‌`এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে’

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২
0
ছবি : সিনিয়র ফটো সাংবাদিক নাসিম শিকদার

কাশফুল, শাদা মেঘ, নীল বরণ যদি না’ই থাকে শরৎ শ্যামলা থেকে যায়। কাশফুল শরতের রূপমাধুর্যের তীর্যক তিল। এই শরতেই নদীর পাড়ে, বিস্তীর্ণ চরে, বালুর হোগলা ভেলায় শাদা শাড়ি পড়া কাশফুল ফুটে ওঠে। দোলানার মতো দোল খেতে থাকে দুলে দুলে। শিমুল তুলার মতন আকাশে গাড়ি চালায় মেঘ, নীল তার নিজস্বতা নিয়ে রং ছড়ায়।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এও টের পেয়েছেন, যে বৈশ্বিক পরিবর্তনে একদিন ষড়ঋতুর রূপের শাণ তরল হয়ে আসবে কালের ক্রমে- সেদিন শরৎ প্রেমিরা যেন তাঁর লিপি থেকে জেনে নিতে পারে নিটোল ভাঁজের শরৎ কী ছিল, কেমন ছিল!! সে কারণেই তিনি শরৎকে একটি খাপে ভরে দেখেননি। তিনি তার সাহিত্যের ভাষায় দেখিয়েছেন যে—শরৎ প্রকৃতির এক কন্যা, সে কন্যার আগমনে মা প্রকৃতির সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, রূপ রস অবলোকন করেছেন নিবিড়ভাবে। শুধু শরতের ভিতর দিয়ে বিমোহিত হেঁটে গেছেন তা বলার ধৃৃষ্টতা নেই। তিনি শরৎকে ধরতে চেয়েছেন। নিজের রঙে আঁকতে চেয়েছেন।


‘শরতে আজ কোন্ অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে।/ আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।/ নীল আকাশের নীরব কথা শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা/ বেজে উঠুক আজি তোমার বীণার তারে তারে।/ শস্যক্ষেতের সোনার গানে যোদ দে রে আজ সমান তানে,/ ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারা।/ যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুখে,/ দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে।’’ (স্বরবিতান ২)

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত আল্পনা এঁকেছেন। তাঁর ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ’, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক’-সহ অনেক গানই শরৎ-প্রকৃতির লাবণ্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে। শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে উঠেছে এ সব রচনায়: “এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ রথে। /দলি শাপলা শালুক শত দল এসো রাঙায়ে তোমার পদতল/নীল লাল ঝরায়ে ঢলঢল এসো অরণ্য পর্বতেi”

ষড়ঋতুর সব ঋতুর সাথে শরৎ ঋতুও কবিগুরুকে অনন্য মাত্রায় আন্দোলিত করেছে। প্রকৃতি থেকে আলো এসে ঠিকরে পড়েছে তাঁর অন্তর উঠানে যেখান থেকে তিনি বিশ্বকে দেখেছেন শিশুর মতো এক সরলতায়। শুদ্ধতায়। শুভ্রতায়। তাই যখন যা তাঁর চোখের চোখে পড়েছে তখনই তিনি তা হাতের মুঠোয় পুরেছেন মমতায়। তারপর নিজের রঙে আঁকিয়ে অক্ষরের রূপে বের করেছেন জাগতিক পান্ডুলিপিতে। এই বাংলার শরৎ ঋতু তাঁকে প্রেমে পাগল করে ছেড়েছে তা আমরা তাঁর রচনায়ই দেখতে পাই। অসংখ্য কবিতা, গান, দৈনন্দিন রচনায় এই রবীবাবু শরৎকে টুকেছেন অমর সাহিত্য বয়ানে। ঋতুর রূপে বুঁদ না হলে এমন রচনা কোন কালেই সম্ভব না। রবীন্দ্রনাথ- শরৎ রূপের মুগ্ধতায় সত্যিই যেন বুঁদ হওয়া এক শরৎ কবি।

শরৎ যেমন বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি সাহিত্যকর্মেও শরতের উজ্জ্বল
উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা প্রকৃতি বর্ণনায় শরৎকালকে ব্যবহার করেছেন; শরৎ বন্দনায় পঞ্চমুখ থেকেছেন শব্দভাষ্যে। তাই শারদ সম্ভার নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। চর্যাপদের পদকর্তা থেকে শুরু করে আজকের তরুণতম কবির রচনায়ও শরৎকাল তার নান্দনিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উদ্ভাসিত। বাঙলা
সাহিত্য জগতে মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। এ কাব্যে তিনি মেঘের খামে পুরে প্রিয়ার কাছে চিঠি পাঠানোর কথা বলেছেন। উচ্চারণ করেছেন যক্ষের যন্ত্রণাদগ্ধ কথামালা। তবে শুধু মেঘ-ই নয়,
মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন —‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ, নববধূর
ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ কবি
‘ঋতুসংহার’ কাব্যে শরৎকাল বিষয়ে
লিখেছেন—‘কাশফুলের মতো যার
পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ,
উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয়
যার নূপুরের শব্দ, পাকা শালিধানের
মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা, অপরূপ
যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল
আসে।’

কবি কল্পনায় কী দারুণ শরৎ- পরিবেশনা! শরতের সাথে প্রকৃতি ও নারীর এই উপমা দেখে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় কী। আবার বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি, চণ্ডীদাস তার
কবিতায় বলেন— ‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি আন্ধকারে শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল। তাত না দেখিবোঁ যঁবে কাহ্নাঁঞির মুখ চিনিতে মোর ফুট জায়িবে
বুক।’ কবি চণ্ডীদাস তার কবিতায় শিখি বলতে ময়ুর, ভেক অর্থে ব্যাঙ ও ডাহুক পাখির কোলাহল শোনা যায় বলে
উল্লেখ করেছেন।

বাংলাসাহিত্যের মহীরূহ প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা-গান রচনার মধ্যদিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন। তিনি বলেছেন —
‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর
অঞ্জলি ছড়িয়ে গেল
ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি। শরৎ,
তোমার শিশির-ধোওয়া
কুন্তলে— বনের পথে লুটিয়ে
পড়া অঞ্চলে আজ প্রভাতের হৃদয়
ওঠে চঞ্চলি।’

এত সব কথার পর বলতে হয়, শরৎ আমাদের দেশে বসন্তের পর রূপমাধুর্যে এক অনন্য ঋতু। কিন্তু ঋতু চক্রের বদলে শরৎ অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দিকে যদিও এখনও শরতের দেখা মেলে কস্ফচিৎ, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। আমার বিশ্বাস আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তন হবে। আমরা আবার ফিরে পাবো আমাদের ঋতুগুলোকে। শরৎ আবার তার রূপমাধুর্য নিয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।