ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাতকারে মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী
সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট এবং কল্পনাপ্রসূত৷ কতিপয় মস্তিস্ক বিকৃত মিডিয়া কর্মীদের এটা উদ্ভট প্রচারণা৷ আমরা কওমি মাদ্রাসার ওলামায়ে একরাম শান্তিপ্রিয়৷ আমাদের ছাত্রদের আমরা নীতিআদর্শ শেখায়৷ কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা দান করি৷ এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, হেফাজত যদি তার শিক্ষার্থীদের লাঠি দিয়ে মাঠে নামায়, তবুও তাদের গুলি করে হত্যা করা এটা কী অপরাধ নয়? রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে একজন নিরাপরাধ, নিরীহ সাধারণ শিশুদের রক্ষা করে না, তাহলে কী হেফাজত দায়ি না রাষ্ট্র দায়ী? এটা হল রাষ্ট্রের অশুভ চক্রান্তকারীদের একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ৷
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, বিদেশি নাগরিককে খুশি করার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ এর বিচার একদিন হবে৷
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের প্রতি যদি সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকতো তাহলে হেফাজতকে কোনদিন গুলি করে মারত না।
ডয়চে ভেলে: আপনারা সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে মোদির বিরোধিতা করেছেন? আপনারা কী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করছে না? তাহলে কেন বিরোধিতা?
মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী: মোদি একজন সাম্প্রদায়িক উষ্কানিদাতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী হিসেবে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময় থেকে পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন৷ ফলে মোদি এবং তার দল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্মদাতা সেটা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত৷ ফলে মোদির বিরোধিতা মানেই সাম্প্রদায়িকতা নয়৷ মোদির সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ এবং মোদির সাম্প্রদায়িক উষ্কানি যেন বাংলাদেশে কেউ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সেজন্য হেফাজতে ইসলাম প্রথমে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ দ্বিতীয়ত একটি মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকেরা তার আগমনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ আমরা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছি৷ একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের মতামত ব্যক্ত করার অধিকার আছে৷ সংবিধান সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ সুতারাং মোদির বিরোধিতা মানে সাম্প্রদায়িক উষ্কানি নয়৷
ভারতেও তো বিপুল সংখ্যক মুসলমান রয়েছেন৷ এখানে মোদির সফরের বিরোধিতা করে তাদের কি বিপদের মুখে ফেলছেন না?
আপনি একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, মোদি এটা যেন মনে করেন আমার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ৷ আমি সেখানে গিয়ে নাজেহাল হয়েছি৷ প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছি৷ কেন? আমি আমার দেশের মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করার কারণে৷ তার যদি রাজনৈতিক বুদ্ধি থাকে, তার যদি বিবেক থাকে, তিনি যদি মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তিনি যদি মানবাধিকার লংঘনকারী না হন তাহলে অবশ্যই তিনি এখান থেকে শিক্ষা নেবেন৷ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মুসলমানেরা তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে৷ কী কারণে? ভারতে মুসলমানদের উপর নির্যাতন করার কারণে৷ আমরা মনে করি, তিনি এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সেখানে মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করবেন৷
হেফাজত তো অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন৷ কিন্তু এখানে যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের অনেকেই তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত?
হেফাজতে ইসলামের একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে৷ এটা হল হেফাজতে ইসলাম একটি বৃহত্তম অরাজনৈতিক ঐক্যের প্লাটফরম৷ আমাদের স্লোগান হল, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আমাদের নেই৷ কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানো বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোন কর্মসূচিও আমাদের নেই৷ ধর্মীয় ইস্যুতে বা দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায়, মুসলমানদের ইমান আকিদা রক্ষায় আমরা কথা বলব, আন্দোলন করব, মুসলমানদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম করব৷ এখানে সব মতের, সব চিন্তার রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, শিক্ষাবিদ সব জায়গার মানুষ যারা আমাদের নীতি আদর্শকে বিশ্বাস করবে তারা ব্যক্তি হিসেবে এখানে আসবে৷ দলীয় পরিচয়ে আসবে না৷ তাদের পরিচয় হবে ব্যক্তি হিসেবে, ধর্মীয় নেতা হিসেবে৷
আহমদ শফির মৃত্যুর পর দায়িত্বে এসেছেন জুনায়েদ বাবুনগরী৷ তার সঙ্গে তো আহমেদ শফির মতবিরোধ ছিল৷ হেফাজত কী আগের আদর্শ থেকে সরে এসেছে?
ফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শফির যোগ্য উত্তরসুরি, অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছাত্র হলেন জুনায়েদ বাবুনগরী৷ আল্লামা শফির সঙ্গে বাবুনগরীর কোনদিন দ্বন্দ্ব ছিল না৷ একটা পক্ষ দ্বন্দ্ব তৈরি করে, মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দু’জনের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য তৈরি করার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু দু’জনই আমৃত্যু একই প্রতিষ্ঠানে ছিলেন৷ একসঙ্গেই হেফাজতের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ একসঙ্গেই মাদ্রাসার দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এখানে বিভক্তি তৈরি করলে হেফাজতের দুইটি গ্রুপ হয়ে যেত৷ কোনদিন হয়নি, সেটা হওয়ার সুযোগও নেই৷ আহমদ শফির নীতি আদর্শ এবং হেফাজতে ইসলাম যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জুনায়েদ বাবুনগরীর হাতে সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷
আপনারা কী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করেন?
২৬ মার্চ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি৷ দেশপ্রেম হল ইমানের অঙ্গ৷ বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি, এই দেশটাকে ভালোবাসা আমাদের ইমানের অঙ্গ৷ সুতরাং বাংলাদেশের প্রত্যেকটি কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক নিজের দেশকে ভালবাসে, স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে৷ মাতৃভূমির হেফাজত করার জন্য যে কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অশুভ শক্তির মোকাবিলা করার জন্য তারা সবসময় তৈরি থাকে৷
হঠাৎ করেই দেখছি, আপনাদের দাবির সঙ্গে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি মিলে যাচ্ছে৷ এখন কী তাহলে আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় ডান-বাম মিলে গেছে?
এখন একটা বিষয় হচ্ছে যে, মোদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিকারী একজন ঘৃণিত ব্যক্তি৷ তাকে প্রতিহত করার জন্য হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছে৷ হেফাজতের এই দাবির সঙ্গে যে কোন নাগরিকের, যে কোন সংগঠনের দাবির মিল থাকতে পারে৷ তার অর্থ এই নয় যে, আমরা ডান বাম মিলে একাকার হয়ে গেছি৷ আমাদের নীতি আদর্শের প্রতি যদি কেউ একমত হয়ে সমর্থন দেয় আমরা তাদের ওয়েলকাম জানাব৷ দেশের স্বার্থে, ধর্মের স্বার্থে এবং দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে৷
আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, আপনারা কওমি মাদ্রাসাগুলোকে রাজনৈতিকরণ করছেন৷ শিশু-কিশোরদের লাঠি হাতে রাজপথে নামিয়ে দিচ্ছেন?
এই বিষয়টা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট এবং কল্পনাপ্রসূত৷ কতিপয় মস্তিস্ক বিকৃত মিডিয়া কর্মীদের এটা উদ্ভট প্রচারণা৷ আমরা কওমি মাদ্রাসার ওলামায়ে একরাম শান্তিপ্রিয়৷ আমাদের ছাত্রদের আমরা নীতিআদর্শ শেখায়৷ কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা দান করি৷ এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন, হেফাজত যদি তার শিক্ষার্থীদের লাঠি দিয়ে মাঠে নামায়, তবুও তাদের গুলি করে হত্যা করা এটা কী অপরাধ নয়? রাষ্ট্রযন্ত্র যেখানে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে একজন নিরাপরাধ, নিরীহ সাধারণ শিশুদের রক্ষা করে না, তাহলে কী হেফাজত দায়ি না রাষ্ট্র দায়ী? এটা হল রাষ্ট্রের অশুভ চক্রান্তকারীদের একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ৷
এই শিশু-কিশোরদের ভুল বুঝিয়ে তাদের ভবিষ্যত কী নষ্ট করা হচ্ছে না?
আপনি দেখেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজকে ৫০ বছর৷ এই ৫০ বছরে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকেরা যেরকম শান্তিপ্রিয়, যেরকম আদর্শবান, যেরকম নীতিবান এবং দেশপ্রেমিক তারা সেরকম কী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়েছে? বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যতগুলো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার কোনোটির সঙ্গে কি কওমি মাদ্রাসার কোন ছাত্র-শিক্ষকের জড়িত থাকার কোন প্রমান আছে? উগ্রপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীলদের আপনারা অভিযুক্ত করেন না, আমরা একটা দুইটা প্রোগ্রামে লাঠিসোটা নিয়ে মাঠে নামলেই আমাদের অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেন৷ এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব৷ বাস্তবতার সঙ্গে এটার কোন মিল নেই৷
এত লাশের বিনিময়ে মোদির সফরের যে বিরোধিতা আপনারা করলেন, তাতে কী পেলেন? যে পরিবার স্বজনকে হারালো, তাদের আপনারা কী জবাব দেবেন?
প্রথম কথা হচ্ছে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি৷ আমরা তো এখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাইনি৷ অস্ত্র নিয়ে যারা অস্ত্রবাজি করে, গুলি করে আমাদের ভাইদের হত্যা করেছে তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হতে হবে৷ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মোদিকে এনে একজন বিদেশি নাগরিককে খুশি করার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের যারা পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিচার বাংলার মাটিতে একদিন হবে৷