৬২ শতাংশ মানুষ কর্মহীন : আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে দেশকে দূর্নীতি মূক্ত করুন — বিশিষ্টজনদের অভিমত

আপডেট: মে ২৫, ২০২১
0

দেশকে দূর্নীতিমুস্ক রাখতে আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে শতকরা ৬২ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, শতকরা ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে ও শতকরা ৭৮ শতাংশ মানুষ জীবন নির্বাহের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন, (সিপিডি, অক্সফাম ২০২১)। উল্লিখিত প্রেক্ষপটে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বাস্থ্য কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কোন বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র যৌথ উদ্যোগে আজ ২৫ মে, ২০২১ তারিখ মঙ্গলবার সকাল ১১.০০ টায় “জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেট ২০২১-২২: বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা”-শীর্ষক অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় দেশের বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি, অধ্যাপক ডা. রশিদ -ই-মাহবুব এর সভাপতিত্বে এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সাধারণ সম্পাদক, শরীফ জামিল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান।

মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সদস্য সচিব, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. নিতাই কান্তি দাশ।

সভায় সম্মানিত আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ও রোগ নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর (আইইডিসিআর)-এর সাবেক পরিচালক ও বাপা’র পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক, ডাঃ এ. এম. জাকির হোসেন; ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক এম. এম. আকাশ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহামারী সম্পর্কিত উপদেষ্টা ডাঃ মোস্তাক হোসেন; বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক, পারভীন ইসলাম; দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক, ডাঃ দিবালোক সিংহ প্রমূখ।

উপস্থাপনা ও আলোচকদের আলোচনার প্রেক্ষিতে সংক্ষিত বক্তব্য প্রদান করেন, বাপার সভাপতি; সুলতানা কামাল।

মূল বক্তব্যে ড. নিতাই কান্তি দাশ বলেন, আকস্মিক স্বাস্থ্য দূর্যোগের ফলে বিশ্বের অনেক দেশের মত আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেংগে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জীবনঘাতী এই ভাইরাসের কোন চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। এই ভয়াভহ ভাইরাস বিভিন্ন রূপ ধারণ করে দ্বিতীয়বার আঘাত হেনেছে যা মোকাবেলার জন্য প্রতিরোধই হচ্ছে এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায়।এর জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অতি জরুরী। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,গণপরিবহন ,অফিস বন্ধ রাখা, লকডাউন,কারফিউ ইত্যাদি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ফলে অসংখ্য মানুষের জীবনে নেমে এসেছে নিদারূন কষ্ট ও ভয়াবহ বিপর্যয়। অধিকাংশ মানুষের বেঁচে থাকাই কঠিন ব্যাপার। এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৬২ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, শতকরা ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে ও শতকরা ৭৮ শতাংশ মানুষ জীবন নির্বাহের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন, (সিপিডি, অক্সফাম ২০২১)। উল্লিখিত প্রেক্ষপটে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বাস্থ্য কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কোন বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা।

আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জিডিপির ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে জিডিপির ০.৫ শতাংশ বাজেটে রাখা হয় যার শতকরা ৮০ ভাগই খরচ করা যায় না। (তথ্য সূত্র:ড.বিনায়ক সেন, ১৭ মে,২০২১ প্রথম আলো ) বর্তমান বাস্তবতা দাবী করে, একটি যুদ্ধকালীন পুর্নগঠনমূলক স্বাস্থ্য বাজেটের। এবারের সমগ্র বাজেটটি হবে ঝুঁকি মোকাবেলা তথা স্বাস্থ্য উন্নয়নের বাজেট। তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নতুনভাবে স্বাস্থ্য সেবা কাঠামোতে পুনর্গঠণ করা আবশ্যক।

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দূর্নীতি বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। তিনি দূর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তির দাবী করেন। তিনি জনকল্যাণমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গঠনের দাবী করেন। তিনি আরো বলেন ডিজিটাল যুগে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনও এনালগ রয়েগেছে, এ অবস্থার পরিবর্তন বলে তিনি মনে করেন।

ড. আতিউর রহমান বলেন, জিডিপি হিসেবে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দে দক্ষিণ এশিয়ার নিম্মে অবস্থান করছে। তিনি স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। একই সাথে তিনি উন্নয়ন বাজেট বৃদ্ধি করা এবং তার সুষ্ঠ বাস্তবায়নের দাবী করেন। যে সমস্ত এলাকায় বায়ুদূষণ বেশী সে সমস্ত এলাকাতে কোভিড -এর সংক্রমণ বেশী বলে তিনি মন্তব্য করে বলেন প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারলে কোভিড মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য বাজেট বৃদ্ধিও প্রস্তাব করেন। তিনি বিনামূল্যে দেশের সব জনগনের মাঝে মাস্ক সরবরাহ এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানান।

সুলতানা কামাল বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দূর্নীতি বন্ধ করতে হবে, সেই সাথে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জনমূখী পূর্নগঠনের আহ্বান করেন তিনি। পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন তিনি।

ডাঃ এ. এম. জাকির হোসেন স্বাস্থ্য খাতে অসংক্রমক রোগের কথা উল্লেখ করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন সরকার জনগনকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে সন্তষ্ট করতে ব্যার্থ কারন এ খাতে বাজেট কম আর দূর্নীতি বেশী। তিনি টিকা তৈরীর জন্য আলাদা জনবল ও অবকাঠামোর দাবী করেন।

ডাঃ মোস্তাক হোসেন, জনস্বাস্থ্য কাঠামোতে বাজেট বৃদ্ধিসহ গ্রামাঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। তিনি সরকারের প্রতি কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউয়ের শতর্কবার্তা দিয়ে তা মোকাবেলায় জনসাধারণকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য প্রচার প্রচারণা, প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহন ও তা নিশ্চিতের আহ্বান জানান ।

অধ্যাপক এম. এম. আকাশ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধিসহ প্রতিনিয়তই সরকারের মনিটনিং করতে হবে। কোন মন্ত্রণালয় যদি বাজেটের টাকা খরচ না করে তবে সেই টাকা ফেলে না রেখে দেশের সংকট/আপতকালীন খাতে ব্যয় করতে কবে। দেশের আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ, দেশকে দূর্নীতি মূক্ত এবং একই সাথে তিনি রাজনীতিকে ব্যবসায়ীক মুক্তকরণের দাবী জহানান।

পারভীন ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি করে বয়স্ক, নারী, স্বাস্থ্য সেবা খাতে জড়িত ডাক্তার, সেবাকর্মী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিস্কার কর্মীদের জন্য আলাদা বাজেট করার প্রস্তাব করেন।

ডাঃ দিবালোক সিংহ বলেন, দেশের কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোকে সংস্কার করে এগুলোকে কোভিড পরিক্ষা ও চিকিৎসার উপযোগী করে তোলার প্রস্তাব করেন, তা হলে সংক্রমন অনেক কেম আসবে তার কারন হিসেবে তিনি বলেন স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা প্রদান করা হলে সেই রোগীগুলো বিভিন্ন শহওে চিকিৎসা নিতে ছুটাছুটি করবে না।

আজকের সভা থেকে আমাদের দবী/ প্রস্তাবঃ
১. গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কার্যকর ভাবে চালু করা। এই সেবাকেন্দ্র গুলোকে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য এর উপর গুরুত্ব দিয়ে পলি ক্লিনিক আকারে গড়ে তোলা । এই কেন্দ্র গুলোর উদ্যোগে তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা ।
২ .এই কেন্দ্র গুলোতে সপ্তাহে ৩ দিন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক এর ব্যবস্থা করা।

৩.শহরাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক তথা পলি ক্লিনিক চালু করা।

৪. ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সেবা কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও সেবাদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা।

৫. জেলা পর্যায়ে হাসপাতাল গুলোকে রেফারেল ও বিশেষায়িত সেবাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা ।

৬ . জেলা থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য (পাবলিক হেলথ) কাঠামো গড়ে তোলা ।

৭ .পরিবেশগত স্বাস্থ্য উন্নয়নের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা, নিরাপদ বায়ু, নিলাপদ খাদ্য,পুষ্টি,সুপেয় পানি,স্যানিটেশন ইত্যাদিকে সর্বজনীন রূপদান করা ।

৮ .স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি ১০ শতাংশ বরাদ্দকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। এই বরাদ্দ এর অংশবিশেষ জনস্বাস্থ্য,গবেষণা ,প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দুর্নীতিমুক্ত,স্বচ্ছভাবে অর্থ খরচ করার সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য ব্যয় করা

৯ ..জাতীয় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল মনিটরিং সহ ব্যাপক মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা। যার লক্ষ্য হবে দুর্র্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক একটি মানবিক স্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা।

১০ ..স্বাস্থ্য কাঠামোর বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় সরকার,জনসংগঠন ও সিভিল সোসাইটিকে সম্পৃক্ত করা।

১১ .করোনা মোকাবেলায় দেশীয় ভাবে জরুরী ভিত্তিতে টিকা উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।

১২ .করোনা আক্রান্ত মধ্যবিত্ত, নিম্মবিত্ত, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য যথাযথ চিকিৎসা ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা।

১৩ .কর্মহীন, অতিদরিদ্র ও ভাসমান মানুষের জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্যে সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা ,স্বাস্থ্যবিমা চালু করার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। এ প্রেক্ষিতে প্রগতিশীল ্রকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, করপোরেট কর বাড়ানো, সম্পদ কর চালু করা ।