‌’এক দফার আন্দোলন শুরু হলে রাজপথেই সব প্রশ্নের মিমাংসা হবে’

আপডেট: অক্টোবর ৪, ২০২২
0

“ষোল বছরব্যাপী (এক এগারোর দুই বছরসহ) অবর্ণনীয় জুলুম সয়েও এ দেশের রাজনীতিতে আজও বিএনপিই যে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেটি গত দুই মাসে রাজপথে আবারও প্রমাণিত হয়েছে”


মাহমুদুর রহমান

দীর্ঘ দিন পর এই আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দল রাজপথে সোচ্চার হয়েছে। ২০১৮ সালে হাসিনার মধ্যরাতের নির্বাচনের ফাঁদে ড: কামালের নেতৃত্বে অনেকটা স্বেচ্ছায় পা দেওয়ার পর প্রায় সাড়ে তিন বছর লেগেছে শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলটির রাজনৈতিক ভুলের ধাক্কা সামলাতে। জিয়া পরবর্তী বালাদেশের গত চার দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণ বানোয়াট মামলায় আওয়ামী আদালত সাজা দিয়ে কারাগারে নিলেও কোন এক রহস্যময় কারণে বিএনপি সেই অবিচারের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে মাঠে নামে নাই। দলের নীতিনির্ধারকরা দৃশ্যত: নেত্রীর মুক্তির চেয়ে তখন হাসিনার অধীনে সে বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনে অংশ নেওয়াকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তারা সম্ভবত: খালেদা মু্ক্তির সর্বাত্বক আন্দোলন করে আগাম শক্তি ক্ষয় করতে চান নাই।

বিস্ময়ের ব্যাপার হল, অলীক নির্বাচনের সেই মায়াজাল থেকে জামাতে ইসলামীও মুক্ত থাকতে পারে নাই। উচ্চ আদালত থেকে ইসলামপন্থী দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেলেও তারা বিএনপির সাথে দর কষাকষি করে জোটের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টির ঝুঁকি নিয়েও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনী তামাশায় অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার সাথে সুবিধাবাদিতারও প্রমাণ দিয়েছিল। অবশ্য নির্বাচনের আগেই প্রাণ বাঁচাতে অধিকাংশ জামাত প্রার্থীদের সেই সময় ঢাকায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল। এলাকায় থেকে লড়াই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই।

নির্লজ্জ ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে প্রথমে সংসদ বর্জনের ঘোষণা দিলেও বিএনপি পরবর্তীতে সংসদে শুধু যায় নাই, তারা সংরক্ষিত মহিলা আসনেও একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দলের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছে। এখনও বিএনপির কয়েকজন তথাকথিত সংসদ সদস্য হাসিনার খোয়াড়ের শোভা বর্ধন করে চলেছেন । তারা সেখানে বসে অম্লান বদনে শহীদ জিয়া এবং বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে কুৎসিত আওয়ামী নর্তকীদের অশ্লীল গালাগালি শোনেন। যাই হোক, ষোল বছরব্যাপী (এক এগারোর দুই বছরসহ) অবর্ণনীয় জুলুম সয়েও এ দেশের রাজনীতিতে আজও বিএনপিই যে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেটি গত দুই মাসে রাজপথে আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

শেখ হাসিনার চৌদ্দ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লুন্ঠন হওয়ার সাথে বাংলাদেশের জনগণও তাদের সকল মৌলিক অধিকার হারিয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একদা মুক্তিযুদ্ধ করা জাতি আজ আওয়ামী ক্যাডার এবং পুলিশের বুটের নীচে নিষ্পেষিত হচ্ছে। এদিকে দেশের অর্থনীতি ক্রমেই রসাতলে যাচ্ছে। ফাঁকা উন্নয়নের ঢাক পেটানো সরকার আজ বাজেটের অর্থ সংস্থানের জন্য বিশ্ব ব্যাংক আর আইএমএফ এর কাছে দৌড়াচ্ছে। দেশের উপার্জনের প্রধান দুই খাত, রপ্তানি এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থের জোগান প্রতিমাসে কমতে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আশংকাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। শেখ পরিবারের লুটেরার দল বাংলাদেশের নামে বিদেশ থেকে ঋণ এনে সেই অর্থ থেকে আবার বিদেশেই নিজেদের ব্যাংক একাউন্টে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। ফলে বংশ পরম্পরায় দুর্নীতিবাজ শেখ পরিবারের ব্যাংক একাউন্ট স্ফিত হলেও জনগণ অতিরিক্ত ঋণের বোঝার নীচে চাপা পড়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, এক বছর আগে ডলার কিনতে ৮৫ টাকা লাগলেও এখন দিতে হচ্ছে ১১০ টাকা। অর্থাৎ এই এক বছরে টাকার মান কমেছে ২৯ শতাংশ। অথচ নির্লজ্জ, জালিয়াত সরকার এখনও দাবি করে চলেছে যে, মুদ্রাস্ফিতি নাকি মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ বেড়েছে। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষেরা কাঁচা বাজারে গেলে বুঝতে পারছেন যে, ভারতের গোলাম সরকার তাদের সাথে কেমন নিষ্ঠুর ভাওতাবাজি করে চলেছে। পরিসংখ্যানে নানারকম জালিয়াতির মাধ্যমে সবাইকে বোকা বানানো হচ্ছে।

এতে শেখ হাসিনার অবশ্য কিছু যায় আসে না। তার বাংলাদেশকে ধ্বংস এবং পিতার হত্যার কারণে জনগণের উপর বদলা নেওয়ার মিশন সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন যে দিন অথবা মুহূর্তে তিনি ক্ষমতা এবং পৃথিবী থেকে বিদায় নিন না কেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভুগতে হবে তো বাংলাদেশের জনগণকেই। বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনা যেভাবে কলূষিত ও ধ্বংস করেছেন তাতে করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুননির্মাণ জাতির জন্য এক অতিকায় চ্যালেঞ্জ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। হাসিনা শাসনের প্রতিটি দিনে বাংলাদেশ সর্বনাশের আরও অতলে নিমজ্জিত হচ্ছে। এই দানবকে না সরালে দেশ এবং জাতির মুক্তি নাই। এমতাবস্থায় যত দ্রুত এই দানবকে সরানো যায় ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল। সকল দেশপ্রেমিক শক্তির এখন কর্তব্য সকল শক্তি একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসা।

দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত ছয় মাসেরও অধিক কাল ধরে দেশের ছোটবড় বিরোধী দলসমূহের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করে যাচ্ছে। দলটির মহাসচিব ক্রমাগতভাবে বলে যাচ্ছেন যে, তারা সকল দলের সাথে আলোচনাক্রমে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছেন যা নাকি অতি শীঘ্রই দেশবাসীকে জানানো হবে। প্রথম দফার বৈঠক শেষ করে বিএনপি গতকাল জেনারেল (অব:) ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টিকে দিয়ে দ্বিতীয় দফার বৈঠকও আরম্ভ করেছে। আপাত: দৃষ্টিতে উদ্যোগটি শুভ মনে হলেও এই বিলম্বিত প্রক্রিয়া শেখ হাসিনার অবৈধ, ফ্যাসিস্ট শাসনকে দীর্ঘায়িত করছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার যে ফ্যাসিবাদি, দুর্নীতিপরায়ন, এবং ভয়ানক মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত এটা এখন সারা বিশ্বেই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। দেশের অভ্যন্তরেও এই সরকার চরম অজনপ্রিয়। শেখ হাসিনার পতনের জন্য বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে। জনগণ তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচন করার এবং সার্বিক মৌলিক অধিকার ফিরে পেতে চায় যা জালিম শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে জনতার তাবৎ দাবী এখন হাসিনা পতনের এক দফায় পরিণত হয়েছে। সকল বিরোধী দল মিলে এত মিটিং করে দাবিনামার যে ফর্দ আপনারা প্রস্তুত করছেন সেটা কার কাছে পেশ করবেন? ফ্যাসিস্ট হাসিনার কাছে? এই প্রকার দাবিনামা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও তো গণভবনে ড: কামালের নেতৃত্বে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তাতে কি কোন ফল হয়েছিল?

অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হতে পারে। তবে সেটা কেবল নির্বাচনকালিন, স্বল্পমেয়াদী সরকারের কাঠামো সংক্রান্ত। ১৯৯০ সালে সংবিধানের কোন ধারা মেনেই বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমদের সরকার গঠিত হয় নাই। পরবর্তী সংসদ সেই বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালিন, তত্বাবধায়ক সরকারকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বৈধতা দিয়েছিল। ২০০৭ সালের মইন-ফখরুদ্দিনের দুই বছর ক্ষমতা ধরে রাখার কোনরকম সাংবিধানিক বৈধতা ছিল না। উচ্চ আদালত থেকে তাদেরকে সেই বৈধতা আনতে হয়েছিল। ২০২২ সালে এসে, শেখ হাসিনার পরিবর্তে কে, এমন প্রশ্ন যারা করেন তারা প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকেই ক্ষমতায় রেখে দিতে চান। বাংলাদেশের জনগণ তদের সরকারপ্রধান নির্বাচন করার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে। অতএব, রাষ্ট্রের পরবর্তী নেতা তাদেরকেই বেছে নিতে দিন। নির্বাচনকালিন সরকারের অধীনে নির্বাচনে সকল দলই যার যার ম্যানিফেস্টো নিয়ে জনগণের কাছে গেলে তারাই স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যত সরকারকে নির্বাচিত করবে।

এক দফার আন্দোলন শুরু হলে রাজপথেই উপরের সকল প্রশ্নের মিমাংসা হয়ে যাবে। পাকিস্তানি আমলে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জামানার সকল সফল আন্দোলন সরকার পতনের এক দফাকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারিদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্যও দ্রুত আন্দোলনের ঘোষণা জরুরী। অতএব, আর বিলম্ব নয়। জাতীয়তাবাদি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে, সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে সাথে নিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের এক দফা আন্দোলনের ডাক দিন। ইনশাআল্লাহ, জালিমের পতন অবশ্যম্ভাবি।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
০৩/১০/২০২২