সোহেল সানি
একসময় ওনারা ছিলেন জাসদের ডাকসাইটে নেতা। এখনো কেউ কেউ ডাকসাইটে রয়েছেন। কিন্তু তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর যাহোক এখন আর সেই স্বপ্নে নেই, যে স্বপ্ন দলটিকে পেয়ে বসেছিল। যে স্বপ্ন ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের। সে ক্ষমতা নির্বাচনের ফলাফলে হোক আর পেশি শক্তির মাধ্যমে দখলের মাধ্যমে হোক। তারা এ লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিল সশস্ত্র গণবাহিনী ও সেনাবাহিনীর মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। জাসদের সশস্ত্রপন্থায় বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের ঘোষণা ব্যর্থ হলেও এর ক্ষমতার ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রকারান্তরে জাসদের ভ্রান্ত নীতিই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথকে প্রশস্ত করে দেয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কারামুক্ত জাসদ নেতারা ফের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন নিয়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সংঘটিত করেছিল সাত নভেম্বর অভ্যুত্থান। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নায়ক খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমসহ তাঁর সঙ্গীদের হত্যার মাধ্যমে যে অভ্যুত্থান সফলতা লাভ করেছিল। এক কথায় কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম ও হাসানুল হক ইনুর গণবাহিনীর সেই অভ্যুত্থান সফল হলেও ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন ভঙ্গুর হয়ে যায়। মুক্ত জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সেনাপ্রধানের পদে ফিরেই জাসদের ১২ দফা দাবি ভিত্তিক ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে কর্নেল তাহেরের ফাঁসিতে মৃত্যু ও সিরাজুল আলম খান, এম এ জলিল, আসম আব্দুর রব ও হাসানুল হক ইনু কারাদণ্ডদানের মাধ্যমে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে মশাল প্রতীক নিয়ে জাসদ দশটি আসন লাভ করলেও অচিরেই নেতৃত্বের কোন্দলে টুকরো টুকরো হতে হয়। এরশাদের ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে শুরু হয় জাসদের ডিগবাজির রাজনীতি। অনেকে এমপি মন্ত্রী হয়ে যান। ১৯৮৮ সালে জাসদ সম্মিলিত বিরোধী দল কপ গঠন করে এরশাদের একতরফা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা হন আসম আব্দুর রব। যখন শাহজাহান সিরাজ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে পৃথক জাসদ বিরোধী দলীয় রাজনীতির ময়দানে। ১৯৯১ সালে জাসদ (সিরাজ) এর প্রার্থী হিসেবে শাহজাহান সিরাজ জয়ী হলেও স্রেফ মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে বিএনপিতে যোগ দেন। নৌ প্রতিমন্ত্রী হলেও ২০০১ সালে বিএনপি সরকারে এলে তিনি পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছিলেন। সম্প্রতি মারা যাওয়া শাজাহান সিরাজ বিএনপিতে একরকম উপেক্ষিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাসদ প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রবকে প্রথমে নৌপরিবহন ও পরে মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রী করেন।
কিন্তু বর্তমান সম্পর্ক আবারও সাপেনেউলে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে ডঃ কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে বিএনপি দলীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে আসম রব তাতে যোগ দেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। জাসদের বহু নেতা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য গা ভাসিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে।
এমপিসহ ডজন নেতা রয়েছেন আওয়ামী লীগে । হাসানুল হক ইনু টানা দশ বছর তথ্য মন্ত্রী ছিলেন। বিএনপিতেও আছেন অর্ধশত নেতা। জাপায় তিন মহাসচিবই জাসদ থেকে হওয়া। ’৭৫-এর পূর্বাপর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। আওয়ামী লীগ নেতারা মাঝেমধ্যে প্রশ্ন তুলছেন জাসদ নিয়ে। আওয়ামী লীগে জাসদের ডজনেরও বেশি নেতা রয়েছেন। একজন মন্ত্রীও ছিলেন। এমপি রয়েছেন চারজন।
বিএনপিতেও জাসদের ছড়াছড়ি। দলের অর্ধশত নেতা রয়েছেন, যারা একসময় জাসদের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তারা দলে এখন প্রভাবশালী নেতা। জাতীয় পার্টিতেও জাসদের সংখ্যা কম নয়। বর্তমান ও সাবেক তিন মহাসচিবই জাসদের। কার্যত জাপার শীর্ষস্থানীয় নেতারাই জাসদের। তিন দলের অঙ্গসংগঠনেও সরব জাসদ ছাত্রলীগের একসময়ের ডাকসাইটে নেতারা। তবে দলত্যাগী ওইসব নেতা এখন সমালোচনায় মুখর। জাসদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে একসময়ের জাসদ নেতা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে তাহলে জাসদকে ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে রাখতে পারে না। কারণ ১৫ আগস্টের ঘটনার প্রেক্ষাপট জাসদই তৈরি করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য, তারাই আজ ফ্রন্ট লাইনে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ মূলত শত্রুর সঙ্গেই বসবাস করছে। একসময়ের জাসদ নেতা ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মূল্যায়ন হলো, ‘রাজনীতিতে কেউ কারও স্থায়ী শত্রু নয়। এটাই রাজনীতির কৌশল। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও দেশ-জনগণের কথা চিন্তা করে শত্রুর সঙ্গেও বসতে হয়। একসঙ্গে খেতে হয়। পৃথিবীতে এ নিয়মই চলে আসছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাসদ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, তারা জায়গা থেকে ঠিকই করেছেন। তিনি ভিকটিম। তার ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিকই আছে।’ আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক শফি আহমেদ বলেন, ‘আমি নিজে একজন জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হিসেবে মনে করি, অতীতের ভুলভ্রান্তি যাই থাকুক না কেন, এ মুহূর্তে সেসব বিতর্কে না জড়িয়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আমাদের ঐক্যের প্রয়োজন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে, কিন্তু জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী দেশকে পিছিয়ে দিতে চায়। তাই এখন ঐক্য দরকার।’
মন্ত্রী-এমপিসহ ডজন নেতা আওয়ামী লীগে।একসময়ের জাসদ নেতা শাজাহান খান আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সাবেক ডাকসু ভিপি ও প্রাক্তন এমপি আখতারুজ্জামান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ও গাজীপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক।
আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হয়েছেন নেত্রকোনা-৫ আসনে ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক, টাঙ্গাইল-৬ আসনের সাবেক এমপি আবদুল বাতেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে গোলাম রাব্বানী। নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন আশরাফ আলী খান খসরু। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামরুজ্জামান টুকু, মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক কামরুল হুদা সেলিম একসময় জাসদ করতেন। তিনি
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এম এ ওয়ারেস নাঈম। তিনি একসময় জাসদের সক্রিয় নেতা ছিলেন। প্রায় ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। জেলা সহ-সভাপতির পাশাপাশি ঝিনাইগাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। জাসদের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রওশন আরা সাথী এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক শামীম শাহরিয়ার একসময় জাসদের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ডাকসুর সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের নেতা কারারুদ্ধ মাহমুদুর রহমান মান্না একদা আওয়ামী লীগে ছিলেন। এর আগে তিনি জাসদ করতেন। পরে বাসদ হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বগুড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট রেজাউল করীম মন্টু ও অ্যাডভোকেট আবদুল মতিনও জাসদের রাজনীতি করতেন।
বিএনপিতে সক্রিয় অর্ধশত নেতা : দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপিতে এখনো সক্রিয় জাসদের সেই অর্ধশত নেতা। দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ও একসময় জাসদে ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল শাখার নেতা ছিলেন। বিএনপি আমলের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজও জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। অবশ্য তিনি এখন আর বিএনপির রাজনীতিতে নেই। তবে তার স্ত্রী রাবেয়া সিরাজ এখনো বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। তিনিও জাসদের কেন্দ্রীয় নেত্রী ছিলেন।
জানা যায়, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে জাসদের অর্ধশত এমপি নির্বাচিত হন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও এমপি হয়েছেন তারা। অবশ্য এরই মধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন। আবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে কেউ কেউ বর্তমানে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। বিএনপি আমলের স্পিকার মরহুম শেখ রাজ্জাক আলীও একসময় জাসদের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বিএনপির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। জাসদ ছাত্রলীগেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। সিলেট বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন জীবনও জাসদের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। সুনামগঞ্জের জাসদের এমপি কলিমউদ্দিন মিলন এখন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক। একসময় তিনি জাসদ ছাত্রলীগের ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। বরিশালের সাবেক এমপি বিএনপির নির্বাহী কমিরি সদস্য আবুল হোসেন খানও জাসদ করতেন। চাকসুর সাবেক ভিপি জি এম ফজলুল হকও জাসদ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তিনি বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। টাঙ্গাইলের সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবর্তী এবং লুত্ফর রহমান খান আজাদও একসময় জাসদের রাজনীতি করতেন। বর্তমানে তারা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। ফেনী কলেজের ভিপি জয়নাল আবেদীনও জাসদের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। এখন তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলও একসময় জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বিএনপির অনেক নেতাই একসময় জাসদের রাজনীতি করতেন।
জাপার তিন মহাসচিবই জাসদের : সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের একটি বড় অংশ জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদের একসময়ের নেতারা। জাতীয় পার্টির বর্তমান মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ছিলেন জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুই মেয়াদে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তিনি। সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু একসময় জাসদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাসদ থেকে বাসদ। বাসদ থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এ ছাড়াও জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব এ বি এম শাহজাহানও ছিলেন জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত নন। জানা গেছে, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আজম খান, বর্তমান এমপি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের নোমান মিয়া ও বগুড়া-২ আসনের শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুল আলম মাস্টার, আবদুস সাত্তার মিয়া, দলের যুগ্ম মহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভূইয়া, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, দিদারুল আলম দিদার, গোলাম মোহাম্মদ রাজু, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ই আযম জাসদ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও মুন্সীগঞ্জের জামাল হোসেন, নোয়াখালীর ফজলে এলাহী, চট্টগ্রামের মাজহারুল হক জাসদ থেকে জাতীয় পার্টিতে এসে এমপি হয়েছিলেন। বগুড়া সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম জাকারিয়া খানও জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।