এমরানা আহমেদ
আজ শুক্রবার পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হবে নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩১। বাঙালি ভাষাভাষি মানুষের কাছে কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো বাংলা নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসবও বটে। বেশ অনেক বছর ধরেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির সর্বজনীন প্রথা ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
পহেলা বৈশাখের দিন পান্তা ও ইলিশ কিংবা হরেক রকমের ভর্তা, সাদা বা লাল শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবির সাজ, রঙ-বেরঙের পোস্টার, ফেস্টুন ও মুখোশ, মাটির কাঠ-বেতের খেলনা, গৃহস্থালী সামগ্রী, নাগরদোলা এই শব্দগুলো আমাদের বাঙালিদের কাছের খুবই পরিচিত। যেন এই অনুষঙ্গগুলো বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে আবহমান কাল ধরে মিশে আছে। সূর্য পরিক্রমণের একটি চক্র পূর্ণ করে পৃথিবীর আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই আবর্তনের ধারা অব্যাহত আছে বলেই পৃথিবীর চিরপুরাতন হয়েও আমাদের কাছে চিরনতুন। আজ বাঙালির সেই চিরনতুনের শুভাযাত্রাকে স্বাগত জানাবার দিন। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে বিদায়ী সূর্যেও কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি।
আমাদের মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের নানা বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয় আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। রাজধানী এবং সারাদেশ জুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩১’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
উল্লেখ্য, এ বছর পয়লা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা এবং ব্যাগ বহন করা যাবে না। তবে চারুকলা অনুষদ কর্তৃক প্রস্তুুকৃত মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।
ছায়ানট ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। এবারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ধর নির্ভয় গান’। ছায়ানট বরাবরের মতোই সূর্যোদয়ের সময় ভোর ৬ টা ১৫ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হবে সারেঙ্গিতে ভোরের রাগ আহীর ভৈরবের সঙ্গে তবলা লহর দিয়ে। প্রায় আট মিনিটের এই পরিবেশনার পর শুরু হবে গানের পালা। এবার সম্মেলক গান থাকবে ১০টি। এর মধ্য ৪টি গানে গলা মেলাবে খুদে শিল্পীরা। বড়রা ৪টিতে এবং ২টি গান গাইবেন সবাই মিলে। এর ফাঁকে ফাঁকে বিশিষ্ট শিল্পীদের একক কণ্ঠে থাকবে ১১ টি গান, আর ২টি আবৃত্তি। এবার কোনো পাঠপর্ব থাকবে না। এবারের গানগুলো সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম, আত্মবোধন আর জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করবে।
ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করবে। বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান আবশ্যিকভাবে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হবে। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে এদিন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। বাংলা নববর্ষে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার ও ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। অতীতে বাংলা নববর্ষেও মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এসময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। ###
