এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার
২রা মার্চ নিবীরে নিভৃতে চলে গেলো তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভোটার দিবস। “ভোটার দিবস”টি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা তো দূরের কথা আন্তর্জাতিক ভোটার দিবসের কথা জনগণ জানতেই পারলো না; প্রচার হয় নাই কোন মিডিয়াতে, খবর প্রকাশিত হয় নাই কোন পত্রিকায়। সরকারী দল বা সরকার কর্তৃক ভোটার দিবসটি পালন করার কথা জনগণ শুনছে বলে দৃশ্যমান হয় নাই। সরকার বা সরকারী দল কোন মূখে আন্তর্জাতিক ভোটার দিবস পালন করবে, এ নিয়েও রশালো আলোচনা আছে। সরকার বা সরকারী দল আন্তর্জাতিক ভোটার দিবস কেন উৎযাপন করবে এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ বর্তমান আমলে সরকার গঠন করতে তো ভোটারের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় পুলিশ, প্রশাসন এবং একটি আজ্ঞাবহ চাটুকার নির্বাচন কমিশনের। এ দেশের ভেঙ্গে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দেশবাসী একটি মারমূখী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সংবিধানে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদ্ধতি সংবিধানের অর্ন্তরভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ ইং সনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পরে সংবিধানে সংশোধনী এনে “তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন” পদ্ধতি বাতিল করে দেয়, এর পর থেকেই শুরু হয় নির্বাচনে হরিলুটের ব্যবস্থা, দিনে দিনে নির্বাচনী হটকারীতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলশ্রুতিতে নির্বাচন করতে গেলে এখন আর ভোটারের প্রয়োজন হয় না। সরকারের নির্দেশনায় পুলিশের দেয়া গায়েবী মোকদ্দমা, ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক রিমান্ড মঞ্জুর এবং পুনরায় পুলিশের রিমান্ড বাণিজ্য প্রভৃতি মোকাবেলা করতেই বিরোধী দলের ত্র্যাহী ত্র্যাহী ভাব ছুটে যায়। অধিকন্তু রয়েছে সরকারী দলের সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের উপর অমানুসিক নির্যাতন, যে নির্যাতনের কারণে তারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতিটা এমনই দাড়িয়েছে যে, মাইর (আঘাত) ও মামলা, এ দুটোই যেন বিরোধী দলের পাওনা। কোমড় ভাঙ্গা জাতীয় নির্বাচন কমিশন মূখে মূখে অনেক সুন্দর সুন্দর বানী প্রচার করলেও স্বচ্ছ, সুষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য তাদের কোন পদক্ষেপ নাই। ফলে নির্বাচনে ভোটারের কোন প্রকার গুরুত্ব নাই বলেই আন্তর্জাতিক ভোটার দিবসটি সকলের অগচোরে মর্যাদাহীনভাবে চলে গেলো। নির্বাচনী ব্যবস্থায় যদি এমনিভাবে হরিলুট হতে থাকে তবে ভবিষ্যতেও “আন্তর্জাতিক ভোটার দিবসটি” জনগণের অজান্তেই চলে যাবে, একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তবে এ দিবসটি উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরোধ যে বিতন্ডায় রূপ নিয়েছে তা জনগণের নিকট দিনে দিনে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, “নির্বাচন কমিশনকে হেয় করতে যা যা দরকার সবই করেছেন (সিনিয়র নির্বাচন কমিশনার) মাহবুব তালুকদার”। অন্যদিকে মাহবুব তালুকদার বলেছেন যে, “প্রতিবন্ধকতাহীন নির্বাচন চললে কমিশনের প্রয়োজন হবে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।” নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ ২ জন কর্মকর্তার পরষ্পর বিরোধী বক্তব্যের কোনটি গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনা করবেন জনগণ এবং জনগণের পক্ষে দেশের চলমান রাজনৈতিক দল।
দেশে নামে মাত্র লোক দেখানো একটি “নির্বাচনী” খেলা হয় যা একতরফা খেলামাত্র। কিন্তু এ নির্বাচনে কোন প্রতিবন্ধকতা নাই। চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার ২৮/০২/২০২১ ইং তারিখের নির্বাচনে মেয়র ও ১২ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিবন্ধিকতায় নির্বাচিত হয়েছে। রাউজানে বিরোধী দলীয় কোন প্রার্থীকে দাড়াতেই দেয় নাই। এমনি অবস্থা চলছে গোটা বাংলাদেশে যেখানে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রচার ও ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করতে দেয়া হয় না। এ জন্যই সিনিয়র নির্বাচন কমিশনার আক্ষেপ করে বলেছেন যে, “সারা দেশে যদি চট্টগ্রামের রাউজান মডেলে সবাই বিনা প্রতিদ্ধন্ধিতায় জনপ্রতিনিধি হতে পারেন তা হলে নির্বাচনে অনেক আর্থিক সাশ্রয় হয় এবং সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এতে নির্বাচন কমিশনের দায় দায়িত্ব তেমন থাকবে না। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আর প্রয়োজন হবে কি না, সেটা এক প্রশ্ন” বক্তব্যটি পর্যালোচনার দাবী রাখে। কারণ বাংলাদেশে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য রাষ্ট্রের সহ¯্র কোটি টাকা খরচ হয় যা জনগণের টাকা, এ টাকা প্রতিদ্ধন্ধীতা বিহীন নির্বাচনে জন্য ব্যয় না করে আরও একটি পদ¥া সেতু নির্মাণ করলে জনগণ বেশী উপকৃত হতো। নির্বাচন কমিশনের উপর জনগণের আস্থা না থাকার আর একটি বহিঃপ্রকাশ হলো যে, ভোটাররাও নিরাপত্তার অভাবে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হচ্ছে না।
সরকার এখন রাষ্ট্র শাসন করছে পুলিশ দিয়ে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীই ভোট দেয়ার কাজ সম্পন্ন করে। একথা মানতে হবে যে, শুধু “ভোটের” দিনই “ভোট” হয় না। সুষ্ট, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সারা বৎসরই রাজনৈতিক দলগুলি ভয় ভীতির উর্দ্ধে থেকে প্রচার কার্যসহ সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারে এ জন্য প্রয়োজনীয় ও যুক্তিসংগত পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে এম.পি/মন্ত্রী পুলিশ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজসে এমনি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রেখেছে যাহাতে সরকারী দল বিরোধী সকলেই ভয় এবং আতঙ্কের উপরে থাকে। বিএনপি’র কোন নেতা নিজ এলাকায়ও সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে যায় সেখানেও সরকারী দল আস্ত্র সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা করে। সরকার পুলিশকে জনগণের মুখামূখি দাড় করিয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তায় দাড়িয়ে কোন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ সভা করার প্রস্তুতি নিলে বিনা উষ্কানিতে পুলিশ বেপরোয়া ভাবে লাঠি চার্জ, কাদানী গ্যাস ও গুলি করা শুরু করে। গত দু/এক দিনে বিশেষ করে ০৪/০৩/২০২১ ইং তারিখে পুলিশ জাতীয় প্রেস ক্লাবকে রনক্ষেত্রে পরিনত করেছে। পুলিশের অনুমতিক্রমে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয় নাই বলে বিক্ষোভ সভা তারা পন্ড করে দিয়েছেন বলে পুলিশ মিডিয়াকে বলেছে যা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে লাইভ দেখানো হয়েছে। এতে করে ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা উষ্কানীতে পুলিশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে হামলা চালায়। ছাত্র দল যখন প্রেস ক্লাবের ভিতরে আশ্রয় নেয় তখন পুলিশ প্রেস ক্লাবের ভিতরে চলে যায়। পুলিশেরভাষ্য ছাত্রদের ইট পাটকেল নিক্ষেপে কয়েকজন পুলিশ আহত হয়েছে। অথচ কতজন ছাত্র আহত হয়েছে তা পুলিশ প্রকাশ করে নাই।
দেশে গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা নাই বলে গণমানুষ সরকারের স্টীম রোলারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছে না, কোন গোষ্টি প্রতিবাদ করার পদক্ষেপ নিলে সেখানে শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গ্রেফতার ও রিমান্ড। কারাগার একজন কারাবন্দীর জন্য সবচেয়ে বেশী নিরাপদ স্থান। প্রতিটি কারাগারে মূল গেইটে লেখা রয়েছে যে, “দেখাবো আলোর পথ, রাখিবো নিরাপদ” কারাগারেও কোন প্রতিবাদী মানুষ নিরাপদ নহে। যেমন- সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় লেখক মুশতাক আহম্মদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন রাজপথে সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের জন্য নামলে পুলিশ লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তাদের দাবীছিল অত্যান্ত বস্তু নিষ্ঠ এবং ন্যায্য। ছাত্ররা মোশতাকের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মানতে নারাজ।
পাকিস্তান সরকার বাঙ্গালীদের অধিকার বা তথা ভোটাধিকার হরন করার কারণেই বাঙ্গালীদের অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। জনগণের ভোটাধিকার তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। সেই মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত। রাষ্ট্রীয় এ বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণের রুখে দাড়ানোর সময় বয়ে যাচ্ছে। নতুবা স্বাধীনতার মূল্যবোধ এ দেশের গণমানুষের নিকট হয়ে যাচ্ছে অর্থহীন ও মূল্যহীন।
নির্বাচন কমিশন গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে নাই। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। সরকার সব সময়ই তাদের আজ্ঞাবহ একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের প্রতি অতিমাত্রায় আনুগত্য প্রকাশ করায় নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পূবোপরি ব্যর্থ করে দিয়েছে। ফলে দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রতিবন্ধকতা বিহীন “নির্বাচন” যা বর্তমানে জনতার সামনে একটি সার্কাসে পরিনত হয়। এ সার্কাস জনগণকে বানিয়েছে একটি তামাশার পাত্র। এ থেকে উত্তরনের জন্য চাই সংঘবদ্ধ আন্তরিক প্রচেষ্ঠা।
লেখক
রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)
মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬
E-mail: [email protected]