যুবদলের দায়িত্ব অনেক

আপডেট: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১
0

শওকত মাহমুদ

ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে আমরা দেখতে পাই, ১৯৭৮-এর পয়লা সেপ্টেম্বর সূচিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি’র। অমর দেশনায়ক শহীদ জিয়াউর রহমানের এ-ও এক অনন্য কৃতিত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে গভীর শূন্যতা পূরণে তিনি বিএনপি নামে যে দলের সৃষ্টি করেছিলেন, আজ দেশকালের নানা ঘাত, প্রতিঘাত সয়ে সেই সংগঠন – বিএনপি- এক অনিবার্য বাস্তবতা। একে অস্বীকার করার, একে গুঁড়িয়ে দেয়ার, একে হটিয়ে দেয়ার জন্য নানা সময়ে কম অপচেষ্টা হয়নি। কিন্তু বিএনপি সব চোট সব আঘাত-আঁচড় সামলে নিয়ে আপন অস্তিত্বে বলীয়ান হয়ে উঠেছে।
যুবদলের আজকের নেতাদের বলব, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য নেতার হাত ধরে আলোকিত যুবশক্তি জাতীয়তাবাদী যুবদলের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। এ এক গর্বের বিষয়। বিএনপি’র যাত্রা শুরু হওয়ার পর যে অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়, জাতীয়তাবাদী যুবদল সম্ভবত প্রথম সেই অঙ্গ দল।
বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের মধ্যে যুবদল সৃষ্টির তাগিদ এসেছিল নিশ্চয়ই একারণে যে, তিনি তাঁর মূল দলের জন্য একটি ধারাবাহিক সাংগঠনিক বৃত্ত তৈরী করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন যে, ১৮ বছর বয়স থেকে ৪০-এর নিচের বয়সের বিশাল জনশ্রেণী, যারা যুবা-তরুণ, তারা যুবদলে সম্পৃক্ত হবে, বিএনপি অর্থাৎ মুল দলের ঘোষণাপত্রের অধীনে যুব সংগঠনে আত্মনিয়োগ করবে, দেশপ্রেম ও সততায় নিজেদের চরিত্রকে মণ্ডিত করবে, মূল দলের রাষ্ট্রগঠনমূলক উন্নয়ন কাজে জড়িত হবে, নিজেদের আত্ম-কর্মসংস্থানে চেষ্টিত হবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে মূল দলের আকার ও কলেবর বৃদ্ধি করবে। শহীদ জিয়া চেয়েছিলেন তার যুবদলের প্রত্যেক নেতা ও কর্মী হবে সততা ও আদর্শের দৃষ্টান্তমূলক তরুণ। বিশ্বের সব দেশেই মূল দলের যুব শাখা এভাবেই গড়ে ওঠে। মূল দলের নেতৃত্বের দৃষ্টি থাকে, যাতে যুব শাখা গতিশীল, প্রাণবন্ত এবং উদ্যমে ভরপুর হয়। ইয়াং রিপাবলিকানস, ইয়াং ডেমোক্র্যাটস, যুব কংগ্রেস এসব সংগঠনের দিকে তাকালেই বাস্তবতাটা ভাল করে বোঝা যাবে।
অবাক হতে হয় শহীদ জিয়ার দূরদর্শিতা এবং সাংগঠনিক চিন্তার গভীরতা ভেবে। বয়সে তিনিও তখন ছিলেন তারুণ্যের কোঠায়। অথচ সেই সময়ে একজন তরুণ স্বাপ্নিক সৈনিক রাষ্ট্রপতি, একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এর ধারাবাহিকতা গড়ার জন্য দলের অনেকগুলো অঙ্গ সংগঠন গঠন করেছিলেন। যুবদল, শ্রমিক দল, মহিলা দল, যুব মহিলা দল, ছাত্রদল এবং জাসাস – কতগুলো অঙ্গ সংগঠন। এর প্রত্যেকটির প্রতি তার্ঁ বিশেষ দৃষ্টি ছিল যাতে প্রতিটি সংগঠন নিজ নিজ বলয়ে গড়ে ওঠে, আকারে এবং কলেবরে বাড়ে, সমাজে প্রতিটি অঙ্গ সংগঠনের একটা ইতিবাচক ইমেজ তৈরী এবং এগুলো বিকাশমান হয়।
আজ যুবদলের নেতাদের এই ভাবনায় নিজেদের নিয়োজিত করা দরকার যে, এখনকার সমাজের ১৮ বছর বয়স থেকে ৪০ এর কোঠার বিশাল যুবাশ্রেণীর কত শতাংশ জাতীয়তাবাদী যুবদলে সম্পৃক্ত রয়েছে? যুবদল নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলব, আপনারা বর্তমান যুবদলকে সাংগঠনিকভাবে আরো সংঘবদ্ধ, আরো বিকশিত করার জন্য নিজেদের অভিজ্ঞতাকে বর্তমান কর্মীদের সঙ্গে বিনিময় করুন।
রাজনীতি-বিজ্ঞানের পুরানো কথা হয়তো রয়েছে যে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি, দল এবং দেশ সবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জিয়াউর রহমান একজন ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু দেশকালের আবর্তনে তিনি তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বাকে রাষ্ট্রনায়কত্বে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশের প্রয়োজনে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট পম্পিডু রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিকের পার্থক্য বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন -অ ংঃধঃবংসধহ রং ঢ়ড়ষরঃরপরধহ যিড় ঢ়ষধপবং যরসংবষভ ধঃ ঃযব ংবৎারপব ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ. অ ঢ়ড়ষরঃরপরধহ রং ধ ংঃধঃবংসধহ যিড় ঢ়ষধপবং হধঃরড়হ ধঃ যরং ংবৎারপব. নিজের প্রতি নির্মোহ, সততায় সুকঠিন এবং দেশব্রতে বলীয়ান, শহীদ জিয়ার বিচরণ খুব অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু তাঁর সেই সময়কে ঘিরে তাঁর যে ব্যক্তিত্ব তার থেকে উদ্ভূত নেতৃত্ব সমাজ এবং রাষ্ট্র জুড়ে রেখে গেছে এক স্থায়ী প্রভাব। তাঁর রাষ্ট্র-ভাবনা, দল-চিন্তা আজও আমাদেরকে আলোড়িত করে। আমরা এখনও এই মুগ্ধতায় অন্তরীণ যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তার আদর্শের যে অভিভাবকত্ব তার নাগাল থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারে না, চায় না। বিচ্যুতি হলেই এই জাতি-রাষ্ট্র বিপদে পড়ে, যার প্রতিধ্বনি আমরা এখন দেখছি।
বিএনপি’র জন্য, যুবদলের জন্য, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, মহিলা দল সকলের জন্য শহীদ জিয়ার নেতৃত্বের এই যে, আলোকময় দ্যুতি কিংবা মহিমা, তা এক অবিনশ্বর সম্পদ। যুবদলের নবীনদের উদ্দেশে বলব, শহীদ জিয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে। শহীদ জিয়ার কথা সমাজে বেশি করে প্রচার করতে হবে। নিজেদের প্রত্যেককে সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরতে হবে। তবেই নিজেদের সংগঠন বিকশিত হবে, সমাজে সংগঠনের প্রভাব সম্প্রসারিত হবে এবং সংগঠনের ভালো দিকটা লোকের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সকলের সামনে পরিষ্কার। ১৯৮২’র ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল এরশাদ। ২০০৭-এর ১১ই জানুয়ারি আরেকটি ছদ্ম সামরিক অভ্যুত্থানের কবলে পড়ে দেশ। আমি আমার দৃষ্টিতে দেখি, সেই অভ্যুত্থানের নীলনকশা অনুযায়ী দেশ এখন পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়ে গেছে তা ওই নীলনকশার ছক অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপি ও জিয়া পরিবারের ওপর চলছে অসহনীয় নির্যাতন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবর্ণনীয় পারিবারিক নিঃসঙ্গতা ও মনোবেদনার মধ্যেও দেশ, জাতি ও দলের জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁকে তাঁর বাড়ী থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারুণ্যের দৃপ্ত অহংকার তারেক রহমান প্রবাসে অসুস্থ অবস্থায় আছেন। বাংলাদেশের নতুন স্বপ্নদ্রষ্টা এবং জাতির ভবিষ্যত কাণ্ডারী হিসেবে তিনি ইতিমধ্যে আবির্ভূত হয়েছেন। তার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। আরাফাত রহমানের প্যারোল বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে দেশের মানুষ আজ সর্বগ্রাসী সঙ্কটে।
এমন অবস্থায় আজকের শাসক দলের প্রথম সারির নেতৃত্ব থেকেই যখন নানামুখী কথাবার্তা বলা হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, দেশ সাংবিধানিক শাসনের আওতায় চলছে না। যদি চলত, তাহলে দুর্নীতি নির্মূলের নামে ২০০৭ ও ’০৮ সালে যে স্বেচ্ছাচারী কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে তার তদন্ত হয় না কেন? যারা ওই স্বেচ্ছাচারের জন্য দায়ী তাদের বিচারের আওতায় নেয়া হয় না কেন?
১১ জানুয়ারির অভ্যুত্থান পরবর্তী ওই যে মঈন-ফখর-ইয়াজ চক্র, তারা ঢোল পিটিয়েছিল বিচার বিভাগ স্বাধীন। অথচ সর্বোচ্চ আদালত থেকে নিম্নতম আদালত পর্যন্ত যান, দেখবেন সেখানে সব চলছে অঙ্গুলি হেলান।
বিএনপি জোট সরকার রেমিট্যান্স আনার বৈধ পথ তৈরি করেছিল, রেমিট্যান্স ক্রমে বেড়েছে, বিনিয়োগ হয়েছে। আজ বিনিয়োগ-প্রবাহ শেষ। চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় বন্ধ করার উপক্রম করা হয়েছে। বিশ্ব মন্দার গ্রাসে গার্মেন্টস ও রফতানি খাত সংকুচিত। বিদেশে চাকরির বাজার পরিধি ক্রমে কমছে। দেশেও বিনিয়োগ নাই। চাকরি নাই। উচ্চ আদালতে দলীয় বিচারক। প্রশাসনে দলীয়করণের ষোলকলা পূর্ণ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেহাল। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কি পরিমাণ বেড়েছে তা প্রতিদিন টিভি চ্যানেলের বাজার চিত্রেই দেখা যায়। এমন হতাশাজনক অবস্থায় সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, নীলনকশার নির্বাচন ঘোষিত ফলাফলে সৃষ্ট ক্ষুদ্র বিরোধীদলকেও সমুলে হটিয়ে দেওয়া। তার অর্থ দাঁড়ায়, একদলীয় পার্লামেন্ট। একদলীয় ব্যবস্থা।
এ মুহূর্তে বিএনপি’র সামনে চ্যালেঞ্জ হল, রাষ্ট্র বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে নিজেকে সুসংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করা। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে নিশ্চিত করা। সংগঠনে কোন্দল, অনৈক্য, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, পদের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। কিন্তু সেসবের উর্ধ্বে উঠে দলকে মানুষের জন্য দৃঢ়ভাবে গড়ে তোলা। কারণ বিএনপি’র অনৈক্য থেকে শক্তি সঞ্চয় করছে মহাজোট সরকার। বেগম খালেদা জিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া সহযোগিতার হাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতোই দূরে ঠেলেছেন, ততই বিপদের বেড়াজালে পতিত হচ্ছেন। আজকের চ্যালেঞ্জ কিন্তু আন্তর্জাতিক চক্রান্তের। শহীদ জিয়া, বেগম জিয়ার দল বিএনপি গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি এনে দিয়েছে, উদার মুসলিম আধুনিক জাতি রাষ্ট্র হিসেবে। উন্নয়ন প্রত্যাশী কটা দেশে এমন চমৎকার মধ্যপন্থার উদার গণতান্ত্রিক দল আছে? নেই। সেজন্যে জঙ্গিবাদের জিগির তুলে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে চাইছে। রাষ্ট্রকে একটি বাজার-রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। আমাদের সৈন্যরা শুধু রফতানি হবে আর রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেখবে ভারত।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি’র প্রধান অঙ্গ দল হিসেবে যুবদলের সামনে অনেক দায়িত্ব, অনেক কাজ। যুবদল নেতারা যুব সমাজকে সংগঠিন করার উদ্যোগ নিন। সৎ নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করুন। প্রচারপত্র বিলি করুন। এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট কর্মি-সমর্থক সভা করুন। স্থানীয় ও জাতীয় দাবি ভিত্তিক মিছিল করুন। সংগঠনের কলেবর বৃদ্ধি করুন।