স্মৃতির দৃশ্যপটে আঃ মতিন খসরু

আপডেট: এপ্রিল ২০, ২০২১
0

এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

২০২১-২২ ইং সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হয়ে গেল মার্চের ১০-১১/২০২১ ইং তারিখে। আঃ মতিন খসরু সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন অনেক ভোটে। সুপ্রীম কোর্টের বার এসোসিয়েশন বিল্ডিংএ আমাদের দু’জনের কিউবিকল চেম্বার পাশাপাশি। এ্যাকটেনশন বিল্ডিং এ আমার রুম নম্বর ৩০০৪ এবং খসরু ভাই বসতেন ৩০০৫ নম্বর রুমে। নির্বাচনের দিন দেখা হলেও পরে আর তার সাথে দেখা হয় নাই। খোজ নিয়ে জানলাম তিনি অসুস্থ্য, পরে জানলাম তিনি সম্মলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১৩/০৪/২০২১ ইং তারিখে শুনলাম তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়েছে। ১৪/০৪/২০২১ তারিখে প্রথম রমজান অপরাহ্নে টেলিভিশনে এ দেখলাম তিনি আর জীবিত নেই। চারিদিক তার মৃত্যু সংবাদের ফোন ও ক্ষুর্দে বার্তা আসতে লাগলো এবং ভরাক্রান্ত মন নিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে কলম নিয়ে বসলাম।

আমরা দু’জন দুই মেরুর রাজনীতিতে অবস্থান করলেও খসরু ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল অত্যান্ত গভীর। ১৯৭৮ ইং সনে একই বৎসর তিনি এবং আমি আইন পেশায় সনদ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে লাভ করি। এ.জে. মোহাম্মদ আলী (সাবেক এ্যাটর্নী জেনারেল ও সুপ্রীম কোর্ট বার সভাপতি), পি.সি গুজ প্রমৃখ আইনজীবী একই তারিখে আমরা বার কাউন্সিলের সনদ লাভ করেন। মতিন খসরু ভাই কুমিল্লা জেলা বার এবং আমি নারায়নগঞ্জ মহকুমা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়ে পেশায় নিযুক্ত হই। তার সাথে আমার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল যেমনটি পরবর্তী সময়ে ঘটে ছিল।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় আমি শ্রমিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় নারায়নগঞ্জ তৎসময়ে জাহাজ-শ্রমিক, ঘাট শ্রমিক প্রভৃতি শ্রমিক সংগঠনের বড় মাপের একজন নেতা যার নাম ছিল আবদুল আউয়াল, তিনি কুমিল্লা শেসন আদালতে বিচারধীন একটি মামলায় জামিন শুনানী করার জন্য আমাকে নিয়ে যান। আমার সাথে আউয়াল ভাই সহ আমার ক্লার্ক মোবারক হোসেন ছিল। সে দিন কুমিল্লায় অর্ধবেলা হরতাল চলতে ছিল। মেঘনা ও দাউদকান্দি ব্রীজ না হওয়ায় কোর্ট ধরার জন্য আগের দিনই আমরা কুমিল্লায় যেয়ে হোটেলে অবস্থান করি। হরতালের কারণে কোর্ট দেরীতে বসায় আমাকে খসরু ভাইয়ের বাড়ীতে নেয়া হলো। তিনিই উক্ত সংশ্লিষ্ট মামলার মূল আইনজীবী।

বাড়ীটি কোর্টের পাশেই। বাড়ীর নিচের তালায় তার চেম্বার। চা আনালেন, আমি এক কাপ ও তিনি একই সাথে দু’কাপ চা পান করলেন এবং বললেন “আমি এক সাথে দু’কাপ চা পান করি”। মামলাটি ছিল অত্যান্ত জটিল, কুমিল্লা জেলাধীন বাঞ্ছারামপূরের এক গ্রামের লোক পার্শবর্তী গ্রামে প্রবেশ করে বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয়, একটি শিশু আগুনেপুড়ে মৃত্যু বরণ করে। দীর্ঘ শুনানীয়ান্তে মামলার আসামীদের জামিন হয়েছিল। ট্রায়েল করার জন্য আরো কয়েকবার কুমিল্লা কোর্টে গিয়েছি। তখন থেকেই খসরু ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা যা ছির তার মৃত্যু পর্যন্ত। ব্রাহ্মনবাড়ীয়ায় চাঞ্চলকর নিদারাবাদ হত্যাকান্ডের যে জজ সাহেব (এম.এ. ওহাব) আসামী তাজুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে ছিলেন তার কোর্টেই সংশ্লিষ্ট মামলাটি ছিল। ব্রাহ্মনবাড়ীয়া তখনো কুমিল্লা জেলাধীন একটি মহকুমা।

দিনক্ষন স্বরণে আসে না তবে যতটুকু মনে পড়ে সম্ভবত ২০০২-০৩ ইং সালে হবে। খসরু ভাইয়ের মা এবং আমার পিতা একই সময়ে দীর্ঘদিন ঢাকা বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি প্রতি রাত্রেই তার মাকে দেখতে যেতেন, আমি দেখতে যেতাম আমার পিতাকে। বারডেম হাসপাতালে অনেক দিন দির্ঘসময় ধরে তার সাথে আমার আলোচনা হয়েছে এবং রাজনীতিতে আমরা দুই মেরুতে অবস্থান হওয়া সত্বেও মনোমুদ্ধকর পরিবেশ ও সহনশীলতা নিয়ে মাধুর্যপূর্ণ আলোচনা হতো।

০৫ (পাঁচ) বৎসর একটানা বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান থাকার পর ২০০৬ ইং নভেম্বর মাসে ১/১১ অবৈধ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আমার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে দেয়। আমি পূরাতন আইন পেশায় চলে আসি। ৩৩নং তোপখানা সড়কে মেহেরবা প্লাজায় ৪র্থ তলায় একটি চেম্বার নেয়া হলো। সেখানে দেখলাম আমার চেম্বারের মুখামুখি বিপরীত চেম্বারে বসেই খসরু ভাই ওকালতি করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তার চেম্বারে বিভিন্ন আলাপ চারিতা হতো। ১৮/০৪/২০০৭ ইং ১/১১ সরকার কর্তৃক আমি গ্রেফতার হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে ভাড়া নেয়া চেম্বারটি ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি তখন চেম্বার পরিবর্তন করে মাহাতাব টাওয়ারে চলে যান। উল্লেখ্য, নারায়নগঞ্জ রূপগঞ্জের প্রায় ১০০০ লোককে বিআরটিসিতে চাকুরী দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ২৬ মাস কারাভোগ করি। হাই কোর্ট ও এ্যাপিলেট ডিভিশনের রায়ে উক্ত মামলা থেকে অব্যাহত পাই।

২০০১ ইং সনের নভেম্বর মাসে বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান পদে যোগদানের পূর্বে প্রাক্তন মন্ত্রী বাবু নিতাই রায় চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি (অব:) বজলুর রহমান তালুকদার এবং আমি সুপ্রীম কোর্ট বারের মূল ভবনের ২০৫ নম্বর রুম বসতাম। বিআরটিসির চেয়ারম্যান হওয়ায় আমার নামে বরাদ্দকৃত কিউবিকলটি অন্য আইনজীবীর নামে বরাদ্দ হয়ে যায়। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাই নভেম্বর/২০০৬ ইং, ১৮/০৪/২০০৭ ইং জেলে চলে যাই এবং ১৪/০৫/২০০৯ মুক্ত হই। জেল থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় আইন পেশা শুরু করলে সুপ্রীম কোর্ট বার ভবনের এক্সটেশন বিল্ডিং এ আমার অনুকূলে রুম বরাদ্দ করা হয় যার নাম্বার ৩০০৪। উক্ত রুমে প্রবেশ করেই জানতে পারলাম যে, পার্শবর্তী ৩০০৫ রুমটি আঃ মতিন খসরুর নামে বরাদ্দ এবং নিয়মিত সেখানেই বসেন। পাশাপাশি রুম হওয়াতে বিভিন্ন সময়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে, তার অমায়িক ব্যবহার, বন্ধুসুলভ ব্যবহারে অনেকের মত আমি তার প্রতি অনেক মুগ্ধ ছিলাম। ২০২১-২২ ইং বর্ষের জন্য সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদে নমিনেশন পেপার দাখিল করার পূর্বেই হঠাৎ করেই আমার রুমে এসে বললেন যে “ভোট তো দিতে পারবেন না (রাজনৈতিক কারণে) তবে দোয়াতো করতে পারবেন।” এসব লোকের জন্য মন থেকেই দোয়া আসে, (রাজনৈতিক) প্রতিবন্ধকতা আসুক বা না আসুক।

আমার দ্বিতীয় মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে ৭/৮ হাজার মেহমান লোক দাওয়াতের প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু জাতীয় সংসদ ভবনের মাঠ ছাড়া অন্য কোন সুবিধাজনক স্থান পাওয়া যাচ্ছিল না। উল্লেখ্য, আমার বড় মেয়ের (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম খন্দকার) বিবাহ সম্বর্ধনা সেখানেই হয়েছিল। বর কনে দুই লন্ডনে লেখা পড়া করে বিধায় ৬ মাস পূর্বেই বিবাহের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সংসদ ভবনের মাঠটি পার্লামেন্ট ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে। সংসদ সদস্যদের সুপারিশ নিয়ে মাঠটি ব্যবহারের জন্য তিনবার সংসদের পার্লামেন্ট ক্লাবে, দরখাস্ত করি, কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় বার বারই বিবাহোত্তর সমবর্ধনার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটি কর্তৃক আমার আবেদনটি না মঞ্জুর হয়। যেহেতু আমি ও আমার পরিবারবর্গ বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত সেহেতু আমার আবেদন মঞ্জুর হয় নাই বলে জানতে জারি। পার্লামেন্ট মাঠ ব্যবহারের অনুমতি না নিয়ে কার্ড ছাপানো যাচ্ছি না। উপায়ন্তর না দেখে আমি পার্লামেন্ট ক্লাবের সেক্রেটারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন তাজ এম.পি’র সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন যে, আপনি নিজে দরখাস্তকারী না হয়ে সরকারী দলীয় কোন এম.পি আবেদনকারী হিসাবে স্বাক্ষার করলে বর্ণিত কারণে পার্লামেন্ট মাঠ ব্যবহারের জন্য আপনি অনুমতি পাবেন। ক্যাপটেন তাজকে শ্রদ্ধা জানাই পরামর্শ দেয়ার জন্য। তার পরামর্শ মোতাবেক আমি আঃ মতিন খসরু ভাইকে সমস্যাটির কথা জানালে তিনি বললেন যে, “তাড়াতাড়ি আবেদন ফর্মটি নিয়ে আসেন, আগামী কাল্য আামি ওমরা হজ্জে চলে যাবো।” তিনি সুপ্রীম কোর্টের পূরাতন ভবনের ১৬নং কোর্টে “শুনানী”তে অংশ নেয়ার জন্য বসা ছিলেন। দরখাস্তটি সামনে নেয়া মাত্রই সুপারিশ নয়, আবেদনকারী হিসাবে স্বাক্ষর করলেন এবং মাঠ ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া গেল। উল্লেখ্য, দরখাস্তে লিখা ছিল “আমার ভাতিজির বিবাহত্তোর সম্বর্ধনার জন্য পার্লামেন্ট মাঠ ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা।” খসরু ভাইয়ের বদন্যতায় ২৯/১২/২০১৬ ইং তারিখে মাঠটি ব্যবহার করার অনুমতি পাই।

আমি বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জোড়ালো ভাবে জড়িত জেনেও আঃ মতিন খসরু দরখাস্তে আবেদনকারী হিসাবে স্বাক্ষর করে আমার পরিবার ও আপনজনদের নিকট আমার মূখ রক্ষা করেছেন। তার এই সহানুভতি আমার পরিবার চিরদিন মনে রাখবে। আমার মেয়েকে নিজের ভাতিজী উল্লেখ করে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।

বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেও রাজনীতিতে পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ উঠে গেছে। কেউ কাহাকেও সহ্য করতে চায় না। প্রতিপক্ষ রাজনীতি বিদ দেখলেই উপকার বা সহানুভুতি দেখানো তো দূরের কথা সহ্য করতে চায় না, শক্র বলে মনে করে, তবে ব্যতিক্রম তো কিছু আছে, নতুবা সমাজ টিকে থাকতো না।

রাজনৈতিক নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় থেকেও প্রতিপক্ষের সাথে সৌহাদ্যপূর্ণ মনোভাব বজাইয়া রাখা যায়, আঃ মতিন খসরু ভাই ছিলেন এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। একজন রাজনীতিবিদ প্রতিপক্ষ রাজনীতিককে কেন বিদ্বেশ বা শক্র মনে করবে? ইতোপূর্বে এ সংস্কৃতি ছিল না। বর্তমানে চলমান বিদ্বেশমূলক সংস্কৃতি, প্রতিশোধ গ্রহণমূলক রাজনীতি, পরষ্পর পরষ্পরকে ল্যাং মারার সংস্কৃতি কি দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে? আঃ মতিন খসরু থেকে তা আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিৎ।

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)

মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬

ঊ-সধরষ: ঃ