‌`নিজে অসৎ হয়ে অন্যর সেবা করলেই তা জনসেবা নয় ‘

আপডেট: জুলাই ২১, ২০২১
0

এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববান হওয়া সম্পর্কে পবিত্র কোরান শরীফে অনেকগুলি দিক নির্দেশনা দেয়া আছে যথা (১) “কেহ যদি দান করে, আল্লাহ সচেতন হয় এবং ভালো ও কল্যাণকর বিষয়গুলি জীবনের সত্য হিসেবে গ্রহণ করে তবে আমি সাফল্যের সরল পথে চলাকে তার জন্য সহজ করে দেবো” (সূরা: লাইল আয়াত ৫-৭), (২) “অতএব তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না। কোন সাহায্য প্রার্থীকে তিরস্কার করো না” (সূরা: দোহা, আয়াত ৯-১০), (৩)“যে পৃথিবীতে অনুপরিমান সৎকর্ম করেছে, সে তা দেখতে পাবে।

আর যে অনুপরিমান অন্যায় করেছে, সে তাহাও সুষ্ঠভাবে দেখবে” (সূরা: জিল জাল, আয়াত ৭-৮), (৪) “তখন সৎকর্মে যার পাল্লাভারী হবে, সে অনন্তসূখে অবগাহন করবে” (সূরা: ক্বারিয়াহ, আয়াত ৬-৭), (৫) “বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল ছাড়া প্রতিটি মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে নিমজ্জিত। বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলরা সঙ্গবদ্ধভাবে পরষ্পরকে সত্যের পথে উদ্ভদ্ধ করে” (সূরা: আসর, আয়াত ২-৩)। (৬) “(হেনবী:) তুমি কি কখনো চিন্তা করেছ, কোন ধরনের লোকেরা কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে? এ ধরনের লোকেরা এতিমের সাথে অত্যান্ত দূর্ব্যবহার করে, অভাবগ্রস্থকে অন্নদানে কোন আবগ্রহবোধ করো না বা অন্যকে উৎসাহিত করে না” (সূরা: মাউন, আয়াত ১-৩), (৭) “যারা সৎ কর্মের নির্দেশ দেয়, অসৎকর্ম নিষেধ করে আর আল্লাহর সীমা রেখা মেনে চলে, তুমি সেই বিশ্বাসীদের সুখবর দাও” (সূরা: তওবা, আয়াত ১১২), (৮) “আল্লাহ সৎ কর্ম পরায়নদের ভালোবাসেন” (সূরা: আল-ই-ইমরান, আয়াত ১৪৮), (৯) “তারাই ভালো কাজের জন্য প্রতিযোগীতা করে ও তারাই সে কাজে এগিয়ে যায়” (সূরা: মুমিনুন, আয়াত ৬০), (১০) “তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগীতা কর” (সূরা: বাকারা, আয়াত ১৪৮)। এমনিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন সৎকর্ম করার জন্য পবিত্র কোরানশরীফে অসংখ্য বার তাগিদ দিয়েছেন। এই সৎকর্মের অপর নামই জনসেবা বা সমাজ সেবা।

একজন মানুষ যখন লোভ লালসা ত্যাগ করে নিজে সৎজীবন যাপন করে তখন সে পক্ষান্তরে একটি পরিবার, একটি জাতিকে সৎ থাকার জন্য সহায়তা করে এবং এটাও এক ধরনের সমাজ সেবা বা জনসেবা। একজন মানুষ নিজে অসৎ হয়ে অন্যের উপকার করাকে সাময়িক ভাবে জনসেবা মনে করা যেতে পারে, কিন্তু দূরদৃর্ষ্টিতে জনসেবার আবরনে সমাজে ইহা একটি দুষ্ট ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার প্রয়াস পাওয়া মাত্র।

আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক ব্যবসায়ী রয়েছে যারা শুধু কালো বাজারী বা মুনাফাখোর নহে বরং মানুষের জীবন ধ্বংসকারী ব্যবসার সাথে জড়িত, এমন কি খাদ্যে ভেজাল, ভেজাল ঔষধ প্রস্তুত করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে এবং মূখ রক্ষা ও নিজেদের সম্মান বৃদ্ধি করার জন্য দান খয়রাত সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজীদ, মাদ্রাসার পৃৃষ্ঠপোষক বনে যায়।

এ ধরনের লোকদের নামের পাশে স্বন্নিবেশিত হয় সমাজ সেবক, এমতাবস্থায় প্রকৃতপক্ষে কে সমাজ হিতেষী এবং কে সামজ হিতেষী নহে তাহাও নির্নয় করা সম্ভবপর হয় না। আধুনিক সমাজ সংস্কারবাদিরা সমাজ কর্ম ও সমাজ সেবাকে আলাদা ভাবে দেখছেন। সমাজ সেবার প্রধান কাজ হলো নাগরিকদের সমস্যার সমাধান সহ সামাজিক বন্ধনের উন্নয়ন করা। সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে সমাজ সেবার (ঝড়পরধষ ঝবৎারপব) কার্যক্রম জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেয়া যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা যা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান মোতাবেক সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

জাতিসংঙ্গের সমাজ ও অর্থনৈতিক কমিশনের মতে “মানুষের সাথে মানুষের পারষ্পারিক সম্পর্ক ও পরিবেশ উন্নয়নের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজ কর্ম।” সমাজ সংস্কারক ঐধৎৎু গ. ঈধংংরফু বলেছেন যে, “মানব সম্পদ সংরক্ষন, নিরাপদ রাখা এবং উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক ও সরাসরি সংঙ্গবদ্ধ প্রচেষ্টাই সমাজ কর্ম বা সোসাইল সার্ভিস।” আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুসবেল্ট ১৯৩৫ খৃস্টাব্দে “সামাজিক নিরাপত্তা আইন” প্রনয়ন করে বেকারত্ব ও দারিদ্রতামুক্ত সহ এফেকটেড পরিবারগুলিকে সহায়তা করার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেন। জড়নবৎঃ খ. ইধৎশবৎ ২০০৩ ইং সালে বলেছেন যে, “সমাজ কর্ম হলো সমাজ সেবীদের সে সকল কর্ম যা দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যোর উন্নয়ন সহ মানুষের পরনির্ভরতাকে কমিয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে গড়ে তোলে।” ১৯৯৫ ইং সনের মার্চ মাসের ৬ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ১৭৭টি রাষ্ট্র প্রধানের উপস্থিতিতে “বিশ্বসমাজ উন্নয়ন” শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে নেনসন ম্যানডেলা উপস্থিত ছিলেন। সে সম্মেলনে সমাজ উন্নয়নে ১০টি করনীয় বিষয় সম্পর্কে রাষ্ট্র প্রধানগণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন যার অন্যতম ছিল দারিদ্রতা ও বেকারত্ব দূর করা।

সমাজ পরিবর্তনশীল, শতাব্দীর পর শতাব্দীতে চলে আসা সামাজিক সংস্কৃতির বিভিন্নরকম পরিবর্তন ঘটে। সমাজ বিজ্ঞানী ঐড়ৎড়ঃড়হ এবং ঐঁহঃ এর মতে সমাজের পরিবর্তনের অর্থ হলো সামাজিক কাঠামো ও সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন। নি¤œবর্ণিত চারভাগে সমাজের পরিবর্তন ঘটে যথা- (১) পূরোপরি পরিবর্তন, (২) আংশিক পরিবর্তন, (৩) বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও (৪) মূল্যায়নগত পরিবর্তন। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আকস্যৎ আসে এবং স্থায়ীত্ব দীর্ঘ দিনের নহে, কিন্তু মূল্যায়নগত পরিবর্তন দীর্ঘ স্থায়ী হয়। আমেরিকার ন্যশনাল এসোসিয়েশন ফর সোসাইল ওয়ার্ক সমাজ সেবা সম্পর্কে নি¤œবর্ণিত ৬টি উপাদান মূল্যায়ন নির্দ্ধারন করেছে। যথা- (১) সেবা, (২) সামাজিক ন্যায় বিচার, (৩) সম্মান ও সম্পদ, (৪) পারষ্পারিক সম্পর্ক, (৫) বিশ্বস্থতা, সততা ও নির্ভরযোগ্যতা এবং (৬) যোগ্যতা ও পারদর্শিতা।

সামাজিক ন্যায় বিচার এখন সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে উঠে গেছে। এখন কেহ আর সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করে না। কোন কথাটি বললে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজে উপকৃত হবে বা ক্ষমতাবানরা খুশী হবে সে কথাটাই বলে, বিনিময়ে নিজে ফয়দা লুটে। যারা ক্ষমতাবান তারা দেশ জাতি ও সমাজকে লুটে পুটে খাচ্ছে, কেহ এর প্রতিবাদ করে না, হক কথা বলতে চায় না এবং সত্যকথা বলার জন্য মানুষ মানুষকে উৎসাহিত করে না। এতে দূর্বল নিরিহ মানুষদের দোষারূপ করা যায় না, কারণ তারা অসহায়, সত্য কথা বলে বা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপরে যখন ক্ষমতাসীন কর্তৃক বজ্রঘাত আসে তখন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং আইন আদালত তার পাশে দাড়ায় না। সমাজের বুদ্ধিজীবি যারা তাদের নিকট থেকে অবহেলিত মানুষ, দেশ ও জাতি অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। গণ মানুষ মনে করে যে, জাতিগত অবমূল্যায়ন যখন শুরু হয় বা সামাজে যখন ঘুন ধরে তখন বুদ্দিজীবিরাই তখন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে ব্যতিক্রম এই যে, এদেশের বুদ্দিজীবিরা এখন চামচাগীরিতে ব্যস্ত, বিনিময়ে তারা দামী বাড়ী গাড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

সামাজিক ন্যায় বিচার সভ্যতার প্রধান শর্ত। আইন কানুন, রাষ্ট্র, সরকার গঠন হওয়ার অনেক পূর্বে সমাজ গঠিত হয়েছে। বনে জঙ্গলে যারা বাস করতো, সভ্যতার ছোয়া যেখানে পৌছে নাই সেখানেও সমাজ ছিল। আদীম যুগে বনে জঙ্গলের বসবাসকারী আদিবাসীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে নিজস্ব নিয়ম নীতি অনুশরন করতো এবং সেখানেও সামাজিক ন্যায় বিচার ছিল বর্তমানে যা বাংলাদেশে নাই। বাংলাদেশে সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বা তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের দিক নির্দেশনায় পুলিশ ও প্রশাসন চলে। তাদের নির্দেশেই মামলার আসামীর নাম লিপিবদ্ধ হয়। ফলে সরকার দলীয় লোকেরা গ্রামে গঞ্জে নিরীহ মানুষের ব্যবসা, জমি জমা দখল করে নেয়ার সংবাদ প্রায়ই পত্র পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। সাধারনত মানুষ এখন থানায় গিয়ে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে সাহস পায় না, ফলে নিরবে, নিভৃতিতে সহ্য করে নেয়াই নিপিড়িত মানুষ “মন্দের ভালো” বলে মনে করছে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি জনহিতকর কাজ যেমন- সমাজসেবা, অনুরূপ সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সমাজ সেবার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট।

সামাজিক ন্যায় বিচার যখন সমাজ থেকে উঠে যায় তখন সমাজ থেকে সূখ শান্তি স্বাচ্ছন্ধ ও গণমানুষের নিরাপত্তা চলে যায়। সেখানে তারাই ভালো থাকে যারা ক্ষমতাশীল ও তাদের ছায়াতলে অবস্থান করে। অথচ সংবিধান প্রনেতাগণ সংবিধান প্রস্তাবনায় অঙ্গীকার করেছেন যে, “আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” কিন্তু রক্তের অক্ষরে লেখা সংবিধানের সেই প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন কোথায়?

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)