পরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি নগর সংস্থাসমূহের সুশাসন ঢাকা’কে বাসযোগ্য করবেঃ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি.)

আপডেট: জুলাই ৫, ২০২১
0

ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে জলাবদ্ধতা সহ নানাবিধ সমস্যা সমাধানে নগর পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, নগর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ওয়ার্ড পর্যায়ে সেবার সম্প্রসারণের পাশাপাশি জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর মাধ্যমে ওয়ার্ড কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা, ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন, জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বিবেচনায় নিয়ে আবাসন, অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাদি পরিকল্পনা করা, নাগরিকদের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর সাথে নগর সংস্থাগূলোর নজরদারির সক্ষমতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা একান্ত দরকার।

অদ্য ৫ জুলাই সোমবার কর্তৃক আয়োজিত “সমসাময়িক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনলাইন মাধ্যমে আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স । উক্ত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা, মগবাজার বিস্ফোরণ, নগরের জলাবদ্ধাতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সমসাময়িক প্রসঙ্গে আলোচকবৃন্দ উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর পক্ষে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বি.আই.পি.-র সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর ২০২১ সালের বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকার অবস্থান আপেক্ষিকভাবে ১ ধাপ এগোলেও (গতবারের ১৩৮ এর তুলনায় এবারের স্থান ১৩৭তম) সার্বিক মানের বিচারে ঢাকার বাসযোগ্যতা কমেছে। ২০১৯ সালে আমাদের বাসযোগ্যতা সূচক মান ৩৯.২ থাকলেও এবারের মান ৩৩.৫ যা স্পষ্টভাবে ইংগিত দেয় আমাদের বাসযোগ্যতার অবনতির কথা। এবারের বাসযোগ্যতা সূচকে কোভিড মোকাবেলায় নগরগুলোর স্বাস্থ্যসেবা ও সংশ্লিষ্ট সক্ষমতা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে; ফলে গতবারের তুলনায় অনেক শহরেরে বাসযোগ্যতার উল্লেক্ষযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। ই আই ইউ বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা শহরের ২০১৯ সালের সূচকের তুলনায় পাঁচটি উপ-সূচক মানের মধ্যে ২০২১ সালে স্থিতিশীলতা ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে মান অপরিবর্তিত রয়েছে যাদের সূচক মান যথাক্রমে ৫৫ ও ২৬.৮।

অপরদিকে অন্য তিনটি সূচকের ক্ষেত্রে মান কমেছে যেমন স্বাস্থ্যে মান ১৬.৭ (পূর্বে ২৯.২);সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০.৮ (পূর্বে ৪০.৫) এবং শিক্ষা’য় ৩৩.৩ (পূর্বে ৪১.৫)।ফলে এটা স্পষ্ট যে, ঢাকার অবস্থানের ১ ধাপের পরিবর্তন হলেও প্রকৃত অর্থে ঢাকার সূচক মানের অবনতি তথা বাসযোগ্যতার অবনতি ঘটেছে। পাশাপাশি নগরের বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে সাম্য ও সাশ্রয়ি নাগরিক পরিসেবা ও অবকাঠামোর নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিন্যাস বাসযোগ্যতা নির্ধারণ করে – এই বিবেচনায় ঢাকার নাগরিক সুবিধাদির এলাকাভিত্তিক বৈষম্য প্রকট। একইসাথে নগরের সকলের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন বাসযোগ্য নগরের অন্যতম মানদন্ড, যা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর সূচকে তেমনভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়না; ঢাকা এই বিবেচনায় ও পিছিয়ে প্রবলভাবে। অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দূর্বল গণ পরিবহনব্যবস্থা, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মশার উপদ্রব, ভয়াবহ যানজট, পয়োনিষ্কাশনের করুণ অবস্থা, জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের করুণ দশা, ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি প্রভৃতি সমস্যায় ঢাকা নগরী বিপর্যস্ত।

শহরের বাসযোগ্যতা সংক্রান্ত অন্যান্য আন্তর্জাতিক সূচক যথা নামবিও (শহর এর বাসযোগ্যতা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা সংস্থা) ও ইউএন-হ্যাবিটেট এর গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্ট অনুযায়ী বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে ঢাকা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এই বাস্তবতাকে অনুধাবন করে নগর সংস্থা ও নীতিনির্ধারকদের ঢাকাকে বাসযোগ্য করবার জন্য স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।

বাসযোগ্যতার দিক থেকে ঢাকা তলানির দিকে অবস্থান করবার মূল কারণ ঢাকার অধিকাংশ এলাকাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠবার কারণে নগর পরিকল্পনার মানদন্ড অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সড়ক অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধাদি, খেলার মাঠ, উদ্যান, সবুজ এলাকা ও জলাশয়-জলাধার এর পরিমাণ খুবই কম। পাশাপাশি নগর এলাকা যেভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে, সেসব বর্ধিত নগর এলাকাগুলোতে পরিকল্পনার উদ্যোগ সীমিত। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাসহ অন্যান্য যেসব পরিকল্পনা আছে, সেগুলো বাস্তবায়নের হার ও খুবই সীমিত। নগর সংস্থাগুলোর নজরদারির সক্ষমতা দূর্বলতার কারণে ও সুশাসনের অভাব থাকায় পরিবেশ-প্রতিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়াতে নগরের বাসযোগ্যতা কমছে মারাত্মকভাবে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স যে সকল পরামর্শ দেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সিটি কর্পোরশনের উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে ওয়ার্ড উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সুবি্ধাদি তৈরী, খেলার মাঠ-পার্ক-জলাশয় তৈরী ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া এবং স্থানীয় জনমানুষকে সম্পৃক্ত করবার মাধ্যমে পরিবেশ-প্রতিবেশ দূষণ ও দখলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। পাশাপাশি ভূমি পূনঃউন্নয়ন, ল্যান্ড রিএডজাস্টমেন্ট বা ভূমি পূনঃসমন্বয় ভূমি ব্যাংক তৈরী- প্রভৃতি কৌশল ব্যবহার করে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সম্প্রসারিত নগর এলাকা তথা ঢাকার নতুন ওয়ার্ডসমূহের জন্য সিটি কর্পোরেশনসমূহ পরিকল্পনার উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সর্বোপরি, ঢাকার জনসংখ্যা সুনির্দিষ্ট করবার মাধ্যমে তদনুযায়ী অবকাঠামো, সুবিধাদি ও পরিকল্পনা করবার মাধ্যমেই ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব।

সংবাদ সম্মেলনে বি.আই.পি.-র সহ সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আরিফুল ইসলাম ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা, মগবাজার বিস্ফোরণ, নগরের জলাবদ্ধাতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন স্থাপনা বা ভবণ নির্মাণে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধানে ১০ তলার উপরের ভবন গুলায় ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেওয়া হলেও ১০ তলার নিচের ভবন বা স্থাপনায় এই অনুমোদন নেওয়া হয়না। এছাড়াও ইউটিলিটি সার্ভিস সংযোগ করার জন্য কোন স্বীকৃত কারিগরি সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ না থাকায় বসবাসের ঝূঁকি তৈরি হচ্ছে এবং কোন ধরনের দায়বদ্ধতা থাকছে না। একই সাথে ভবনের অকুপেন্সী সার্টিফিকেইট প্রদান এবং দেখভালের অন্য কর্তৃপক্ষ ও নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যুগ্ন সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ রাসেল কবীর ঢাকার বাসযোগ্যতা নিয়ে বলেন আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে কিন্তু সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতিও রয়েছে। পরিকল্পনার মানদণ্ড বিবেচনায় রেখে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা সকল নাগরিকের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। সিটি মেয়রের কার্যাবলি বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পর্যন্ত আনতে হবে তাহলে সকল নাগরিক সুবিধা প্রদান সম্ভব হবে। এছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অবকাঠামোগত পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে পরছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বি.আই.পি.-র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন ঢাকা শহরে প্রচুর সমস্যা রয়েছে যেগুলোকে উপেক্ষা করে সামনে আগানো সম্ভব নয়। তাই সমস্যা গুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। একই সাথে কোভিড পরিস্থিতিতে বাসযোগ্যতার নির্ধারণে যে ৫টি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়েছে সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নে কোন পরিবর্তন না আসলেও শিক্ষাখাতে স্থবিরতা, স্বাস্থ্যখাতের প্রচুর ঘাটতি ও পরিবেশের ক্রমাগত অবনতি ঢাকা শহর কে অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। একইসাথে বিভিন্ন সময়ে ঘটা দূর্ঘটনা নিয়ে তদন্ত করা হলেও পরবর্তীতে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ফায়ার সার্ভিস সার্টিফিকেইট সহ সকল নিরাপত্তা সার্টিফিকেইট নবায়ণের সুযোগ রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড এর সকল স্টান্ডার্ড নিয়মিত তদারকি এবং জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য নিরাপত্তা বিষয় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে না রেখে ওয়ার্ড ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করতে হবে বলে মনে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়াও জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে স্থানীক পর্যায়ে চিহ্নিত সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। মেগা প্রকল্পের ফলে অনেক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মেগা প্রকল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তার দায়ভার সম্পর্কে বাধ্য করতে হবে এবং বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনদূর্ভোগ কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।