৩৩৩ এ ফোন দিয়ে খাবার সহায়তা চেয়ে চড়া মূল্য গুণতে হচ্ছে না’গঞ্জের ফরিদউদ্দিনকে

আপডেট: মে ২৩, ২০২১
0

এম আর কামাল, নারায়ণগঞ্জ :

ফরিদ উদ্দিনের তার আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। কাজ করতে পারেন না। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্য মেয়ে টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগান। প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য নিয়মিত ওষুধ লাগে। তার নিজেরও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দুই চোখেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনবার স্ট্রোক করেছেন। কোনো রকমের সঞ্চয় নেই তার। নিজের ওষুধ কেনারও পয়সা নেই। ছয় ভাই ও এক বোন মিলে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে চারতলা ভবন করেছেন।

চারতলায় উপড়ে টিন শেড দেওয়া দু’টি ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ফরিদ। নিজে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন বলেই সরকারি সহায়তার জন্য ৩৩৩ ওই নম্বরে খাদ্য চেয়ে কল করেছিলেন বলে জানান এই বৃদ্ধ। কিন্তু সহায়তা চেয়ে চড়া মূল্য গুণতে হচ্ছে তাকে। ১০০ জনকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। নিজের স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বিক্রি ও ধার-দেনা করে বিতরণের জন্য এসব খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন বলেও জানান। এমনকি স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর থেকেও ধার নিয়েছেন ১০ হাজার টাকা।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা কাশিপুর এলাকায় সরকারি খাদ্য সহায়তা চেয়ে ৪তলা বাড়ির মালিক ফরিদ উদ্দিনের ৩৩৩ এ ফোন করার চড়া মাশুল এবং জরিমানা দেয়ার পর নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
জরিমানার শর্ত মোতাবেক প্রায় ১লাখ টাকা খরচ করে
শনিবার দুপুর ১শ জন অসহায়ের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন ফরিদ
উদ্দিন।

জরিমানা দেয়ার পর ফরিদ উদ্দিনের পরিবার দাবী করেন তারা আসলে অসহায়। যে ৪ তলা বাড়ির কথা বলা হয়েছে তার পুরো মালিক নয় ফরিদ উদ্দিন। পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ২ টা রুমের মালিক তিনি।
জেল যাওয়ার ভয়ে ধার দেনা করে জরিমানার শর্ত মোতাবেক ১শজনের খাবার দিয়েছেন।
এজন্য স্থানীয় মেম্বার আইউব আলীকে দুষছে ফরিদ উদ্দিনের পরিবার।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান , ফরিদ উদ্দিন যদি সত্যিই অসহায় হয়ে থাকেন তাহলে তাকে সহযোগিতা করা হবে। ত্রাণ সহায়তা দিতে তার যে খরচ হয়েছে সেই অর্থও তাকে ফেরত দেওয়া হবে। দুইদিন সময় পাওয়ার পরও তারা কেন প্রশাসনকে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাননি সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।

জানা গেছে,নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগবাড়ি শেষ মাথা এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। বলেন, নিয়মিত এফএম রেডিও শোনেন তিনি। রেডিওতে সংবাদে তিনি জেনেছেন ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায়। সরকারি সহায়তা পেতে তিনি কল করেছিলেন ওই নম্বরে। কিন্তু সহায়তা তো পাননি, উল্টো তিনি চারতলা ভবনের মালিক এমন তথ্যের কারণে প্রায় লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে তাকে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরার নির্দেশে তাকে ১০০ জনের মাঝে চাল, আলু, ডাল, লবন ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে হয়েছে।

ফরিদ উদ্দিনের ছোট ভাই শাহীন ও আরেক ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিস বেগম বলেন, ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো না। চারতলায় টিনশেডের দু’টো ঘরই তার সম্বল। অথচ তাকে চারতলা বাড়ির মালিক বলে জরিমানা করেছেন ইউএনও। বিলকিস বলেন, ‘১০০ জনের খাবার কেনার টাকা কই পাবেন আর না দিতে পারলে জেল হবে, এই লজ্জায় শুক্রবার রাতে দুইবার আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন আমার ভাসুর। মেয়েটা অবিবাহিত তাই লোকলজ্জার ভয়ে গয়না বিক্রি, ধানদেনা করে ৭০ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন।’

তবে সদর ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, সরকার ৩৩৩ কলসেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দুঃস্থ মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে তাদের সংকটের কথা জানালে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ফরিদ উদ্দিন নামে ওই ব্যক্তিও খাদ্য সহায়তা চেয়ে ওই নম্বরে কল করেন। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ব্যক্তি চারতলা ভবনের মালিক এবং যথেষ্ট স্বচ্ছল। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে ফরিদ উদ্দিনকে ১০০ গরীব মানুষকে সরকারি খাদ্য সহায়তার অনুরূপ প্যাকেট বিতরণ করার নির্দেশ দেন ইউএনও।

শনিবার খাদ্যসামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন ইউএনও আরিফা জহুরা, সদরের এসিল্যান্ড হাসান বিন আলী, কাশীপুর ইউপি’র ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আইয়ুব আলীসহ স্থানীয় এলাকাবাসী। এ সময় বিতরণ করা প্রতি প্যাকেটে সরকারি সহায়তার মতো ৫ কেজি চাল, ১ কেজি করে আলু, ডাল, সয়াবিন তেল, লবন ও পেয়াজ ছিল। এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার সময় ইউএনও’র সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফরিদ উদ্দিন ও তার পরিবারের লোকজন। তারা জানান, ধার-দেনা করে তারা এই খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন। তাদের পারিবারিক অবস্থা অস্বচ্ছল ছিল বলেই ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। তারা চারতলা ভবনের মালিক না।

ফরিদ উদ্দিনের বাড়ির পাশেই স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর বাড়ি। তিনি ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থার কথা জানতেন। যেদিন ইউএনও তাকে ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইয়ুব আলী। তিনি কেন ইউএনও’কে সঠিক তথ্য জানালেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ইউপি সদস্য দাবি করেন, তিনি ইউএনও’কে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। অল্প জরিমানা করারও অনুরোধ তিনি করেছিলেন। তবে ইউএনও তার কথায় পাত্তা দেননি বলে দাবি আইয়ুব আলী।

খাদ্য সহায়তা চাওয়া ফরিদ উদ্দিন সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল ছিল কিনা এবং লঘু পাপে তিনি গুরুদন্ড পেলেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে এসব খোঁজখবর নেওয়া হয়। ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী তাকে ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক স্বচ্ছলতার তথ্যই দিয়েছিলেন। এমনকি সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েও তিনি একই তথ্য পেয়েছেন বলেই ওই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে যেহেতু তার আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টি সামনে এসেছে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই করবেন বলেও জানান ইউএনও।##