মিলনের বাঁশি

আপডেট: মার্চ ১৭, ২০২৩
0


মাহমুদা ডলি

বিকেল বেলা। অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। বাঁ দিকে সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে। কিন্তু রোদের একটু একটু তেজ আছে। তবুও সূর্যের দিকে তাকানো যাচ্ছে না এখনো। হালকা নীল আর গাঢ় সবুজে প্রকৃতির দ্বৈতসত্তার আভাস। আকাশ আর তৃনরাজি। সবুজ ওপরে যত উঠেছে, তত নিজেকে ভেঙ্গে গেছে নীলের আশ্রয়ে। পথ চলতে চলতেই হাতের বাঁশিটা নিয়ে বাজানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাঁশিতে ফুঁ দিলে ফুঁকফাঁক শব্দ পর্যন্তই শেষ। উফ! এই জিনিসটা এতো পছন্দ করি; অথচ বিধাতা আমায় সেই গুণটুকু দিল না। অবশেষে নিরস্ত হলাম। অফিস থেকে ফেরার সময় এক বাঁশিওয়ালার কাছ থেকে বাঁশিটি কিনলাম। একেবারেই কম দামে। মাত্র পনের টাকা। ছোট বন্দর নগরী হলেও এখানে বাঁশির মতো সৌখিন জিনিসপত্র অনেকটাই দুর্লভ। ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে কাঁচা রাস্টøায় এসে পড়লাম। প্রায় আধা কিলোমিটার পাকা রাস্তাটা স্টেশন পর্যন্ত। স্টেশনের রাস্তাটা ছেড়ে ডানে-বামে দুই দিকে দুই কাচা রাস্তা চলে গেছে। স্টেশনটা ছোট একটা বাজারের মতো। বন্দরের মধ্যে বেশ কয়েকটা বোর্ডিং আছে। আমার মতো ছা-পোষা চাকরীজীবীর পক্ষে মাসের পর মাস এত টাকা ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই বাছ-বিচার করে অনেক খোঁজাখুঁজির পর স্টেশন থেকে দূরে একটা ছোট ভাড়া করা ঘরে ঠাঁই হলো। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এসেছি। মাথার ওপর আকাশ নীলে একটু গাঢ়তর সাদার ছোঁয়া, বিবর্ণতার আঁকি বুঁকি।

বাসায় ফিরতে ফিরতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। মসজিদটা স্টেশন আর বাসার রাস্তার মাঝামাঝি। তাই প্রতিদিন মাগরিবের নামাজটা ওখান থেকে পড়েই আসতে হয় । কাল শুক্রবার। পোস্ট অফিস বন্ধ। রাতেই একটা চাকরির আবেদনপত্র তৈরী করতে হবে। রোববার অফিসে ঢোকার আগে পোস্ট করে দিতে হবে। সবে মাত্র ইংলিশে মার্স্টাস কমপ্লিট হলো। রেজাল্ট আউট হতে অনেক দেরি। কোনভাবে পরীক্ষার আগেই এনজিও’র এই চাকরিটা নিতে হলো। বাড়িতে সহায়হীন মা আর ছোট বোনের কথা মনে করতেই বুকভাঙ্গা কান্না বেরিয়ে এল। নিজেকে সামলানোর জন্য, বাঁশিটা হাতে নিয়ে আবার বাজানোর বৃথা চেষ্টা! কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কান্নাটা যে কমছে না। একই সাথে নাক-মুখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। বিছানায় অর্ধ শরীর আর বাইরে পা দু’টো ছেড়ে দিয়ে বুকে বালিশ নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা। সেই কবে বাবা মারা গেছেন। স্মৃতিচারণের মধ্যেই কান্নাটা থেমে গেল। তবুও বারে বারে বুকের হাপড়ে থেকে নিঃশ্বাস ওঠে। এমা! রাত হয়ে গেছে। বাইরে থেকে চাঁদের আলোটা জানালার ফাঁক গলে বিছানায় পড়েছে। আরো একটু গড়াগড়ি করলাম বিছানায়। উফ! সারা দিনটা অফিসে যে কি কাজ। নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। একটানা কাজ। রতনের মায়ের গলা শুনে ওঠতে হলো, আবিদ স্যার ঘরে আছেন? হ্যাঁ, আসেন চাচী। রাতের রান্নার জন্য বাসায় রতনের মা এলো। এতক্ষণে অন্ধকার ঘরটায় আলো জ্বলল।

কলতলা দিয়ে পূর্ব দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পহৃবের আকাশে আলো ফুটে ওঠতে দেখলাম। ভোরের সহৃর্য ওঠা এর আগেও দেখেছি বহুবার। আজকের দিনটা অন্যরকম। দক্ষিণ দিক থেকে ভেজা ঘাস আর বুনো ফুলের গন্ধ মাখা মাদকতা জড়ানো বাতাস শরীর স্পর্শ করে গেল। স্টেশনের পথে রওয়ানা হলাম। আজকের চাকরির খবর পত্রিকাটা কিনতে হবে। যত জায়গায় সম্ভব অ্যাপ্লাই করতে হবে।
ফাল্গুন প্রায় ফুরিয়ে এল। সকালের রোদ বেশ চড়া। তবে শুকনো শুকনো, মিঠে মিঠে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। পথে শিশুরা কারো শার্টের কোচরে, আবার কারো মাথার ওড়না কোচড়ে ভরা খই বাতাসা খেতে খেতে যাচ্ছে। বুঝলাম, মসজিদে পড়ূয়া কোন ছাত্রীর আজ কুরআন শরীফের প্রথম পাঠচক্র শুরু হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এসব রীতি রয়েছে। ঘুম থেকে জেগে দেখি বিকেল গড়িয়ে এল। ওঠে নিজেই এক কাপ চা বানিয়ে বাসার সামনে রাস্তার ঠিক পাশেই বাধানো বেঞ্চিতে বসলাম। চাকরির বিজ্ঞপ্তিগুলো দেখেছি। কয়েকটা জায়গায় দেয়া যাবে। সব জায়গায় এক্সপ্রিয়েন্স চায়। অথচ পত্র পত্রিকায় দেখা যায়, নিয়োগ বানিজ্য, কোটা-ফোটা, লবিং-তদবিরের খবর। শালা! এরা আবার বিজ্ঞপ্তিতে লোক দেখানো শর্তও জুড়ে দেয়। অথচ আজকাল লবিং ছাড়া অনেক বেসরকারী, কর্পোরেট হাউসগুলোতেও চাকরি হয় না। কয়টা সঠিক নিয়মে হয়! তাহলে এত হাহাকার থাকতো না। কিন্তু চাকরিটা খুব দরকার। কি করবো বুঝতে পারছি না। বাড়িতে মা আর বোনের মুখটা মনে পড়লেই রিক্ততার রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। চা খেতে খেতে একটু পূব দিকে মিনিটখানেক হেঁটে এলাম খান বাড়ির ছাড়া ভিটে পর্যন্ত। এতদিন সংসার, নিজের পড়াশুনাসহ সব সময় একটা চাপের মধ্যে, একটা টেনশন কাজ করায়, বাঁশি বাজানোর কথা মনেও আসেনি। কিন্তু বাড়িতে যদি কখনো দূর থেকে ভেসে আসা সুর শুনতে পেতাম, তাহলে কান পেতে থাকতাম। চায়ের কাপটা ভেতরে রেখে হাতে বাঁশিটা নিয়ে ফিরে এলাম বেঞ্চির কাছে। বাঁশিতে আবার ফুঁ দেব; এ সময় ভেসে এল কারো বাঁশির সুর। এ কি শুনছি! ক্ষণিকের জন্য অভিভুত হয়ে গেলাম। এতদিন হয়ে গেছে, কোথাও বাঁশির সুর শুনেছি বলে মনে হয় না। আজ হঠাৎ করে কে, কোথায়? আবার শোনার চেষ্টা করলাম! হ্যাঁ ধারে কাছে কোথাও। মনের ভেতরে সুরের জগতে ঢোকার জন্য এক অস্থিরতা; আকুলতা নিয়ে ওঠে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই! ধারে-কাছে। ভালোভাবে কান পেতে রইলাম! কোন দিকে- পূব পাশেইতো! দৌড়ে ওদিকটায় গেলাম। সন্ধ্যেও হয়ে এসেছে। তাই একটু সমস্যা হচ্ছে দুরের কাউকে দেখাটা। ছুটে ছাড়া ভিটে পর্যন্ত গেলাম। না, কাউকে দেখছি না। কিন্তু খুব কাছে। হ্যাঁ পেয়ে গেছি! ওইতো রাস্তার দক্ষিণ পাশে, শিমুল আর জারুল এই দুই গাছের ফাঁকে খালি জায়গায়টাতে নিশ্চল দক্ষিণমুখো বসা। আমি পেছন গিয়ে দাঁড়ালাম। ততণে ওর বাঁশির সুর থেমে গেছে। আমি ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম, এই ছেলে কে তুমি? এর আগে তো দেখেনি! কোথায় তোমার বাড়ি? কথা বলছো না কেন? কি আশ্চর্য! এদিক ফিরে তাকাও। নাম বলো। কি হলো তাকাও- এবার ওঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে ফিরলো- কিন্তু মাথা নিচু করেই রয়েছে। লিকলিকে লম্বা, মাথায় গুড়ি গুড়ি পাতলা চুল। পায়ের নিচ থেকে ছেড়া এমন একটা জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে টি শার্ট। ধুলা-ময়লা মাখা। কতদিন যেন এতে পানির ফোটা লাগেনি। কি হলো তাকাও! এবার তাকালো। আমি চমকে ওঠলাম! ওর চোখের দিকে তাকিয়ে! দু-এক পা পেছন সরে গেলাম! নিমিষের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে আবার কাছে এলাম। আরে বাবা! এ রকমটা হয় নাকি! চোখের মধ্যে ওর মনি খুঁজে পেলাম না। কেমন যেন মরা মানুষের চোখের মতো। মনিহীন; ধুসর চোখ! এত অপুষ্টি! মুখে দাড়ি-গোঁফের রেখার দাগ। একটা কিশোর ছেলে এমন পুষ্টিহীনতায় ভুগছে! ভাবা যায়!

আবার কথা বললাম, কি হলো- কথা বলো। নাম, বাড়ি জানতে চাইছি। এতক্ষণ পর কথা বলে ওঠলো মি.. মি …মিলন। আর বাড়ি? জানতে চাওয়ায়, হাত বাড়িয়ে ছাড়া ভিটে ছাড়িয়ে পূবদিগন্তের প্রায় এক কিলোমিটার দূরের বাড়িটি দেখালো। তোমার কি খুব ক্ষুধা পেয়েছে, জানতে চাইলাম। না… না! আমার মনে হচ্ছে তাই। আচ্ছা, নামাজের সময় হয়ে এল। আজ আর কথা বলবো না। মিলন, তুমি কাল বিকেলে আমার কাছে আসবে। ঠিক আছে? অবশ্যই আসবে। তোমার বাঁশির সুর আমার ভালো লেগেছে। আমি শুনবো, তোমার বাঁশির সুর। আসবে কিন্তু! অপেক্ষায় থাকবো।
রাত জেগে চাকরির আবেদনপত্র লিখে লিখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। সকালে ঘুম ভাঙলো। নিঃঝুম বাড়ির চারদিকে আলোড়ন চলতে থাকে পাখ-পাখালি আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে। পশ্চিমপাশে খানদের বাড়ি থেকে গরুর হাম্বা ডাক এবং বাছুরের গলায় ঘন্টার টুং টাং শব্দ। ফেরিওয়ালা ডাকতে ডাকতে রাস্তা পেরিয়ে যায়। পূব দিকে খালের পাশ দিয়ে জমি জমা চাষের জন্য হালের বলদ আর লাঙল কাঁধে যাচ্ছে মতি মিয়া। ইদানিং রোজ ওই দিকটায় যায়। যাওয়ার সময় কথা না শোনা বলদকে লাঠি দিয়ে আঘাতের শব্দ শোনা গেল। চিৎকার করে রাগ মাখানো স্বরে বলতে থাকে, চল হট, ওদিক না বায়ে, এই সোজা, হুট, হর-র!

বিছানা ছেড়ে ওঠে বসলাম, একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তার ওপর অ্যাপ্লিকেশনগুলো পোস্ট করতে হবে। দুপুর বেলায় র্নিধারিত ভাতের হোটেলে খেতে যাওয়ার সময় এখানকার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পিয়ন সোহেলের সাথে দেখা। মনে হলো ছুটোছুটি করছে। কি ব্যাপার দৌড়ঝাপ কেন? সোহেল পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার মতো কোনভাবে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো ঢাকা হেড অফিস থেকে তানিয়া ম্যাডাম এসেছেন অডিট করতে। সকালে এসেছেন। সেকি রাগ! সবাই তার ভয়ে তঠস্থ’। কে সে, জানতে চাইলাম। হেড অফিসে একাউন্টস ম্যানেজার। কয়েকদিন থেকেই অফিস থেকে বলছে তদন্তে আসবেন। পিডি সাহেব ভাবছিলেন অন্য কেউ আসবে। সকালে তানিয়া ম্যাডামকে দেখে সবার চোখ কপালে ওঠে গেল। কার যে কি হয় জানি না। কেন? সোহেল আবার বলল, তানিয়া ম্যাডাম খুব সৎ বলেই এমডি সাহেব তাকে পাঠালেন। তো? তোমাদের সমস্যা কোথায়? সমস্যা কোথায়- পাই টু পাই’র হিসেব নিচ্ছেন। ক্যাবলাকান্তের মতো হেসে সোহেল বলল- বুঝলেন আবিদ ভাই, পিডি স্যার ভয় পাচ্ছে টাকা পয়সা খুব বেশি নয়-ছয় করছে তো। ঠিক আছে, সবই বুঝলাম তুমি কোথায় য্চাছ? এবার নিচু কণ্ঠে বলল, ম্যাডাম সেই সকাল থেকে একবারের জন্যও টেবিল ছাড়েননি। এখন বললেন- একটা হোটেল বা রেস্ট হাউসের রুম ঘন্টা দুয়েকের জন্য ভাড়া পাওয়া যায় কিনা। মনে হয় ফ্রেস হয়ে বিকালে চলে যাবে। ম্যাডাম তো গাড়ি নিয়ে এসেছেন। জানতে চাইলাম, রুম পাওনি? না পেয়েছি। কিন্তু পিডি স্যারসহ সবাই গোপনে বলে দিয়েছে, ম্যাডাম যত তাড়াতাড়ি যাবেন ততই মঙ্গল। আমি যেন ম্যাডামকে গিয়ে বলি, পাওয়া যায়নি। আমার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠলো। শুনেছি নারীরা অনেক বেশি সৎ হয়, পুরুষদের তুলনায়। তাই ভয়ে তানিয়া ম্যাডামের অগোচরে তার সঙ্গে এত বড় অন্যায় করা হলো। আমার আজকাল মাঝে মধ্যে চিন্তা হয়। এই যে চারদিকে সব সর্ম্পকগুলো এত পলকা হয়ে যাচ্ছে; তার কারণ কি? কখনো মনে হয় আমাদের ইগো, স্বার্থ এত বেশি কাজ করে যে সেটাকে অতিক্রম করে অন্যের কাছে নতজানু হতে পারি না। আর স্বার্থের জন্য ভালোবাসার মন, মূল্যবোধটা ক্রমশঃ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে পড়ে গেল পিডি আফসার উদ্দিন ভাইকে একটা বায়োডাটা দিয়েছিলাম। এই সুযোগে যদি ম্যাডামের কাছে একটু সুপারিশ করে বায়োডাটা সাবমিট করেন! আমি খাওয়ার কথা ভুলে সোহেলের সঙ্গে ওদের অফিসে চলে এলাম। আফসার ভাইকে সালাম দিলাম। শুনেও শুনলেন না যেন। তাকালো না, এমনকি আগের দিনের মতো বসতেও বলল না। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। ম্যাডাম পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন। এই সেই বাঘিনী নারী! বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। প্রসাধনহীন মুখ। লম্বা শরীরে এই বয়সেও টানটান চামড়ার অটুট যৌবন। শ্যামলা গাত্রবর্ণ, উজ্জ্বল কালো চুল দুলে উঠলো পিঠে। চোখে তার তীক্ষè বুদ্ধির ছাপ। ছেলেটা কে? আফসার এতক্ষণ পর আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমি ম্যাডামের সামনে সশ্রদ্ধ বিনয়ী ভঙ্গিতে তাকালাম। আফসার আমার পরিচয় দিলেন। ও আবিদ আব্দুল্লাহ। ম্যাডাম হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। খুব তাড়া এমন ভঙ্গিতে ম্যাডাম ডাকলেন সাহেলকে, পেয়েছ? আমি একটু ফ্রেশ না হতে পারলে ঢাকা পর্যল্পø ফিরে যেতে পারবো না। লং র্জানিতে ভীষণ উইক লাগছে। সোহেল কাচুমাচু মুখ করে আগের শিখিয়ে দেয়া কথা তোতা পাখির মতো আউড়ে দিল। ম্যাডাম একটা মোটেল পেয়েছি। আপনি ওখানে যেতে পারবেন না। ভীষণ নোংরা! আফসার বলে উঠলেন, ম্যাডাম আমি যদিও এখানে ব্যাচেলর, আপনি সোহেলকে নিয়ে আমার বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। ম্যাডামের চোখ-মুখে বিরক্ত আর হতাশার ছাপ! আফসার সোহেলকে বলল, মেসে গিয়ে অন্যদের বলো একটু ঘন্টাখানেকের জন্য বাসাটা খালি করতে। তানিয়া সরকার এতণ পর আমার দিকে তাকালেন, এখানে কোথায় কাজ করি, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি। সোহেল আবার ফিরে এল মিনিট পাঁচেক পরে। বলল, বাসায় তালাবদ্ধ। এবার আফসার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাক-ডাক শুরু করলো, এ তো বড় সমস্যাই হয়ে গেল। দেখ তো ভালো করে, কোন জায়গা পাওয়া যায় কিনা। সোহেলকে দিয়ে কিছু হবে না। মুডটা আরো বিগরে গেল তানিয়া সরকারের। আফসারের উদ্দ্যেশ্যে বলল, “আপনারা তো দেখছি দেশলাই বাক্সে পড়ে আছেন। এত টাকা পয়সা খরচ করছেন, বিল-ভাউচার তৈরি করছেন, আর অফিসে ভালো একটা ওয়াস রুমের ব্যবস্থা করতে পারছেন না?” তানিয়া ম্যাডাম স্থির হয়ে বললেন, ‘চলেন, এবার আমি নিজে বোর্ডিংয়ে রুম খুঁজবো। আজ কাজ শেষ করেই ঢাকায় ফিরবো।” এবার আমি কাউকে, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বলে ফেললাম, ম্যাডাম যদি কিছু মনে না করেন, আমার বাসায় চলেন। ওটা আর সাধারণ পাঁচটা বাসাবাড়ির মতোই। আপনি ঘন্টাখানেক সময় রেস্ট নিতে পারবেন। আফসারসহ উপস্থিত সবাই আমার কথায় হা হয়ে গেল। ম্যাডাম ও তাকিয়ে রইলেন। সবাই আমাকে নিশ্চয়ই একটা গবেট টাইপের অথবা অতি দরদি মনে করছেন। কিল্পøু কিছু যায় আসে না। যেহেতু আমি জানি, তার বিরুদ্ধে এটা ষড়যন্ত্র। তার কাজকে হ্যাম্পারড করা, তাকে জিম্মি করে, প্রভাবিত করে তার কাছ থেকে অন্যায়টাকে চালিয়ে নেয়ার জোর করে স্বীকৃতি আদায় করা। আফসার একটু গাই-গুই ভাব করলো। কিল্পøু ম্যাডাম গা করলো না। জানতে চাইলেন, বাসা কতদূর? হেঁটে গেলে পনের-বিশ মিনিট। আর ভ্যানগাড়িতে গেলে মিনিট দশেক লাগবে। ওকে, সোহেল চল। সোহেলকে দিয়ে রেস্তরা থেকে কয়েকটা খাবার প্যাকেট কিনে নিলেন। সঙ্গে আফসার উদ্দিনসহ আরো তিনজন রওয়ানা হলাম আমার বাসার উদ্দেশ্যে। খাবার কিনতে বারন করতে পারলাম না । কারণ দুপুরে আমার বাসায় রান্না হয় না। ম্যাডাম তার গাড়িটা নিলেন না। ভ্যানে যেতে যেতে আমার থাকার জায়গাটার বর্ণনা দিলাম। বন্দর ছাড়িয়ে উত্তর দিকে ওটা মিঠাগাছি গ্রাম। চলার পথে ম্যাডাম দেখতে লাগলো চারদিকে বেশ দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়িঘর আর দূর-দূরান্তে যতদূর চোখ যায়, কেবল ঝিল্কি ওঠা রোদ্দুর। দূর-প্রান্তের সীমানায় সবুজ গ্রাম। ম্যাডাম জানতে চাইলেন, এখান থেকে সমুদ্র কতদূর? প্রায় তিন ক্রোশ দুরে। রাতের বেলায় এখান থেকে তার গর্জন শোনা যায়। বাসায় পৌঁছে ম্যাডাম বাড়ির পিছন দিকটা দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু রান্না ঘরের পেছন দিয়েই শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। ওদিকটায় যাওয়া যায় না। ভেতরে একটা বড়সড় ডোবা। তার ভেতরে ঢিবি জমে গাছপালা-ঝোঁপঝাড় তৈরি হয়েছে। সেখানে নানা বন্য প্রাণী, পাখপাখালির বসবাস।
ম্যাডাম ফ্রেস হয়ে পারফিউম মেখে সরিয়ে দিলেন সারাদিনের কøান্তি। চোখে মুখে একটা ভালোলাগা, তৃপ্তির ছাপ।

বুঝলাম, জায়গাটা তার ভালো লেগেছে। খেতে খেতে ভাবলাম, চাকরির সুযোগটা গেল। আফসারের থমথমে মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, আমার ওপর ক্ষেপে রয়েছে। যাই হোক কিছু করার নেই। কপালে থাকলে কোথাও না কোথাও চাকরি হবে। এরই মধ্যে কথা বলে উঠলো আফসার, ম্যাডাম আবিদ আমাদের প্রতিষ্ঠানে একটা ভালো চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। আফসারের কথা শুনে আমার কান লাল হয়ে গেল লজ্জায়। খেতে পারছি না। খাবারটা মুখ দিয়ে পেট পর্যন্ত গড়াচ্ছে না। কি হলো ব্যাপারটা! মনে হলো একটু খোঁচা দিয়েই কথাটা বলল। উনি কি মনে করলেন! নিশ্চয় স্বার্থপর! ম্যাডাম বললেন, তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড কি? এইতো, বাই জুন-জুলাই রেজাল্ট উইল বি আউট। আগেও বেশ কয়েকটা কর্পোরেট হাউসে চেষ্টা করেছি। ম্যাডাম বললেন, থ্রু প্রপার চ্যানেল অ্যাপ্লাই কর। প্রব্যাবলি ইউ আর বেস্ট। বাট রিমেমবার বেস্ট ক্যান বি বেটার। আর একটা বায়োডাটা আমাকে এক্ষুনি যদি দেয়া যায়, তো ভালো। নয় তো আমার অফিসের ঠিকানায় আমার নামে বায়োডাটা পাঠিয়ে দিও। বাই দ্য বাই, তুমি কত পাও এখানে?
‘অ্যাকচ্যুয়ালি ম্যাম, এটা ছোট একটা এনজিও “সেইভ আওয়ার সোল” ওরা মাইক্রোক্রেডিটসহ মানবাধিকার ও আদার’স প্রোগ্রাম করে থাকে। ওখানে পাঁচ হাজার টাকা পাই। খাওয়া শেষে মিনিট দশেকও বসলেন না। ম্যাডামকে বন্দরে পৌঁছে দিয়ে অফিসে না ঢুকে ফিরে এলাম বাসায়। বিছানায় টানটান হয়ে আর একটা বালিশ মাথায় গুজে সিগারেট ধরালাম। এতোদিন ধরে মিঠাগাছিতে রয়েছি। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে, পড়ে থাকতে হবে? শরীরের কান্তির চেয়ে মনের কান্তিটা বেশি। খুব বেশি কোন চাওয়া নয়। একটা চাকরি! একটা চাকরিতে তিনটা বেসিক নিড ফুলফিল করে। এর পরের স্টেজ সেফটি অর নিরাপত্তা অ্যান্ড দ্যান সোশ্যাল রেসপেক্ট। আমার এতো বেশি কিছু চাই না! মায়ের মুখটা ফিরে এল। সেই বিষন্ন, অপ্রস্তুত, ভাঙ্গাচোরা মলিন মুখ! বাবা ছাড়া কৈশোর কেটেছে। ছোট ছেলে-মেয়ে বুকে আগলে রাখতে রাখতে যুদ্ধ করেছে গ্লানি-হীনমন্যতা-একাকিত্ব আর স্মৃতি কাতরতার সঙ্গে। তবুও খেয়ে না খেয়ে হাসি ঠাট্টা করেছি তিনটি প্রাণ মিলে। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে মনে হয়, সব ভুলে গেছি। আসলে প্রতিটি মুহহৃর্ত আমাকে ভাবায় বলে সমস্ত হƒদয় নিংড়ে কান্নারা ছুটে আসে! হঠাৎ কানে এল বাঁশির সুর! হ্যাঁ, এই তো মিলনের বাঁশি! আরে ওরে তো আমিই আসতে বলেছিলাম। ও ঠিক মনে রেখেছে। আমিই ভুলে গেছি। তড়িঘড়ি করে দুই কাপ চা বানিয়ে ছাড়া ভিটের সামনে গেলাম। আমি স্থম্ভিত! আমার হাত-পায়ে শক্তি যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে! শুধু নিথর জলের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম ওর পেছনে। কি সুর! হƒদয় ছোঁয়া সুরের মূর্চ্ছনায় চারদিকের পাখ-পাখালির আলোড়নও বন্ধ! স্যার, স্যারÑ ডাক শুনে আমার সম্বিত ফিরে এল । চা থেকে ধোঁয়া ওঠে না। তবে কাপের গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম, এখনো একটু গরম আছে। হাত বাড়িয়ে চা দিতে গেলাম। মিলন বলল, সে চা খায় না! একটুও আশ্চর্য হইনি। যে ছেলে এ বয়সেও চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। সে আর কি-ই-বা খেতে পারে! আজো সেই একই কাপড় তার পরনে। উসকো-খুসকো চুল। বললাম, চলো। আগে আমার বাসায় চলো। তারপর তোমার সঙ্গে কথা হবে। কেন স্যার-নুপুরের মতো রিনিঝিনি কন্ঠস্বরে বলল মিলন। আরে বেশি দূরে নয়। এই তো কাছে আমার বাসা। স্যার আপনার বাসা চিনি! চেন… তাহলে আগে আসনি কেন? অনেকেই তো আমার বাসায় আসে। আপনাকে রোজ দেখি। উফ! দেখে তো কথা বল না কেন? ভয় হয়। আমি হো হো করে হাসলাম। কেন, আমাকে ভয় কেন? মিলন শান্ত কণ্ঠে বলতে থাকে প্রথম যেদিন বাঁশি কিনলেন তখনই দেখেছি। আপনার পিছু নিলাম; দেখলাম বাজানোর চেদ্বা করলেন, মসজিদে নামাজে ঢুকলেন। বাসায় যখন এলেনÑ দেখলাম, আমার সেই প্রিয় জায়গাটা; যেখানে আমি রোজ বাঁশি বাজাই। তার কাছাকাছিই আপনি থাকেন। আপনাকে আমার মনে ধরেছে! ও আচ্ছা… হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম–‌ এখন থেকে রোজ আসবে। তোমার কাছ থেকে বাঁশি বাজানো শিখবো, শুনবো! ওকে, গুরু ? আমিই হাসলাম। ওর মুখে হাসি নেই। কথা বলতে বলতে দু’কাপ চা নিজেই শেষ করলাম। চারদিকটায় একবার তাকালাম! এখান থেকেও খানদের বাড়ির দীঘির উত্তর পাশটা দেখা যায়। মস্ত বড় দীঘি। উঁচু-নিচু পাড়ে ছোট-বড় ঝোঁপঝাড়। ওখানে দাঁড়িয়ে চারপাশটা খুব ভালোভাবে দেখা যাবে। একদিন দেখতে হবে। সুর্যও ডুবে যাচ্ছে। আলোর ছটায় পশ্চিম আকাশটায়, সে যে কি রঙের খেলা! ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের ধারে-ধারে শাড়ির পাড়ের মতো লাল নীল, ধূসর কত যে রং! বাসায় ফিরে দু‘টো শার্ট-প্যান্ট দিলাম হাতে ধরিয়ে। বললাম, কলের কাছে গিয়ে গায়ের পোশাক ফেলে দিয়ে এটা পড়ে এসো। চায়ের কাপ রাখতে ভেতরে ঢুকলাম। ফিরে এসে দেখি মিলন নেই। মাগরিবের আযান দিলো। বাসায় সেরে নিলাম নামাজটা। মিলন আজ আর আসেনি। ওর জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো। কি ব্যাপার ছেলেটা কি কিছু মনে করলো বা রাগ করে চলে গেল?

দিন পাঁচেক পরে অফিস থেকে বাসায় ঢুকতেই দেখি বারান্দায় মোড়ায় বসা মিলন। আমার দেয়া প্যান্ট শার্ট পড়া। আরে, কি ব্যাপার মিলন যে! কই কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে বলতো; এই চার-পাচঁ দিন এলে না। কেন? এক সঙ্গে এতগুলো কথা বলে ফেললাম। ও নিচু কণ্ঠে শèথ গতিতে বলতে লাগলো। স্যার, আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি! ও তাই নাকি! কেন বল তো? আপনার লোভ নেই । মন সাচ্ছা। মাটির মানুষ! আপনার জামা পড়ে আমি অনেক জায়গা ঘুরেছি কয়েকদিন। তাই আপনার কাছে আসতে দেরী হলো। স্যার, আপনি মনে কষ্ট পাইছেন?কি যে বল! তুমি আসনি বলে মনে কষ্ট পেয়েছি। আমি জানি। ও তাও জানো! হা হা হা। ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল রতনের মা। বারান্দা অন্ধকার। তবে বাইরের নির্মেঘ আকাশে চকচকে চাঁদ। গোটা উঠোন জুড়ে চাঁদের টলটলে আলো। আলোর ছটা বারান্দার অন্ধকার অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে। মিলনের গায়ের শার্টটা মনে হয় ও আবার ধুয়েছে। বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে অন্ধকারেও। মিলন চলে যেতেই পলাশসহ চার-পাঁচজন এল। ওরা রাতে আমার কাছে ঘুমায়। খান বাড়ির ছেলে। বন্দরের স্কুলে মাধ্যমিকে পড়ে। এ বাড়িটা খানদের। বাড়ির মালিক নিজাম খান বলল, যেহেতু আমি একা। আমার সঙ্গে তার দুই ছেলে থাকলে একাকিত্ব ঘুচবে। আর ওরা আমার কাছ থেকে পড়া দেখিয়ে নিতে পারবে। আমারও খারাপ লাগে না। ওদের সঙ্গে বেশ ভালোই সময় কেটে যায়। এ কয়েকদিন রাতে ওরা পড়া শেষে যতক্সণ না আমাকে ডাকে। ততক্ষণ আমি মিলনের সঙ্গে বেঞ্চিতে বসে গল্প করি, বাঁশি বাজাই। আর সে সময়টা শুধুই ঘোরের মধ্যে কেটে যায়; সুরে সুরে পিপাসার্ত হই!

আজ ছুটির দিনে গোধূলি বেলায় মিলন এল। বাসায় নয়। ওর উপস্থিতি জানালো বাঁশি বাজিয়ে। ফ্রেশ হয়ে ওর কাছে যাবো । কলতলায় দাঁড়িয়ে পহৃব দিকে আগে তাকিয়ে এদিক সেদিক খুঁজে নিলাম মিলনকে। রাস্তার উত্তর পাশ থেকে বয়ে যাওয়া ছোট খালের মধ্যে ঝুঁকে থাকা খেঁজুর গাছের গোড়ায় বসা মিলন । খাল পাড়ের গর্ত থেকে মাছরাঙ্গা বেরিয়ে আসছে। ফুরুৎ করে উড়ে খেঁজুরডালে বসলো । দু’একটা রিফ্যুজি পাখিও বের হচ্ছে আবার গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। খাল থেকে মাঝে মধ্যে ধান বা শস্য ভরা নৌাকা যায়। । ও এপাড়ে বসে উত্তর-পূব দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। ওর বাঁশির সুরের সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে বাতাস নুপুরের ছন্দ তুলছে। খালের পানি রুপালী ঢেউয়ের ঝিলিক তুলে হাসছে। চারদিকে কেমন একটা আলোড়ন! মিলন বাঁশি বাজিয়েই চলছে। ওর পেছনে আমাকে খেয়াল করার সময় নেই ওর। এ সুরের মধ্যে আমার স্তব্ধতা, নীরবতা কাটিয়ে মিলনের পাশে বসলাম। ওর বাঁশির সুর থেমে গেল। এখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। ওর বাঁশির মতো এমন বাঁশিও আর দেখিনি।

অনেকটা বাঁকা ধনুকের মতো। এটা কি বাঁশি মিলন? কণ্ঠে যেন বজ্র এবার; আঁঢ় বাঁশি! একটু আৎকে উঠলাম ওর কন্ঠ শুনে। ও আবার বলল প্রথম যখন হাতে নিয়েছিলাম, তখন লোভ করেছিলাম! এখন নাই! আরো একবার চমকে উঠলাম! বললাম, বাদ দাও এসব। প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যার পর দেখা হলো মিলনের সঙ্গে। চাঁদের আলো গাছের পাতার ফাঁক-ফোঁকর গলে রাস্তায় পড়েছে। মিলন শিমুল গাছ ঘেষে বসলো বাঁশি নিয়ে । বললাম, তোমার বাঁশিটা দাও। একটু স্পর্শ করে দেখি। এবার মিলনই আৎকে উঠলো! স্যার জানেন, গ্রামের মায়েরা বলে আঁঢ় বাঁশি বাজালে মায়ের বুক খালি হয়! যে কোন মায়ের কানে এ বাঁশির সুর বিষের মতো! তাহলে তুমি তো বাজাও! এখন আমার কেউ নেই! মানে, তোমার মা-বাবা? স্যার, আমি নাক দিয়ে বাঁশি বাজাতে পারি ;কথা শেষ হতে না দিয়েই বলে মিলন। ও আচ্ছা! কৌতুহল নিয়ে বলি। ঠিক আছে বাজাও বাঁশি। মিলন দুই নাকের ফুটোয় দুটি বাঁশি ধরে বাজায়। মোহচ্ছন্ন হই। সুরের মুর্চ্ছনায় গাছের পাতারা তাল দেয়! বাঁশি বাজে; দক্ষিণা হাওয়া আসে! সমুদ্রের ডাক বন্ধ হয়ে যায়! চারদিকে পাখ-পাখালিদের আনন্দে ছুটোছুটি! এ কেমন পাগল করা সুর! কতক্ষণ ছিলাম বলতে পারবো না। তবে পলাশের হাক শুনে ঘোর কেটে গেল। পাল্টা জবাব দিয়ে বললাম, আসছি। মিলনকে রাতে আমার বাসায় খেতে বললাম। ও বলল স্যার আপনি যান, আমি আসছি। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এল। সে চলে যায়। জোড় করতে পারি না। ওর মুখের দিকে তাকালে কেন জানি না কথা হারিয়ে যায়! এ ক’দিনেও আমার বাঁশি বাজানো শেখা হলো না। ওর বাঁশির সুরের টানে নিজের কথা ভুলে যাই। রোজ বলি, কাল কিল্পøু আমাকে শিখিয়ে দেবে। হয় না! কাল বৌদ্ধপূর্নিমা। মিলন বলেছে, ও যত সুর জানে সব আমাকে শিখিয়ে দেবে!

দুপুর বেলা রেস্তরা থেকে খাওয়া-দাওয়া করে অফিসে ঢুকতেই দেখি টেবিলে একটা কুরিয়ার। সামনের চায়ের দোকানীকে বলে রাখা আছে, দুপুরে খেয়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আমাকে রোজ এক কাপ রং চা দেয়। প্রতিদিনের মতো আজও টেবিলে চা দিয়ে গেল। হাতে চা নিয়ে খেতে খেতে খামের ওপরটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। আরে, এ তো তানিয়া ম্যাডামের থেকে এসেছে। হইতে তানিয়া সরকার! বুকটা ধক করে উঠলো, হাত থেকে চায়ের কাপটা ও পড়ে গেল। উফ! কি যে করি না! সব কিছুতেই তাড়াহুড়ো! চিঠিটা খুলতেই হাত-পা যেন অবশ হয়ে এসেছে! খুশিতে! এতো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। হেড অফিসে আমাকে একাউন্টস অফিসার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শুরুতেই স্যালারি পনের হাজার টাকা! রেজাল্ট আউটের পর বেতন বাড়াবে! আমি কাঁদবো কি হাসবো। চোখে খুশির জোয়ার; সমুদ্র থেকে ছলকে টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছে! আজ মাসের প্রায় কুড়ি দিন। আগামী মাসেই জয়েনিং। বুক ভরা খুশি নিয়ে ছুটে এলাম বাসায়। শেষ বিকেলের বুনো ঘাসের গন্ধ ভরা মাতাল হাওয়ার মধ্যে নির্জন মাঠে শুয়ে রইলাম। বুকের ওপর চেপে রাখা চিঠিটার অপর অংশ বাতাসে পতপত শব্দে উড়ে আমাকে স্বাগত জানায়। মাথার ওপর আস্তে আস্তে গাঢ় হয় মেঘ না থাকা আকাশ। দূরে ঝকঝকে তারারা সারি-সারি ফুটে ওঠে নকশি কাঁথার মতো। আজ চার-পাঁচ দিন হলো মিলন আসে না। অথচ মনে হয়েছিল, সুসংবাদটা প্রথম মিলনকেই জানাবো। মনের মধ্যে খচখচ করে ওঠে! হ্যাঁ তাই তো; ও আসে না কেন? কাল বিকালে বাড়ি যাবো। তারপর ঢাকায়। আজ মিলন এলে বাঁশি বাজানো শিখবোই। বিকেল থেকেই ওর অপেক্ষায় রয়েছি। হাতে বাঁশি নিয়ে সেই শিমুল তলায় ছুটে গেলাম। বাঁশিতে ফুঁ দিলাম। আশ্চর্য! বাঁশি বেজে উঠলো! একটানে বাজিয়ে চললাম! হ্যাঁ তাই তো; পেরেছি আমি! পেরেছি! মিলন, কোথায় তুমি! তোমাকে দেখাবো। কিন্তু আমার বাঁশি বাজানোটা আর সাধারণ পাঁচজনের মতোই! তোমার মতো অসাধারণ নয়। যাই হোক, এটুকুও পারতাম না !

এ কি করে সম্ভব! কোথায় তুমি! মনের মধ্যে শুধু আকুলতা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম বাঁশি বাজিয়ে। আমার বাঁশির সুরশুনে পলাশরাও ছুটে এল। ওদের সঙ্গে বাসায় ফিরে গেলাম। কিল্পøু মনের মধ্যে মিলন নামের আকুলতা! শুধু কোথায়, কোথায়? রাতে বাইরে বেঞ্চিতে বসে অনেকক্ষন অপেক্ষা করলাম। কালপুরুষ এসে নামলো উঠোনে। নাহ! এখন তো আর ভাবাই যায় না তার আসার কথা। ঘুম থেকে পলাশ কখন ওঠে গেল টের পেলাম না। আজও মতি মিয়া হালের বলদ নিয়ে যাচ্ছে। সেই একইভাবে হাক ডাক বলদের সঙ্গে। ছুটে বাইরে এলাম। ডাক দিলাম, মতি চাচা। ফিরে তাকিয়ে দাঁড়ালেন। কাছে যেতেই হাসি হাসি মুখে বললেন-শুনলাম স্যার আপনার বড় চাকরি হইছে! বললাম, চাচা দোয়া করবেন আমার জন্য। কথা না বাড়িয়ে বললাম, মিলনের বাড়ি কোথায়? অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, কোন মিলন? ওই যে লম্বা, কালো করে বাঁশি বাজায়। বলল, পূব পাড়ায় মল্লিক বাড়ি। কিন্তু স্যার আপনি তার নাম জানলেন কিভাবে? কেন, ওতো আসে আমার কাছে। আজ ক‘দিন ধরেই আসে না। একটু দেখা করে যাওয়া উচিত। হা হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি ব্যাপার কথা বলছেন না কেন? জবাবে বললেন- কি বলবো; কি বলছেন- তা আপনি জানেন? কেন-জানতে চাইলাম। আরে ও আসবে কোথা থেকে বেঁচে আছে না মরে গেছে কেউ জানে না। কি বলছেন কি আপনি? এর মধ্যে পলাশও এল। ও বলল, আজ প্রায় ছয় বছর হলো মিলনের কোন হদিস নেই। আমার ব্যাকুলতা বাড়লো । মিলনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমি বাঁশি বাজানো শিখেছি, কিছুতেই মানতে চায়না, বিশ্বাস করতে চায় না ওরা। পলাশ আমাকে টেনে নিয়ে বেঞ্চিতে বসালো তারপর বলতে লাগলো মিলনের কথাÑমল্লিক বাড়ির ছেলে। বাবা সিরাজ মল্লিক মহাজনদের নৌকায় খাটে। এ সপ্তাহে যায় আর আসে ওসপ্তাহে। মা কুয়াকাটার শুটকি মাছের শ্রমিক। আর মিলন সারাদিন কখনো হাটে-বাজারে, কখনো সমুদ্রের কাছে, কখনো রাস্তার মোড়ে গান গেয়ে আর বাঁশি বাজিয়ে সময় কাটায়। স্কুলে যায় না, কাজ করে না। তাই তার মা মাঝে মধ্যেই রাতের বেলা মারধর করতো। যেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো মায়ের শাসনের ভয়ে এই বেঞ্চিতে বসে বাঁশি বাজাতো। একদিন বন্দরে দেখা হয় মিলনের সঙ্গে এক বংশীবাদকের। মুখভরা দাড়ি। চোখ দেখা যায় না ভুরুর পাকা চুলের জন্য। জটা চুল। তার বাঁশির সুরে কেউ কখনো দুই পয়সা তার কাঁধের ঝুলিতে ঢুকিয়ে দিত। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজায় না বুড়ো। একদিন দেখা গেল, বুড়োর সঙ্গে মিলনের ভাব। মিলন ও তার পেছন পেছন। মাঝে মধ্যে হারিয়ে যায় কোথায়! আবার ফিরে আসে। এলাকার সবাই মিলনের বাঁশি শোনে। সে যে কি সুরের মুচর্ছনা। কারো পেটে এক বেলা খাবার না গেলেও, মিলনের বাঁশির সুর ধারা ভুলিয়ে দেয়! একদিন শেষ রাতের দিকে নিজাম খানের ঘরের দরজায় সজোড়ে ধাক্কার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় সবার। দরজা খুলতেই পড়ে থাকতে দেখে মিলনকে। আর তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে! মসজিদের ইমাম এসে তাৎণিকভাবে আয়াতুল কূরসী, ইয়াসীন সুরা পড়ে ফুক দেয়। কিল্পøু মিলনের জ্ঞান ফিরে আসে না। তারপর দীর্ঘদিন শহরে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। প্রায় মাসখানেক পর তার জ্ঞান ফিরে আসে। আবার কথা বলতে শুরু করে। কিল্পøু খুব কম কথা বলে। পাঁচটা প্রশ্নের জবাবে একটা । বাড়ি ফেরার পর সবাই জানতে চায় মিলনের কাছে, সেদিন কি ঘটেছিল। মিলন জানায়. সেদিন ও সন্ধ্যায় মা বকাবকি করে, কোন কাজ না করে সারাদিন ভবঘুরে হয়ে থাকায়। সন্ধ্যায় বাড়ির ছেড়ে পথ ধরে চলতে থাকে পুব দিগন্ত খালের পাড় দিয়ে । এ সময় একটা চলতে থাকা নৌকা দিয়ে নেমে আসে সেই বংশীবাদক! জানতে চায় কিরে তোর মন এত অশান্ত কেন! দেশান্তরী হবি? মিলন বলে, না সে মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। তবে বড়লোক কি করে হওয়া যায়? জবাবে সে মিলনকে কাজ করতে বলে। তাতে নারাজ মিলন-খুব রেগে বলে, সহজ উপায় বলো। বুড়ো মিলনের চকচকে চোখের দিকে তাকায়!

উত্তেজিত হয়ে বলে, তোকে লোভে পেয়েছে! তুই কি চাস; তা আমি বুঝতে পারছি! মিলন ও উত্তেজিত হয়ে তার হাত ধরে! বলো বলো! আমি ধনী হতে চাই! না খেয়ে থাকতে চাই না। সে মিলনকে কঠোর গলায় বলে, তুমি ভাবছো সহজ! কিন্তু মোটেও সহজ নয় মিলন! সাহস-শক্তি, মনের জোড়ও দরকার! বংশীবাদক জানায়, বৌদ্ধ র্পূনিমার গভীর রাতে নিজেকে সম্পূর্ণ পোশাকমুক্ত রেখে ওই যে ছাড়া ভিটে রয়েছে ওখানে যাবে। তারপর তিনটে মাটির হাড়ির একটিতে বসবে, আর দুটোতে দুই পা রেখে এক মনে বাঁশি বাজাবে। ভয় পেলে চলবে না। যখন কেউ তোমাকে বলবে আরো বাঁশি বাজাতে তখন তুমি যা ইচ্ছা চেয়ে নিও, বাঁশি বাজানোর বিনিময়ে। তবে যতক্ষণ না চলে যাবে, ততক্ষণ বাজাতে হবে। মনে রেখ আজই তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা! আর কোনদিন আমাকে স্মরণ করো না। মিলনের চোখ আটকে গেল চাঁদের দিকে। এত বড় চাদঁ! ও হো আজই তো বৌদ্ধপূর্ণিমা। রাতে আর বাড়ি ফেরে না সে। গভীর রাতে মিলন বাঁশিতে টান দিল। এক মনে বাঁশি বাজিয়ে চলছে। কতক্ষণ বাঁশি বাজিয়েছে জানে না! বাঁশির সুরে সরদার বাড়ি, খান বাড়ির ছাড়া ভিটের হুতোম প্যাঁচা আর নিশি ডাকা পাখির ডাক বন্ধ হয়ে গেছে। খানদের ডোবা ঘেষা খালের পাড়ে কচুরিপানার মধ্য থেকে ডাহুকের ডাক শোনা যায় না! শুধু বাঁশির সুর! কিছক্ষণের মধ্যেই শরীরে শীতল বাতাসের স্পর্শ! এরপর জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে! চারদিক থেকে হুহু করা বাতাস, সঙ্গে সমুদ্রের গর্জন! কিন্তু এটা এখন আর তিন কিলোমিটার দূরে নয়। সমুদ্র যেন ওর কানের মধ্যে হুংকার দিচ্ছে। চারপাশে খানিকক্ষণ আগুনের ছোয়া, শীতল বাতাস আর তুফান!

তবুও বাজিয়ে চলছে চোখ বন্ধ করে! এতক্ষণে সব বন্ধ হয়ে গেল। ও টের পেল কারো অস্তিত্ব! নুপুরের রিনিঝিনি-কিনিকিনি শব্দ; আবার মনে হচ্ছেহাত বাড়ালেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় সমান উঁচু কয়েক জনকে ছুঁয়ে দিতে পারে ।এবার থেমে গেল বাঁশি! আবার বাঁশির সুর! বাজছে-বাজছে! এবার কারো কন্ঠ! এই নারী কন্ঠ! আবার এই যেন বাঘের গর্জন। বাজাও মিলন, বাঁশি বাজাও! চারপাশে ঘুর্ণায়মান বাতাস আর কন্ঠ, মি-ল-ন,বাজাও। বাঁশি বা-জা-ও মিলন। ও.ও.ও মি-ল-ন ! বাঁশি বাজাও! আহ! বাঁ-শি; বাজাও। মি-ল-ন.ন.ন…। মিলন বাজানো বন্ধ করে এবার চারদিকটা তাকোলো। দিনের বেলায় ভিটের উত্তর পাশে আকাশের দিকে নাক উঁচু করে থাকা বাঁশঝাড়টা এখন ওর মাথার ঠিক এক হাত ওপরে! ওর ঘাড়ে শীতল নিঃশ্বাস পড়ছে! চারপাশটায় লাল-নীল আলোর ছটা! বাঁশি ঠোটে চেপে ধরে, কিন্তু নিঃশ্বাস আটকে আসছে। মনে পড়ে বুড়োর কথা বাঁশি যেন হাত থেকে পড়ে না যায়! এক পা-দু‘পা করে পেছনে হাটছে এরপর ওরে আল্লাহ‘রে বলেই দে-ছুট ।

মনে হচ্ছে ওর পেছনে কেউ ছুটছে! করুণ স্বরে কাঁদছে নারী কন্ঠ নাকি পুরুষের কন্ঠ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধুই কান্না । শিশুরা যেমন কিছু না পেলে কাঁদে! বেগতিক দেখে খানদের বাড়ির দিকে দৌঁড়ে গেল। ঘরের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়লো। এরপর চিকিৎসা শেষে ভালো হয়ে যাবার পর ঘর থেকে আর বের হলো না কয়েক দিন। একদিন সন্ধ্যা থেকে নেই মিলন। তিন-চার মাস পরে তেঁতুলিয়ার নদীর চরে একটা লাশ পাওয়া গেল। কিন্তু সেটা মিলনের না, কার তা সনাক্ত করা গেল না। সবাই ধরে নিয়েছে মিলন নেই পৃথিবীতে! নয়তো বেঁচে থাকলে এই ছয়-সাত বছরে একবার হলেও আসতো। সেই বংশীবাদককেও দেখা যায়নি! সব শুনে আমার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরতে লাগলো।

পলাশকে নিয়ে গেলাম মল্লিক বাড়ি। নিজের চোখ কানকে বেশি বিশ্বাস করবো নাকি অন্যের কথা! যদি সত্যিই ও ফিরে আসে! সামনে মাটির দেয়াল ফাটা ও ভেঙ্গে পড়া। পাচিলে গোলপাতা চাপানো কোথাও একফালি খঁড় পচে সাদা হয়ে গেছে। ঘরের চালাটা টালির। মেহেদী গাছ মাথা তুলেছে উঠোনের কোণা থেকে। একটা চরুই পাখি গা চুলকাচ্ছে ডালে বসে। দরজায় পাটকাঠির কপাট, তলায় খানিকটা টিন দেয়া। হয়তো সামনের বাঁশ বাগান থেকে কোন জন্তু ঘরে ঢুকতে না পারে তার জন্য এ উপায়। দাওয়ায় বসে নিজের মাথায় নিজে বিলি কেটে উকুন আনার ব্যর্থ চেষ্টা মিলনের মায়ের। মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে। পলাশের কথা শুনে হাহাকার করে ওঠে। বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে বলল“ওই যে গেল আর ফিরে আইলো না আমার বাজান! গরীবের ঘরে জন্মাইছো বইলা তার এত অভিমান! বাজানরে, ছয়টা বছর ধরে বাড়ির বাইরে কাজ-কামে যাই না! এই বুঝি আমার বাজান ফিইরা আইলো। কিন্তু আইলো না” কান্নার সঙ্গে সঙ্গ দেয় পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে বাঁশপাতা শনশন আওয়াজ তুলে!

কাপড়-চোপড়ের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বন্দরের দিকে রওয়ানা হলাম। হাতে বাঁশিতে টান দিতে পারছি না। কান্নাটা বুকের মধ্যে চেপে বসেছে।! না আসে না! এ জীবন এমনই সর্পিল নদীর মতো যেখানে কেবল ভাঙ্গন আর প্লাাবন। এ দীর্ঘ স্রোত পলে কেবল নুড়ি গুড়িয়ে যাবার হাহাকার শুনেছি শান্ত কলতানে কখনো বাজেনি সে জলে। এই মুহহৃর্তটার মতো কিছু কোন দিন আসেনি জীবনে। মনের ভেতর কেমন যেন বুদবুদ উঠছে। শ্বাস নিতে কদ্ব হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বার কয়েক চিৎকার করে মিলনকে ডাকলাম! যদি আবার ফিরে আসে শুধু আমার কাছে! বাঁশি বাজিয়ে চলেছি; নাহ্ আসে না। তবুও বাজাই আর ফিরে ফিরে তাকাই…


ছোট গল্প ( ভৌতিক)

পূণ:প্রকাশিত ( প্রথম প্রকাশ দৈনিক আমার দেশ ২০১৩)