‌‌`রাজনীতি ও নারীর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ ফলপ্রসূ ‘

আপডেট: ডিসেম্বর ২, ২০২২
0

সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ফলপ্রসূ অংশগ্রহণ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও উপজেলা নারী ভাইসচেয়ারম্যানদের ভূমিকা শীর্ষক অনুষ্ঠিত
মতবিনিময় সভায় এসব মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নারী নেত্রিরা।

গত পাঁচ দশকে স্বাধীন বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণের অগ্রগতি দৃশ্যমান। আজকে বাংলাদেশ যেমন অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের সূচকেও এগিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়নের একটি অন্যতম শর্ত হলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। ২০২২ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ সূচকের প্রতিবেদন অনুযায়ী নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীতি, আইন এবং বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে এ দেশের নারীরা আজ স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদ সব ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণ এবং দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান তৃণমূলের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক সিদ্ধান্ত।

রাষ্ট্র তার প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে আলাদা প্রশাসনিক কাঠমো গড়ে তোলে। এই প্রশাসনিক কাঠামোই স্থানীয় সরকার। এই প্রশাসনিক কাঠমোকে স্থানীয় জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে থাকে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা জনগণের কাঙ্খিত লক্ষ্য । গণতন্ত্র ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা একে অপরের পরিপূরক, কারণ গণতান্ত্রিক ধারণার উপর ভিত্তি করে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ১১, ৫৯(১), ৫৯(২) এবং ৬০-এ গণতন্ত্রের চর্চা, মানবাধিকারের সুরক্ষা, প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন বিষয়ে বলা আছে। ইউনিয়ন পরিষদের পাশাপাশি উপজেলা পরিষদও বাংলাদেশের গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর।

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো এদেশে ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত নারী আসনসমূহে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক নারী অনেক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন । ২০০৯ সালে প্রথমবারে মতো বাংলাদেশে উপজেলা পরিষদে একটি আসন মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। যা কিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আর এক ধাপ অগ্রগতি। এই আসনে ৪৮০টি উপজেলায় মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে ১৯৩৬ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নিজেদের মেধা ও শ্রমের সমন্বয়ে তাঁরা এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০১০ সালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইসচেয়ারম্যানের দায়িত্ব, কর্তব্য ও আর্থিক সুবিধা বিষয়ে বিধিমালা প্রনয়ণ করা হয়। এই বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে ভাইসচেয়ারম্যান এবং নারী ভাইসচেয়ারম্যানের দায়িত্ব উল্লেখ করা আছে। ভাইস চেয়ারম্যানগণ ( নারী বা পুরুষ যেই হোক) এক বা একাধিক কমিটির সভাপতি হওয়া ছাড়াও চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী চেয়ারম্যান, উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা প্রসার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যক্রম তদরকী, আন্ত: ইউনিয়ন সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ, চুরি, ডাকাতি চোরাচালান মাদক ব্যবহার- ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধমূলক কাজ, পরিবেশ সংরক্ষণ, ক্রীড়া ও সাংষ্কৃতিক কার্যক্রমের প্রসার এবং কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবেন। অপরদিকে নারী ভাইসচেয়ারম্যানগণ এক বা একাধিক কমিটির সভাপতি হওয়া ছাড়াও চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, সমবায় সমিতি, সমাজকল্যাণ ও জনহিতকর কার্যক্রম, নারী শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, যৌতুক ও বাল্য বিবাহ রোধকল্পে ভ’মিকা পালন করবেন বলে বিধিমালায় উল্লেখ আছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব বিভাজনের ক্ষেত্রে এক ধরনের জেন্ডার পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়, যা কিনা সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিফলন।

স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে অধিক সংখ্যক নারী যাতে নির্বাচিত হতে পারেন, আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে সেই ধরণের ব্যবস্থা রাখায় ব্যাপক সংখ্যক তৃণমূলের নারীরা আজ ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন, জনগণের জন্য কাজ করছেন, জনগণের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করছেন, বিভিন্ন প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এই নারী জনপ্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালনে আজ অনেক বেশী আত্মবিশ^াসী।

এ সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নানা কারণে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত সকল জনপ্রতিনিধিগণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননা। একদিকে কেন্দ্র এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ অন্যদিকে পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ- এই ধরণের কাঠমোগত ত্রুটি এবং আইনী দুর্বলতার কারণে উপজেলা পরিষদ রাষ্ট্রের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে অনেক সময়ই সক্ষম হয়না। ঠিক এইরকম একটি পরিস্থিতিতে উপজেলা নারী ভাইসচেয়ারম্যানদের কার্যকর ভূমিকা পালন আরও কঠিন। একদিকে বহুযুগ ধরে চলে চলে আসা নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী অন্যদিকে কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে উপজেলা পরিষদে নারী ভাইসচেয়ারম্যাগণ তাঁদের আগ্রহ, মেধা, যোগ্যতা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। এ ছাড়াও নারীর উপর পারিবারিক এবং সামাজিক বিভিন্ন চাপ তাকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনেক সময়ই বাধা সৃষ্টি করে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ উপজেলা মহিলা ভাইসচেয়াম্যান অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে বেশ কিছু বৈষম্য ও বঞ্চনার তথ্য এবং আট দফা দাবি সরকারের সামনে তুলে ধরেন। সেখানে উল্লেখ করা হয় যে, উপজেলা নারী ভাইসচেয়ারম্যানগণ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেও উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়না এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের কোন ভূমিকা থাকেনা। উপজেলার উন্নয়ন কর্মকান্ডে এই নারী ভাইসচেয়ারম্যানদের সম্পৃক্ত করা হয়না। আগে উপজেলার অবহেলিত নারীদের আয় বর্ধক উন্নয়ন প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন মহিলা ভাইসচেয়ারম্যানগণ, কিন্তু পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতিকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। জনপ্রতিনিধি হিসেবে মহিলা ভাইসচেয়ারম্যানদের জন্য যাতায়াত, গণসংযোগ এর জন্য কোন লজিষ্টিক সাপোর্ট নাই। উপজেলা অফিসে তাঁদের জন্য কোন সহায়ক কর্মপরিবেশ নাই। দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে মািহলা ভাইসচেয়ারম্যানগণ বৈষম্যের শিকার হন। ধর্ষণের মতো ঘটনা যাতে সামাজিকভাবে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা না হয় অথবা বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে যাতে ইউনিয়ন পরিষদ অফিস থেকে ভুয়া জন্ম সনদ না দেয়া হয়- এইসব বিষয়ে কথা বললে অনেক সময় নারীভাইসচেয়ারম্যানদের মানসিক হয়রানী বা বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন হতে হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মনে করে সমমর্যাদা, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীর প্রতি নেতিবাচক চিন্তা চেতনার পরিবর্তন, সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি ও তা কার্যকর করে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সুপারিশ:

উপজেলা পরিষদের উপর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে।

উপজেলা পরিষদকে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার লক্ষ্যে আইন সংশোধন করতে হবে।

উপজেলা পরিষদের প্রতিটি দপ্তরের সভায় নারী ভাইসচেয়ারম্যানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং রেজ্যুলেশনে তাঁদের স্বাক্ষর নিশ্চিত করতে হবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নারী সদস্যদের জন্য প্রণীত নীতিমালা সকল নারী সদস্য যাতে সময়মতো জানতে পারেন এরূপ ব্যবস্থা বা পরিবেশ তৈরী করতে হবে।

নারী নেতৃত্বের প্রতি রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে এবং নারীকে রাজনীতি ও নির্বাচনে আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নারী বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।