২ লক্ষ প্রতিবন্ধির জন্য সরকারী বরাদ্দের ভাতার অর্ধেকের বেশি আত্মসাত হয়েছে – টিআইবি

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
0

ট্রানস্পারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বলেছে , ২ লক্ষ প্রতিবন্ধির জন্য সরকারী বরাদ্দের ভাতার অর্ধেকের বেশি আত্মসাত হয়েছে । রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ বাস্তবসম্মত ও যথেষ্ট নয় এবং যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যথাযথভাবে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছায় না।

‘উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিবন্ধিতা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীষর্ক গবেষনা প্রতিবেদনে অনিয়ম -দুর্ণীতিসহ সার্বিক পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি।

সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ও গবেষনা উপদেষ্টা ড.ইফতেখারুজ্জামান প্রতিবেদন তুলে ধরে ধরেন।

তিনি জানান , ডিসেম্বর ২০১৯ সাল থেকে নভেম্বর ২০২০ সাল পর্যন্ত এ গবেষনা কার্যাক্রম চালানো হয়েছে।

দুর্নীতির তথ্য উপাথ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যথাক্রমে — প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি ও তাদের পরিচর্যাকারী বা অভিভাবক, সমাজসেবা অধিদফতর ও শাখা কার্যালয়, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল (এনডিডি) সুরক্ষা ট্রাস্ট, প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আদালত, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে ব্যবহৃত আশ্রয়কেন্দ্রসমূহ, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশেষজ্ঞ
সংশ্লিষ্ট আইন, বিধিমালা, নীতিমালা, নির্দেশিকা, প্রাসঙ্গিক নথি, গবেষণা প্রতিবেদন, টিআইবি পরিচালিত জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ এর তথ্যভান্ডার, বার্ষিক প্রতিবেদন, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ ও প্রবন্ধ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

টিআইবি দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে জানায় যে , প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ ও সুবর্ণকার্ড সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার এবং তার সহকারীদের একাংশের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধিতী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে ১,০০০-১,৫০০ টাকা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার “অনেক ব্যস্ত” থাকায় প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিরা

সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি হয়রানির শিকার হচ্ছে। উপজেলা/শহর সমাজসেবা কার্যালয়ে তথ্যভান্ডারে নাম অন্তর্ভুক্তকরণে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি বা তার নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে ১০০-২০০ টাকা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য, সচিবালয়, জেলা প্রশাসন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ কর্তৃক তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত জন প্রকৃত প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও সুবর্ণকার্ড প্রদানের জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে তদবির করে।

তদবিরের মাধ্যমে যাদের সুবর্ণকার্ড দেওয়ার কথা নয় তাদের কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রকৃত প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিরা সুবর্ণকার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের একাংশের বিরুদ্ধে সুবর্ণকার্ডের জন্য ১,০০০-৩,০০০ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। আবার সুবর্ণকার্ড থাকা সত্ত্বেও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া এবং প্রাপ্য সুবিধা পেতে মধ্যস্থতা করার অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবন্ধী ভাতা সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের স্বদিচ্ছার ওপর। ভাতা প্রাপ্তির কার্ড পেতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের একাংশ কর্তৃক প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১,০০০-৩,০০০ টাকা নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ রয়েছে। টিআইবি পরিচালিত সেবাখাতে দুর্নীতি বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ এর তথ্য বিশ্লেষণ অনুযায়ী ২৩.৪% খানাকে ভাতায় অন্তর্ভুক্ত হতে নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ দিতে হয়েছে। এছাড়া সময়ক্ষেপণ, স্বজনপ্রীতির ও প্রতারণার শিকার যথাক্রমে ১৯.৩% খানা, ১১%খানা এবং ৭.৯% খানা।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে যে নতুন ২ লক্ষ প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তি ভাতার আওতায় এসেছে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ভাতার অর্থের অংশবিশেষ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রথমবার ভাতার বইয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তার স্বাক্ষর লাগে বিধায় উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের একাংশ অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তির প্রথম কিস্তি পেতে ২৪%-৬৭% অর্থ আত্মসাৎ হয়ে থাকে।

ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কর্তৃক ক্রয়কৃত বিভিন্ন থেরাপি মেশিন এবং প্রতিবন্ধিতাসহ শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক উপকরণ নি¤œমানের, যদিও এ ধরনের ক্রয়ের জন্য যথাযথ আর্থিক বরাদ্দ থাকে। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একাংশের পরিচিত ও আত্মীয়দের বাসা ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যোগসাজশের মাধ্যমে উভয়পক্ষ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অভিযোগ রয়েছে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ভাড়া করা কেন্দ্রের অবকাঠামো প্রতিবন্ধিবান্ধব নয়।

এনজিওদের অনুদান সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন শর্তসাপেক্ষে এনজিওদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। সাহায্যপ্রাপ্ত এনজিওদের একাংশ ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে অনুদান পেয়ে থাকে। অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২০,০০০-৭০,০০০ টাকা অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ দিতে হয় বিধায় এসব এনজিও অঙ্গীকারবদ্ধ সকল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে না।

সভার কার্যবিবরণী সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
বছরের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কোনো কোনো উপজেলা কমিটি সভা না করেই সভাপতিসহ সকলের স্বাক্ষর গ্রহণ করে সভার কার্যবিবরণী তৈরি করে।

পরিবহন ভাড়া সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতি
গণপরিবহনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিদের কার্ড থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত অর্ধেক ভাড়া না নিয়ে সম্পূর্ণ ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সেবার খাতভেদে প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তির দুর্নীতির শিকার হওয়ার চিত্র: টিআইবি পরিচালিত সেবাখাতে দুর্নীতি বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ এর তথ্য বিশ্লেষণ অনুযায়ী দেখা যায় প্রতিবন্ধিতাসহ ব্যক্তিরা তাদের অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মতো সকল সেবা নিতেই অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ সকল ক্ষেত্রেই তারা কম-বেশি দুর্নীতির শিকার হয় ।