হত্যাচেষ্টার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে যা বললেন ট্রাম্প

আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২৪
0
ছবি সংগৃহীত

নির্বাচনী সমাবেশে হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়ার পর গণমাধ্যমে দেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এ সপ্তাহের শেষে যে জাতীয় সম্মেলন রয়েছে, সেখানে বক্তৃতা তিনি নতুন করে লিখছেন। সেই বক্তব্য অসাধারণ কিছু হতে চলেছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলাকারীর নাম-পরিচয় জানালেও কেন তিনি হত্যা চেষ্টা করেছিলেন, তা এখনো জানাতে পারেনি মার্কিন তদন্তকারীরা।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার ভাষণে স্পষ্ট করেছেন যে এই হামলাকে ঘিরে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখনো অজানা।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এএফবিআই’র কর্মকর্তা কেন গ্রে এ ঘটনার পেছনে নিরাপত্তার ব্যর্থতাকে দোষারোপ করছেন।

অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভাষণে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন, সেইসাথে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিষ্পত্তি করার আহ্বান জানিয়েছেন।

ট্রাম্পের ওপর হামলা পরবর্তী যা ঘটেছে এবং হামলাকারীর সম্পর্কে সর্বশেষ যেসব তথ্য জানা যাচ্ছে-

হামলার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প
ট্রাম্প ওই হামলার পর শনিবার রাতে গণমাধ্যমকে দেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি তার জাতীয় সম্মেলনের বক্তৃতা সম্পূর্ণ নতুনভাবে লিখবেন।

সেখানে জো বাইডেনকে সমালোচনার পরিবর্তে ‘ঐক্যের’ বার্তায় গুরুত্ব দেয়ার কথা জানান তিনি।

‘বৃহস্পতিবার আমি যে বক্তৃতা দেবো সেটা বিশেষ কিছু হতে যাচ্ছে,’ মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন এক্সামাইনারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

‘এই বক্তব্য এখনো দেয়া হয়নি। তবে দিলে, সেটা অসাধারণ বক্তব্যের মধ্যে একটি হতে চলেছে।’ তিনি আরো বলেন, এই বক্তব্যের বেশিরভাগই কথাই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিভিন্ন নীতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে।

‘সত্যি বলতে, এই বক্তৃতা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু হবে। দেশকে এক করার এটাই সুযোগ। আমাকে সেই সুযোগ দেয়া হয়েছে।’

গোলাগুলির সেই মুহূর্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি জানতাম যে পৃথিবী এই ঘটনা দেখছে। আমি জানতাম যে ইতিহাস এর বিচার করবে, এবং আমি জানতাম যে এই মানুষদের জানাতে হবে যে আমরা ঠিক আছি,’ তিনি ওয়াশিংটন এক্সামাইনারকে বলেন।

সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্টের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকিতে রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হবেন।

নির্বাচনে তার রানিং মেট কে হবেন তাও তিনি এই সম্মেলন থেকে ঘোষণা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বন্দুক হামলার ঘটনায় এই সম্মেলন পিছিয়ে শনিবার নেয়া হলেও ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন যে এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি একজন ‘হামলাকারী’ বা সম্ভাব্য আততায়ীর কারণে সম্মেলনের সময়সূচিতে পরিবর্তন করতে পারি না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন যে তিনি সোমবার থেকে শুরু হওয়া রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে যোগ দিতে উইসকনসিনের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।

তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওই হামলার জেরে তার নিজের নির্ধারিত প্রচারণামূলত কার্যক্রম স্থগিত করেছেন এবং পিছিয়ে দিয়েছেন। বাইডেন মঙ্গলবার তার প্রচারাভিযানে ফিরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাইডেনের রাষ্ট্রীয় ভাষণ
এদিকে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পেনসিলভানিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং ওই সমাবেশে একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।

হামলার কয়েক ঘণ্টা পর তিনি ট্রাম্পের সাথে ফোনে কথা বলেছেন এবং এই হত্যা প্রচেষ্টাকে ‘জঘন্য’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

তিনি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বার বার জোর দিয়ে বলেছেন যে ‘আমাদের রাজনীতিতে উত্তাপ কমানোর’ সময় এসেছে। এজন্য তিনি ব্যালট বাক্সে ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিষ্পত্তি করার আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশের ভেতর বড় ধরনের মতবিরোধ থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করলেও রাজনীতি অবশ্যই ‘শান্তিপূর্ণ বিতর্কের ক্ষেত্র’ হতে হবে বলে তিনি বলেন।

ওই হামলায় কোরি কমপেরেটোর নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত হন। যিনি পেশায় ছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক দমকল প্রধান।

এছাড়া হামলায় ডেভিড ডাচ (৫৭) এবং জেমস কোপেনহেভার (৭৪) নামে আরো দু’জন গুরুতর আহত হন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন সমাবেশে নিহত কোরি কমপেরেটোরকে ‘হিরো’ বা ‘নায়ক’ সম্বোধন করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

নিজ পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে ওই ব্যক্তি নিহত হন।

এছাড়া বন্দুক হামলা প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, হামলার মোটিফ বা এর পিছনে উদ্দেশ্য এবং হামলাকারী কিভাবে এর প্রস্তুতি নিয়েছে এই বিষয়গুলো এখন অজানা।

এদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক বক্তব্য প্রচার করছে বলে রিপাবলিকানরা যে অভিযোগ তুলেছে সে বিষয়ে কোনো জবাব দেননি বাইডেন।

তবে তিনি ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের বিশৃঙ্খলার ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেন এবং সাবেক হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির স্বামীর ওপর হামলার কথা তুলে ধরেন।

পরিশেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, শালীনতা, মর্যাদা এবং ন্যায্যতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

তদন্তের সর্বশেষ
ট্রাম্পের ওপর বন্দুকধারীর হামলার ঘটনার তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই এবং সিক্রেট সার্ভিস।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার ভাষণে স্পষ্ট করেছেন যে এই হামলাকে ঘিরে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখনো অজানা।

এফবিআই অ্যাজেন্টরা বলেছে যে তারা হামলার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে সে বিষয়ে তদন্ত করছে এবং তাদের বিশ্বাস যে বন্দুকধারী একাই এই কাজ করেছে।

‘আমরা এখনো বন্দুকধারীর উদ্দেশ্য জানি না। আমরা তার মতামত বা সংশ্লিষ্টতা জানি না। আমরা জানি না তার কোনো সাহায্য বা সমর্থন ছিল না কি সে অন্য কারো সাথে যোগাযোগ হয়েছিল কি না,’ তিনি বলেন।

ট্রাম্পকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বে ছিল সিক্রেট সার্ভিস। এখন এই সিক্রেট সার্ভিসের ওপরেই তদন্ত করছে একাধিক সংস্থা এবং বিভাগ।

এফবিআই এর দাবি এটি বেশ ‘আশ্চর্যজনক’ যে একজন বন্দুকধারী কিভাবে মঞ্চে তাক করে গুলি চালাতে পারলো, কেউ তাকে আগেই কেন পরাস্থ করল না।

এফবিআই-এর স্পেশাল অ্যাজেন্ট কেভিন রোজেক বলেছেন, বন্দুকধারী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বলে এখন পর্যন্ত কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে তার হামলার পেছনে স্পষ্ট উদ্দেশ্যও পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, সন্দেহভাজনদের মোবাইল ফোন এবং হামলায় ব্যবহৃত বন্দুক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য এফবিআই-এর ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত বন্দুকধারীর ব্যাপারে যা জানা গিয়েছে তা হলো, ওই বন্দুকধারীর নাম থমাস ক্রুকস, যার বয়স ২০ বছর। তিনি ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

তিনি পেশায় ছিলেন পেনসিলভানিয়ার একটি নার্সিং হোমে রান্নাঘরের সহায়ক। দুই বছর আগেই তিনি হাইস্কুল সম্পন্ন করেন।

তার সহকর্মী এবং শিক্ষকরা তাকে বেশ বিনয়ী, মেধাবী এবং শান্ত চরিত্রের মানুষ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

রাষ্ট্রীয় ভোটার রেকর্ড থেকে জানা যায়, ক্রুকস একজন নিবন্ধিত রিপাবলিকান ভোটার ছিলেন, যিনি ২০২১ সালে উদারপন্থী প্রচারাভিযান গ্রুপ অ্যাক্টব্লুকে ১৫ ডলার দান করেছিলেন।

ক্রুকসের অতীতের কোনো অপরাধের বিষয়ে বা তিনি কোনো বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন কি না এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। তিনি হামলার সময় এআর স্টাইলের ৫৫৬ রাইফেল ব্যবহার করেছেন তা আইনি বিধি মেনেই কেনা হয়েছিল বলে এফবিআই জানতে পারে।

মূলত বন্দুকটি অভিযুক্তের বাবার নামে নিবন্ধিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, বাবার অনুমতি ছাড়াই ক্রুকস এই অস্ত্র বহন করছিলেন। তিনি পেনসিলভানিয়ার একটি অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্লাবেরও সদস্য বলে জানা গিয়েছে।

তার গাড়িতে ‘সন্দেহজনক ডিভাইস’ পাওয়া গেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এবং এটি কী ধরনের ডিভাইস তা শনাক্তে প্রযুক্তিবিদরা কাজ করছেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার রাষ্ট্রীয় ভাষণে জানিয়েছেন, এই ঘটনায় স্বাধীনভাবে তদন্ত চলছে এবং তদন্তে কোনো অগ্রগতি হলেই তিনি সবাইকে অবহিত করবেন।

এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্ত্রী এবং সাবেক ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প বন্দুকধারীকে ‘দানব’ বলে অভিহিত করেছেন এবং আমেরিকানদের ‘ঘৃণার ঊর্ধ্বে ওঠার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

নিরাপত্তার ব্যর্থতার অভিযোগ
এফবিআই এর সাবেক বিশেষ অ্যাজেন্ট কেন গ্রে এই ঘটনার পেছনে নিরাপত্তার ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করেছেন।

টুডে প্রোগ্রামকে গ্রে বলেছেন যে বন্দুকধারী যতটা কাছাকাছি গিয়েছে, তাতে এটাই স্পষ্ট হয় যে সেখানে ‘নিরাপত্তায় ব্যর্থতা’ ছিল এবং এফবিআই এই ধরনের সমাবেশে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

এখনো অবধি, এই ঘটনাকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদের একটি সম্ভাব্য ঘটনা হিসেবে নিয়ে তদন্ত করছে এফবিআই, যদিও হামলার উদ্দেশ্য এখনো অস্পষ্ট।

গ্রে বলেন, এ ধরনের যেকোনো ইভেন্টের আগে, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পুরো এলাকাটি জরিপ করে থাকেন। এটা নিশ্চিত হতে যে সেখানে কোনো সম্ভাব্য হুমকি রয়েছে কি না।

যদি আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেটা কী ধরনেরর হুমকি হতে পারে, কোথা থেকে আসতে পারে এবং কিভাবে ভিড় থেকে কাউকে বের করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করে।

গ্রে সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পকে ঘটনাস্থল থেকে সরাতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ‘ভয়ঙ্কর দীর্ঘ সময়’ লেগেছিল। সেখানে যদি কোনো দ্বিতীয় বন্দুকধারী থাকতো এই সময়ে তিনি আরেকটি সুযোগ পেয়ে যেতেন।

বিবিসি ভেরিফাইড ভিডিও বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েছে যে বন্দুকধারী সাবেক রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প থেকে দুই শ’ মিটারেরও কম দূরত্বের একটি ওয়্যার হাউজের ছাদ থেকে গুলি করে।

তবে, একটি সিক্রেট সার্ভিস স্নাইপার দিয়ে পাল্টা গুলি চালিয়ে বন্দুকধারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে, সংস্থাটি জানিয়েছে।

পরের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সশস্ত্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থারা অস্ত্রসহ সেদিকে ছুটে যাচ্ছিল।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রেসিডেন্সিয়াল রাজনীতিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।

ম্যাগনেটিক স্ক্রিনিং, বুলেটপ্রুফ লিমোজিন এবং ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সিক্রেট সার্ভিস অ্যাজেন্টরা তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনা সবাইকে বিস্মিত করেছে।

সূত্র : বিবিসি