বর্তমানে যেভাবে ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তা পাকিস্তান আমলেও ছিলো না

আপডেট: জুন ৪, ২০২১
0


এ্যাডঃ তৈমূর আলম খন্দকার

জীবনের নিরাপত্তা ও জীবিকার স্বচ্ছতা প্রভৃতি মিলিয়ে মানুষকে একটি শৃঙ্খলায় আনার জন্যই একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন, যার দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান করা। জীবন জীবিকার সার্বিক নিরাপত্তা বলতে একজন নাগরিকের সম্মান নিয়ে বাচার নিরাপত্তাসহ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকা, মত প্রকাশ সহ চিন্তা, চেতনা, সংগঠন করার, রাজপথে শোভাযাত্রা করাসহ যে কোন প্রকার ভয়-ভীতির উর্দ্ধে থেকে জীবন ধারনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার জন্যই রাষ্ট্রের প্রয়োজন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সমূহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা নাই।

“কাজীর গরু কিতাবে থাকার মত যা প্রকৃতপক্ষে গোয়ালে নাই।” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৭ এ বলা হয়েছে যে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।” বাস্তবতা কি তাই? বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অধীনে সকল নাগরিক কি আইনের দৃষ্টিতে সমান সূযোগ সুবিধা পাচ্ছে? রাষ্ট্র কি সংবিধানের মর্ম মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে? সরকারের ভিন্নমতের মানুষ কি ভয়-ভীতির উর্দ্ধে থেকে তাদের মত প্রকাশ করতে পারছে? বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূফল কি সকলের জন্য সমান দৃষ্টিতে ভোগ করার সূযোগ সরকার দিচ্ছে? এ সকল প্রশ্ন এখন সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের বিবেকের তাড়না দিচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য কি শুধুমাত্র একটি শ্রেণীর জন্য প্রাপ্য। মূখভরা বুলি নিয়ে প্রচার হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মানুষের মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধারনাটি কি সকলের জন্য প্রযোজ্য? পার ক্যাপিটাল ইনকাম বৃদ্ধির আওতায় কি সাধারণ গণমানুষের অংশীদারীত্ব রয়েছে? প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশে এক শ্রেণীর মানুষ যারা সরকারী ঘরনার মধ্যে রয়েছে তারাই একতরফাভাবে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। সাধারণ মানুষ হারিয়েছে সাংবিধানিক অধিকার। সরকারী অফিস আদালতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কোন স্থান নাই বরং সাংবিধানিক অধিকার বাস্তবায়নের উদ্দ্যোগ নিলে শুরু হয় নানাবিধ বিভ্রান্তি, বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহী, দেয়া হয় পাকিস্তানী রাজাকার বা দালাল উপাধি।

পাকিস্তান আমলেও নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যে ভাবে নাগরিকদের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে, সে অবস্থা স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার আমলেও ছিল না। সরকার যাহাতে জনগণের অধিকার হরন করতে না পারে তার জন্য সংবিধানে কিছু রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে “স্বাধীন” করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু হালে সেই কথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিও সরকারী দলের একটি অংঙ্গ সংগঠনে পরিনত হয়েছে। ফলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি কাগজে কলমে “স্বধীন” হলেও বিবেকের দিক থেকে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। ফলে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার শপথ নিয়ে তারাও মানসিক দাসত্ব করে রাষ্ট্রীয় বেতন, ভাতা, গাড়ী, বাড়ী ভোগসহ সর্বোপরি ক্ষমতা প্রয়োগ করছে যাতে আপামর জনগণের অধিকার রক্ষার কোন প্রতিশ্রুতি নাই।

ভিন্নমতের নাগরিকরা যদি ক্ষমতাসীনদের দাপটে টটস্থ থাকতে হয় তবে সেখানে স্বাধীনতার চেতনা বা গণতন্ত্রের “গ” পর্যন্ত থাকে না। সংবিধানের “প্রস্তাবনা”র তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে”। কিন্তু সংবিধানের উক্ত প্রস্তাবনার সফল বাস্তবায়ন কোথায়? প্রস্তাবনায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন। ভিন্ন মতের নাগরিকগণ কি আইনের শাসনে সুবিধা ভোগ করতে পারছেন? আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলি কি সকল নাগরিকদের আইনের দৃষ্টিতে সমান চোখে দেখেন? ক্ষমতাসীনরা ভিন্নমতাবল্মীদের উপর নির্যাতন করে, মাইর দিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পুরে রাখে সে অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা কি ন্যায় বিচার পায়? সরকারী কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীনদের সাথে যে মোলায়েম সূরে কথা বলে অনুরূপ ব্যবহার কি বিরোধী দলের সাথে করেন? আমলারা বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে তুচ্ছ তাছিল্যোর সাথে ব্যবহার করে। মোট কথা বেতন খায় ১৮ কোটি আপামর জনগণের উর্পাজিত অর্থ থেকে, অথচ পারপাস সার্ভ করে ক্ষমতাসীনদের। কারণ ক্ষমতাসীনদের হাতে রাখতে পারলে টু পাইস ইনকামে নিরাপত্তা থাকে, দুদকও তখন কাছে আসে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কতজন দুদকের আওতায় এসেছেন। তবে তারা কি সবাই দুধের ধোয়া তুলশী পাতা। সরকারী সকল দপ্তরেই ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। এমন কি ট্রান্সফার ও প্রমোশনেও ঘুষ দিতে হয়, যা এখন ওপেন সিক্রেট। এন.বি.আর বলে যে, ট্যাক্স আদায়ের টার্গেট পূরণ হয় না। ব্যবসায়ী ও জনগণ ট্যাক্স দিতে চায়, কিন্তু ট্যাক্স অফিসের কর্মচারী ও অফিসারদের হয়রানীর কারণে সাধারণ মানুষ কর প্রদানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। ট্যাক্স অফিসে মোটা অংকের টাকা ঘুষ না দিলে কর্মকর্তারা করদাতার উপরে মোটা অংকের কর বসিয়ে দেয়। ফলে করদাতা জনগণ কর প্রদানের বিষয়ে নিরুৎসাহীত হচ্ছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের স্বভাব জাত ধর্ম হচ্ছে “ক্ষমতার” পূজা করা, বিবেকের নয়। অর্থাৎ কোন বিষয় এখন আর মানুষ বিবেক দিয়ে বিচার করতে চায় না, বরং কোন কথা বললে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি খুশী হবে সেভাবেই নি¤œপদস্থরা প্রতিবেদন প্রদান করে। সত্যকে প্রকাশ করা নহে, বরং কর্তাকে খুশী রাখাটাই যেন এখন প্রশাসনিক সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ক্ষমতায় থাকে তার কোন সমালোচনা নাই, বরং কার চেয়ে কে বেশী কর্তা ব্যক্তির প্রশংসা করতে পারে সে প্রতিযোগীতাই এখন চলছে। সরকারী বা রাজনৈতিক সভাগুলিও কর্তা ব্যক্তির মনমর্জির উপর সকল দায়িত্ব অর্পন করে সভা সমাপ্ত করে। বিবেক থেকে এমন কোন প্রস্তাব বা আলোচনার সূত্রপাত করে না যাহাতে সভা প্রধান মাইন্ড করতে পারে, সমস্যার সমাধানে কোন তর্ক বির্তক নহে বরং প্রধান কর্তাব্যক্তি প্রশংসা করা ও শোনার উদ্দেশ্যেই যেন মিটিং ডাকা হয়।

সাদাকে সাদা বলার বা কালোকে কালো বলার মানসিকতা যখন মানুষ হারিয়ে ফেলে তখনই শুরু হয় সামাজিক বির্পজয়। অন্যদিকে মানসিক রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সন্তানকে খুন করে নিজে আতœহত্যার ঘটনাও সমাজে আরো বিপর্যয় ডেকে আনছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, বস্তিবাসীদের সাথে পাল্লাদিয়ে ধনীর দুলাল, দুলালীরা মাদকে আসক্তি হয়ে পড়েছে। সরকার কোন ভাবেই মাদককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একটি অংশ মাদক ব্যবসার কারণে কারাবন্দী রয়েছে। টেকনাফের ওসি প্রদীপ এবং চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ যদি হয় সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উচ্চ পদস্থদের নমুনা, সেখানে মাদকের প্রসার বন্ধ হবে কি ভাবে?

রাষ্ট্র একটি শক্তি এবং সকল শক্তির উৎসই হলো রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রের কোন চালিকা শক্তি নাই, রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা করে তারাই রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি। সংবিধান মোতাবেক বাংলাদেশের জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। সংবিধানের ৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, “(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমজস্য হয়, তাহা হইলে সে আইনের যতখানি অসামজস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।”

সংবিধানে প্রদত্ব নির্দেশনা স্পষ্টই প্রকাশ পেয়েছে যে, রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা করেন তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কিন্তু বর্তমানে যিনি লংকায় যাচ্ছেন তিনিই রাবনের ভূমিকা পালন করছে। ফলে সুবিধায় রয়েছে ক্ষমতাসীনরা এবং ভোগান্তিতে রয়েছে ভিন্নমতাবলম্বীরা যারা ক্ষমতাসীনদের জি হুজুর জাহাপনা বলে চলতে পারে না। সমাজে ও রাষ্ট্রে তারাই সবচেয়ে বেশী বিপদগ্রস্থ যারা বিবেক থেকে কথা বলে, চামচামিতে মনোনিবেশ করে না। আর যারা বিত্তশালী তারাও সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন অর্থের বিনিময়ে। কারণ যারা ক্ষমতায় আসীন হয় তারাই বিত্তশালীদের পকেটস্থ হয়ে পড়ে।

লেখক

রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও আইনজীবি (এ্যাপিলেট ডিভিশন)

মোবাঃ ০১৭১১-৫৬১৪৫৬

ঊ-সধরষ: ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশ