ডা . জাকারিয়া চৌধুরী :
প্রায় দুই বছর বিএনপি’র বিভিন্ন স্তরে বলেছি, ভারতের গোলামী করলেও বিএনপিকে ভারত বন্ধু হিসেবে বেছে নেবে না। ভারত দাবি করে- বিএনপি ভারত বিরোধী রাজনীতি করে কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, ভারত বিএনপি নির্মুলের রাজনীতি করে। পরিচিত অপরিচিত এমন কোন নেতা নাই যারে বলি নাই। সবাই বলেছে- ভারত বিরোধী পলিটিক্স করে টেকা যাবে না। আমি শুধরে দিয়ে বলেছি, আমরা ভারত বিরোধী পলিটিক্স করছি না। দেশের সম্ভ্রম রক্ষার চেষ্টা করছি। আমার কথা শেষ হবার পর অনেকেই ইশারায় দরজা দেখিয়ে দিয়েছে। আসলে, আমি যখন কথা বলতাম অনেকেই তখন ভারতীয় আফিম আচ্ছন্নে পিনিক নিত। কথা শেষ হলে পথে ছেড়ে দিত।
ভারত থেকে ফিরে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবার বললেন, আমরা মানে বাংলাদেশ আর ভারতের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রী’র মত…… এবার বললেন কি ! এবার বললেন – হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা প্রয়োজন ভারতকে তা তা করতে বলে এসেছি। আরে ভাই, আপনারা বলার আগে থেকেই ত ভারত এসব করছে। তারা কতোটা আগ্রাসী হয়েছে যে, বিএনপি’র রানিং সাংঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীকে তুলে নিয়ে গেছে। ফরহাদ মাজহারের মত একজন ঢাল তলোয়ার বিহীন নির্দোষ মনিষীকে ভারতীয় গোয়েন্দারা বর্ডার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। ভারতে আটকে আছে আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতা জনাব সালাহউদ্দিন আহমদ। সমুদ্র সমীক্ষার সময় আমরা তালপট্রিকে নিজেদের বলে দাবি-ই করিনি। সেই এরিয়াটা নিয়ে গেছে ভারত। আমাদের মিডিয়ার এক শ্রেনীর এটাকে সমুদ্র জয় বলে বলে ফেনা তুলে ফেলেছে। আশ্চর্য নিজ ভুমি ছেড়ে দেয়াকে কেউ বা কোন কোন গোষ্ঠী জয় বলছে। আজ শুনি, সেখানে বাংলাদেশ ১০০ বছর চলার মত তেল গ্যাস ছিল সেখানে। কেউ এ কথা একবারও উল্লেখ করেনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও একদিন বললেন – ভারতকে যা দিয়েছি তা ভারত আজীবন মনে রাখবে। কোন কনফিডেন্সে বাংলাদেশের এক শ্রেনীর লোক এত কনফিডেন্ট !!!
আসুন কিছু স্মৃতি মনে করি –
ভারতের দক্ষিনাংশে মুসলমান অধ্যুষিত এক রাজ্যের নাম হায়দ্রাবাদ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোঘল সাম্রাজ্যের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সুবাদার কামারুদ্দীন খান হায়দ্রাবাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজাম-উল-মূলক উপাধি নিয়ে হায়দ্রাবাদ রাজ্য শাসন করতে থাকেন। তিনি নিজেকে সৎ স্বাদ্ধী দেখাতে গিয়ে ইংরেজদের জন্য মহীশুরের পথ করে দিলেন। দুঃখের ব্যাপার হলো,পার্শ্ববর্তী মহীশূরের সুলতান হায়দার আলী এবং তার পুত্র টিপু সুলতান যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন,তখন হায়দ্রাবাদের তৎকালীন নিজাম নির্লজ্জভাবে ব্রিটিশের পক্ষাবলম্বন করেন। কিন্তু এই নতজানু নীতি তাদের বাঁচাতে পারেনি। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরেই, আর এস এস, কংগ্রেসের ষন্ডারা রাতের অন্ধকারে দুই লক্ষ সেনাকে বেসামরিক পোষাক পরিয়ে কব্জা করে নেয় মহীশুরের সালতানাত। যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ সেনারা মহীশুরের কোন সেনার লাশ খুজেনি; খুজেছিল মহীশুরের বাঘের লাশ। টিপু সুলতান ছিলেন সেই বাঘ।
পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পতনে দুই ধরনের ইতিহাস সমান্তরাল ধারায় বয়ে গেছে। একদিকে দেশপ্রেমিক সিরাজ নিজ রক্তের শেষ ফোঁটাটুকুও মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় বিলিয়ে দিয়েছেন অন্যদিকে বেঈমান দেশদ্রোহী মীর জাফর আলী খানের দল নিজেদের হাঁতে নবাবী পাবার আশায় ব্রিটিশদের নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে যেভাবে লগি বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার আদিম উল্লাস হয়েছিল ২০০৬ সনে ঠিক তেমন। ভারত বাংলাদেশে প্রবেশ করে আমেরিকা, ইউরোপকে নিয়ে। তারপর দুই মাস পার হবার আগেই বিডি আর হত্যাকান্ড দিয়ে এদেশের পরাজয়ের আরেকটা নতুন ফেজ শুরু হয়। শুরু হয় গুম, খুন, হত্যা, নিখোজের মহা লীল।
পলাশী কাননে পরাধীন বাংলার নির্লজ্জ ইতিহাসই শুধু রচিত হয়েছে, কেউ শিক্ষা নেয়নি। এই বংগ আজ পর্যন্ত অন্তত সাতবার স্বাধীনতা হারিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা খোয়ানোর খলনায়ক এদেশেরই একদল গাদ্দার। সুখের কথা হল, এর সাথে জড়িত কোন খলনায়কেরই স্বাভাবিক পরিনতি হয় নি। এমনকি এসব অজাত কুজাতদের কথা মানুষ মনেও রাখেনি। কিন্তু কার কি পরিনতি হয়েছিল সেসবের দিকে নজর থেকেছে এদেশেরই আপামর জনসাধারণের। সবচে খারাপ পরিনতি হয়েছিল সিরাজের আপন খালা, ঢাকার নবাব ঘষেটি বেগমের। সিরাজের পতনের পর, তাকে তারই মহলের সামনে বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিয়েছিল তারই এক সময়ের ইয়ার-দোস্ত, সাঙ্গ পাংগের দল। এদেশে যেসব অনির্বাচিত ভুয়া মন্ত্রী নেতা পাতিনেতা ভারত ভারত করে তারা বরং ভারত চলে যাক। দেখি ভারত তাদের কয়দিন জায়গা দেয়। এদেশের শিক্ষা হয় না, শিক্ষিত হয়ে উঠবার মত পরিবারেও এদের জন্ম হয় কিনা আমার পুরোপুরি সন্দেহ রয়েছে।
আজ ভারত যতই নেহরু ডকট্রিনের স্বপ্ন দেখুক আর আওয়ামীলীগ যতই লেন্দুপ দর্জি কিংবা ঘষেটির ভুমিকায় নামুক না কেন, এদেশে ভারতের অধীনে কিংবা ভারতের করদ রাজ্যের অংশ হয়ে বেঁচে না থাকতে চাওয়া মানুষের অভাব নেই। মনে রাখতে হবে, ৪৭ এ দেশ ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, আর এই প্রস্তাব তখন এমনি এমনি উঠেনি। ধর্মের ভিত্তিতেই এই ভাগের প্রয়োজন হয়েছিল। এর মাঝে যারা জেনেশুনে যার যার ভিটেয় রয়ে গেছে তারা এখন সেক্যুলারিজমের নামে নৈরাজ্য চালায়। তারা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার নামে মোম প্রজ্জ্বলিত করে। এরা কি বুঝে না যে, মোম প্রজ্জ্বলিত করাও একটা ধর্মীয় রিচ্যুয়াল !!
এদেশের অসাম্প্রদায়িকতার মঞ্চায়ন হয় হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে!! এটা কোন জাতের অসাম্প্রদায়িক আচরন কেউ কি বুঝিয়ে বলতে পারবেন ? আমার বুঝে আসে না। যা বলছিলাম, তখনকার কংগ্রেস আর আজকের কংগ্রেসের মধ্যে চিন্তা চেতনায় কোন পার্থক্য নেই যেমন পার্থক্য নেই পুরনো বাকশালী আওয়ামীলীগ আর আজকের খুনি, লুটেরা আওয়ামিলিগে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছে বলেই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। আর এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই সবাইক সবাইকে চলতে হবে।
বাংলাদেশের আজকের লুটপাটের যে চিত্র সে চিত্রের সাথে মিল পাওয়া যায় ৯৬ পরবর্তী আওয়ামী সরকারের আমলে মারোয়াড়ী ব্যাবসায়ীদের কাজের সাথে। এসব চিত্র আমরা লিখে যাইনি। লিখে গেছেন তাদেরই এক সময়কার পিএসেরা । দালালদের অধীনে থাকতে না চাওয়া মানুষের দল যেদিন রাস্তায় নেমে আসবে সেদিন এরা কোথায় পালাবে জানা নেই কিন্তু এটুকু আন্দাজ করতে উত্তর দক্ষিন পূর্ব পশ্চিম জেনে ফেলার প্রয়োজন নেই যে, সেদিন অনেক বড় কোন ইতিহাস লিখে যাওয়ার রসদ পরে থাকতে দেখা যাবে এদেশের পথে প্রান্তরে। এদেশের নদী খালে নটিদের/ডাকাতদের দেখা যেতে পারে যত্রতত্র। দিল্লীতে বসে দিল্লীর চোখ দিয়ে যেখানে বাংলাদেশকেই দেখা যায় না, সেখানে দিল্লীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশকে দেখতে পাবে আমি আগেও বিশ্বাস করিনি এখনো করিনি। এই যে এখন ইউ এস বলছে, তারা বাংলাদেশকে আর ভারতের চোখে দেখেনা আমি সে কথাও বিশ্বাস করি না। কেবল জানতে ইচ্ছে করে, আমাদেরকে আমেরিকার প্রয়োজন এ্যাকচ্যুয়ালি কতদিন!! বানিজ্য বা নৌ সুবিধা কিংবা তাদের জাহাজকে নোংগরের সুবিধা কতদিন বাংলাদেশ দিয়ে যেতে পারে দেখার বিষয় আসলে সেটা। কে কাকে কার চোখ দিয়ে দেখে, আমাদের জন্য গুরুত্তপূর্ন নয়। আমাদের জন্য গুরুত্তপূর্ণ কে আমাদের স্বার্থও দেখে সেটা দেখা এবং ভারসাম্যমুলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। এদেশের ১৭ কোটি মানুষ সারা বিশ্ব থেকে আয় করে আনবে আর ভারত সেই টাকা যেমন তেমনভাবে লুটপাট করে নিয়ে যাবে- এ হতে পারে না। কিছুতেই নয়।
মনে রাখবেন, আমরা এখন থেকেই দেখতে থাকব এদেশের কয়জন মানুষ দলীয় আনুগত্যের চেয়ে দেশকে বড় করে দেখতে পারেন। আমরা সব কিছুর তালিকা করে রাখব। আমরা এখানে দেশপ্রেমী এবং দেশদ্রোহীদের সঠিক তালিকা লিখে দিয়ে যাব। আমাদের জেনারেশন যদি আইনের শাসন দেখে যেতে না পারে তবে তাঁর পরের জেনারেশন দেখবে কিংবা তারও পরের কেউ…… বিচার কিন্তু হবে। সব কিছুর হিসেব একদিন দিতে হবে। কথাটা মনে রাখবেন। ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা -এখানে ভুলেও নেহেরু কিংবা তাসারুর কোনও ডক্ট্রিনের বাস্তবায়ন কোন দিনই হবে না। প্রয়োজনে যুদ্ধ চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। ভারত আমাদেরকে সম্মান না দিলে আমরাও দেব না। আমরা কি তাদের খাই নাকি তাদের প্রভুত্ব মেনে নেয়া কুকুর শ্রেনী !! এ প্রশ্নের জবাব ক্লিয়ার হওয়া উচিত। ভারতের সাথে আমাদের সুনির্দিষ্ট মিমাংসায় আসা উচিত। দিল্লীতে বসে শত চাইলেও ঢাকা দেখা যাবে না, দিল্লীর কোঠাগুলো ছাড়া। তেমনি আমেরিকাও দিল্লীর চোখে ঢাকাকে দেখতে পারবে না দিল্লীর কোঠা ছাড়া।
১২.০৩.১৬ইং