`‌নকশিকাঁথার মাঠ ‘শুধু পল্লী-প্রকৃতির নয়,সমগ্র বাঙালির জীবনকাব্য

আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২২
0

সমকালীন কবিদের মধ্যে নজরুলের পরে আর কেউই জসীম উদ্দীনের মতো জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেননি। এমনকি পরবর্তীতেও আর কোনো কবি তার জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হননি। জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় বিখ্যাত কবি। পল্লী-প্রকৃতির রূপমাধুর্য তিনি অসাধারণ শিল্পশৈলীতে তুলে ধরে বাংলা কবিতায় অসম্ভবরকম জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।

তারপরও জসীম উদ্দীন যেভাবে ঘাট-মাঠের মানুষের কবি, জীবনানন্দ দাশ সেখান থেকে খানিকটা দূরেই। জীবনানন্দ দাশ যতখানি পল্লী-প্রকৃতির কবি, পল্লীর মানুষের ততখানি নন। পল্লী-নগরসভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্য সবমিলে জীবনানন্দের জগৎ ভিন্ন।

জসীম উদ্দীনের পরেও আর একজন বাঙালি কবি পল্লী-প্রকৃতি ও পল্লীর মানুষকে নিয়েই জীবনভর কবিতা লিখেছেন, তিনি ওমর আলী। একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও, ব্যাপক জনপ্রিয়- সে অভিধা তিনি লাভ করতে পারেননি।

জসীম উদ্দীনের এ রকম জনপ্রিয়তা লাভের মূল কারণ কী ছিল- সে বিষয় ভাবা যেতেই পারে। পল্লীর সহজ-সরল জীবনগাথাই তার কাব্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভে মূল কারণ- এ প্রশ্নও খুব স্বাভাবিক। পল্লীর এ সহজ-সরল জীবনগাথা তো অন্য কবিরাও তাদের কাব্যে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করে ছিলেন। কিন্তু তারা জসীম উদ্দীনের মতো কবিখ্যাতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভে সক্ষম হননি।

নিখাঁদ মাটির গন্ধভরা তার কাব্য। যা খুব সহজেই দখল করে নিতে পেরেছে পাঠকসাম্রাজের হৃদয়। যে কারণে ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যের আবেদন বাঙালি-পাঠকের কাছে চিরন্তন। এ যেন বাঙালি হৃদয়ের সুতো দিয়ে গাঁথা-শিরাধমনিতে নিত্য প্রবাহিত। আর সে কারণেই ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ শুধু পল্লী-প্রকৃতির মানুষের নয়, সমগ্র বাঙালিরই যেন জীবনকাব্য হয়ে উঠেছে।

তিনি পল্লীর জীবনগাথাকে যেভাবে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন, সমাজচিত্রকে যে নিপুণতায় এঁকেছেন, গ্রামীণ মানুষের মনস্বত্বঃ যেভাবে তিনি ধরেছেন, তাদের মানবসম্পর্ক ও প্রেমকে যে ট্রাজিক রূপদান করেছেন, সর্বোপরি সামগ্রিক বিষয়কে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ করে অসাধারণ ভাষাভঙ্গিমায় কাব্যরূপ দান করেছেন- তা পাঠকপ্রিয়তা লাভে বড় শক্তি।

নজরুল পরাধীন দেশের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অগ্নিবীণা বাজিয়েছিলেন, বিষের বাঁশিতে সর্বনাশার সুর জাগরিত করেছিলেন, মহাসমুদ্রের তুফান কবিতায় এনেছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মহামন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, এ সব তাঁর আকাশ-স্পর্শী জনপ্রিয়তা অর্জনের মূল কারণ। জসীম উদ্দীন নজরুলের এ ধারায় একটুও না গিয়ে পল্লীর সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনাকে কাব্যে ধারণ করে পাঠকের হৃদয় জয় করেন। তাঁর কবিতার করুণ রস বা ট্রাজেডিই পাঠকপ্রিয়তা লাভে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে- এমন বিবেচনা নানাকৌণিক থেকেই নির্ণীত হতে পারে।

জসীম উদ্দীনের কাহিনী কাব্য চারটি : ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’, ‘সকিনা, ও ‘মা যে জননী কান্দে’। এ চারটি কাব্যেই ট্রাজেডি রস সঞ্চারে কবি সফলতার পরিচয় রেখেছেন।

‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্য দুটিতে শেকসপিরিয়ান ট্রাজেডি রূপবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে। কর্মের ফলই যে মানুষ ভোগ করে এ দুটো কাব্যে শেকসপীয়রের নাটকের ট্রাজেডির মতোই একই সত্যরূপ লক্ষণীয়। এখানে আলোচনা ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ দেখা যায়, কাব্যে রূপাই ও সাজু বিয়ে করে সুখের সংসার বেঁধেছিল।

বন গেঁয়োরা যখন গাজনা চরের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছিল, সে খবর পেয়েই রূপাই সড়কি-ঢাল নিয়ে গাজনাচরে কাইজা করার জন্য ছুটে যায় এবং নেতৃত্ব দেয়। রূপাই ইচ্ছে করলে এই কাইজা সে এড়াতে পারত। কিন্তু কাইজা শেষে যখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন অনুশোচনা আর বিচ্ছেদের আগুনে দগ্ধ হওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করা থাকে না। সাজুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়।

কিন্তু রূপাইকে একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না সাজু। প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর প্রেমের অগ্নিশিখা জ্বলতে থাকে। রূপাইয়ের ফেরার অপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। এক সময় সবাই ফিরলেও রূপাই ফেরে না। সাজুর দেহমন জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। জীবনপ্রদীপ আস্তে আস্তে নিভে আসতে থাকে। খুঁজতে থাকে নিজের অপরাধ। কোন্ অপরাধে তার এ শাস্তি! সাজুর কান্না শুধু পরিবার নয় আশাপাশের সমস্ত মানুষকে ব্যথিত করে। প্রকৃতিও যেন সে কান্নায় একাত্ম হয়ে ওঠে।

জীর্ণ-শীর্ণ শরীরে সাজু নকশিকাঁথায় নিজেদের জীবনের নানা স্মৃতিচিত্র আঁকে। একই সঙ্গে মায়ের কাছে আবেদন জানায়- মারা গেলে এই নক্শিকাঁথাটি যেন তার কবরের গায়ে মেলে দেয়া হয়। সাজুর মৃত্যুতে এ কাব্যে যে বেদনার্ত পরিবেশ তৈরি হয় তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় তার মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদ ও আহাজারি। রূপাই যে ভুল করেছিল এর চরম মূল্য শুধু সাজু কিংবা সাজুর মা-ই দেননি, রূপাই নিজেও দিয়েছে। সে-ও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। তারও মৃত্যুও ঘটেছে। তার মৃত্যুর ভেতর দিয়েই ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ সার্থক ট্রাজেডি গুণসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

এ কাব্যে রূপাইয়ের ভুল থেকেই ট্রাজেডির বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই বীজ রূপাই থেকে সাজু, সাজু থেকে তার বৃদ্ধা মা-এ সংক্রমিত হয়ে পরিপূর্ণ এক ট্রাজেডি রূপ ধারণ করে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ও আমরা দেখেছি সব বিষাদের মূলে রাবণ।

মেঘনাদবধের ট্রাজেডি রাবণের ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে। ‘নক্শিকাঁথার মাঠ’ কাব্যেও রূপাইয়ের ভুল ট্রাজেডি হয়ে উঠেছে রূপাইয়ের নিজের জীবনে, তার স্ত্রী সাজু ও সাজুর বৃদ্ধা মায়ের জীবনে। যা একটি ভুল থেকেই সংক্রমিত। জসীম উদ্দীন ট্রাজিক রূপায়ণে ‘নক্শিকাঁথার মাঠে’ সার্থকতা দেখিয়েছেন।

জসীম উদ্দীন তার ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কাব্যে সচেতনভাবে ট্রাজেডির আবহ নির্মাণ করেছেন। এ কাব্যের স্থান-কাল-পাত্র-চলন-বলন-কথন একেবারেই গ্রামীণজীবন স্নাত। যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, বাড়তি কোনো রঙ-ঢঙ নেই, যা তাই শিল্পের মহিমায় উদ্ভাসিত। এ কাব্যের চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যাওয়া যায়, বুক ভরে শান্তি করে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, আবার বুক খুলে মন ভরে কাঁদাও যায়।

সংগৃহিত