেতাবেও ভুষিত করা হয়েছিল। মোগল যুগে বলা হতো সুবে বাঙলা। ইংরেজ আমলে বাঙ্গলা-কে ‘বেঙ্গল’ নামকরণ করা হয়। পৃথিবী ব্যাপী বেঙ্গল রূপে পরিচিতিও গড়ে উঠেছিলো। শশাঙ্কের শাসনের অবসানের পর গৌড়-বঙ্গ দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো। তারকানাথ “মাৎস্যন্যায়” লিখেছেন, সমগ্র দেশে কোন রাজা ছিল না। এক চরম অরাজকতায় পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল রাজা রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

গোপালের ক্ষমতালাভের উৎস সম্পর্কে খালিমপুর তাম্রলিপিতে যে শ্লোকবাক্য রয়েছে তা নিম্নরূপঃ “গোপালকে, যিনি মুকুটমনি, মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটানোর জন্য প্রকৃতিরা লক্ষ্মীর হাত বরণ করেছিল।” তারকানাথ লিখেছেন, দেশে বহুবছর ধরে অরাজকতার ফলে জনগণের দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি বসে একজন রাজা ঠিক করলেন। কিন্তু রাতে এক নাগ রাক্ষসী তাকে মেরে ফেলে। এর পর প্রতি রাতে একজন করে রাজা নিহত হন। একদিন চুন্ডাদেবীর বাড়ির ওপর ভার পরলো রাজা নির্বাচনের। ওই বাড়ির কেউ রাজা হতে রাজী হচ্ছিল না। দেবীর আগন্তুক এক ভক্ত রাজী হলে তাকে রাজা ঘোষণা করা হলো। চুন্ডা দেবির মহিমাযুক্ত একটি লাঠি দিল। রাতে নাগ রাক্ষসী এলে রাজা আঘাত করলো লাঠি দিয়ে। রাক্ষসী মরে গেল। ভোরে জনগণ দেখলো রাজা বেঁচে আছে। খুশীতে তাকে স্থায়ী রাজা রূপে বরণ করে নিলো। নাম হল গোপাল। গুপ্তযুগের পর পাল-রাজত্বের চারশ’বছরের ইতিহাস। পালবংশের পর একাদশ শতাব্দীতে সেন রাজবংশের উদ্ভব হয়। প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে তুর্কী বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির মাধ্যমে বঙ্গদেশে মুসলমান শাসনের উদ্ভব। আফগান শাসনের উদ্ভব শের খানের নেতৃত্বে। পরবর্তীতে ইতিহাস সম্রাট আকবরের বাংলা জয়। বাংলা সনের প্রবক্তা তিনি। সিরাজুদ্দৌলা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তারপর সুদীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।