প্রয়াত আব্দুর রহিমের খাঁটি দেশপ্রেম ও মহত্ত্ব প্রজন্মের জন্য শিক্ষনীয়

আপডেট: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১
0

সোহেল সানি:

এম আব্দুর রহিমের খাঁটি দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মহত্ত্ব একই প্রস্রবণ হতে উৎসারিত। তাঁর মানবীয় গুণাবলীর ফল্গুধারা একই স্রোতস্বিনীর শাশ্বত স্রোতধারায় প্রবাহিত। একই মহামানবের সাগরে যা লীন হয়েছে, যে মহামানব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তাঁর মোহনীয় ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে গণমানুষের হৃদয় জয় করেছেন। জয় করেছেন তাঁর প্রিয় দিনাজপুরবাসীর মন।
এম আব্দুর রহিম জননেতা, সুদক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর দীর্ঘসময়ের রাজনৈতিক কর্মে প্রমাণ মিলেছে, কর্তব্য সগম্পাদনের হিমাদ্রি সদৃশ্য এক অটল প্রতিজ্ঞা এবং দৃঢ়তা ছিল তাঁর দৃষ্টিতে। বিক্ষোভ, ভ্রূকুটি, বিরোধিতা, আন্দোলন ও অস্থিরতা তাঁকে কর্তব্যকর্ম থেকে কখনও টলাতে পারেনি। স্বীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্য থেকে পারেনি লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে। বিরাট কর্ম সম্পাদনের জন্যেই বুঝি স্রষ্টা তাঁকে রাজনীতিতে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। একজন সৎ, নিরহংকারী আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসাবে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় নেতৃত্বের আসন থেকে দেশের বিশেষ করে দিনাজপুরের মানুষকে যুগিয়েছেন সাহস অনুপ্রেরণা আর উদ্দীপনা।
জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কারাবরণ করতে হয়েছে বারবার। তিনি আদর্শ ও নীতিবোধকে অটুট ও সমুজ্জ্বল রেখে রাজনীতিকে মানুষের সেবা ও কল্যাণের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মহাপ্রলয়ে পাহাড় ভেঙে পড়লেও তাঁর ব্যক্তিসত্তা জুড়ে আদর্শের পর্বত ছিল অটুট। যে আদর্শ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ – মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শ। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬ দফা তথা স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লিগ্যাল এইড কমিটির অন্যতম সদস্য হিসাবেও আব্দুর রহিম বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন। ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া আব্দুর রহিম ১৯৯৫ সালে চাঞ্চল্যকর কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম স্ফূলিঙ্গ ছিলেন। রাজনীতিকে মানুষের সেবা ও কল্যাণের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজসেবায় একনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতালসহ নানা সেবামূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর নামে দিনাজপুরে স্থাপিত “এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল” মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে চিকিৎসা ও সেবায় ২০১৭ সালে তৃতীয় ও ২০১৮ সালে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।
সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আব্দুর রহিম পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের জোনাল চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন মুজিব নগর সরকার কর্তৃক। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৮ ডিসেম্বর দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে সরকারি উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় মিত্রবাহিনীর স্থানীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্ণেল শমসের সিং তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সামরিক ট্রাইবুনাল তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আব্দুর রহিমক ২০১৮ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁকে এই বিরল সম্মানে ভূষিত করেন। স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের যখন সভাপতি তখন এম আব্দুর রহিমকে করেন অন্যতম সহসভাপতি। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুর রহিম ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের উপনেতা হিসাবে বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করেন। ১৯২৭ সালের ২১ নভেম্বর জন্মগ্রহণকারী আব্দুর রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি ডিগ্রি অর্জনের পর আইনজীবী হিসেবেও নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পাশাপাশি তিনি দিনাজপুর আইনজীবী সমিতিরও সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যা পরবর্তী শাসকদের কোন প্রলোভনই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি তাঁকে। বর্তমান সময়ে তাঁর মতো আদর্শবান, সৎ নিরহংকারী ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাজনীতিবিদের দেখা মেলাভার। পিতা হিসেবে তিনি গর্বিত পিতা। দুই পুত্রের একজন ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টের বিচারপতি। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করেন। অপর পুত্র ইকবালুুর রহিম দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ। চার মেয়ে ডাঃ নাদিরা সুলতানা, ডাঃ নাসিমা সুলতানা, নাফিসা সুলতানা ও নাজিলা সুলতানা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। এম আব্দুর রহিম সারাটি জীবন
ধ্যানগম্ভীর মৌন ঋষির মতো নীরবে শুধু কাজ করে গেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে।
২০১৬ সালের চার সেপ্টেম্বর ঢাকার বারডেম হাসপাতালে এ মহান নেতা চির অচেনার দেশে পাড়ি জমান লাখো-ভক্ত শুভানুধ্যায়ীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে। তবুও বেঁচে থাকবেন মানুষের স্মৃতিতে স্বীয় কর্মে অনন্তকাল ধরে – তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট