তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে- কালজয়ী গানের স্রষ্ঠা আর নেই

আপডেট: মে ৯, ২০২২
0

‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’— কালজয়ী এ গানটি ‍গেয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী তালাত মাহমুদ। রবিন ঘোষের সুরে গাওয়া গানটির মাধ্যমে বাংলা গানের জগতে নিজের জায়গাটাকে অবিনশ্বর করে তোলেন তিনি। মানুষের মুখে মুখে আজও উচ্চারিত হয় এই গান।

গানটি লিখেছেন কে? প্রশ্নটির উত্তর অনেকেরই অজানা। জানার চেষ্টাও আমাদের মধ্যে নেই। প্রতিটি সৃষ্টির স্রষ্টা সবসময় আড়ালে থাকেন, অথবা থাকতে পছন্দ করেন। কে জি মোস্তফার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বহুল শ্রোতাপ্রিয় এ গানটি লিখেছেন তিনি। অথচ বেশিরভাগ মানুষ তার নামটি জানেন না।

একজন গীতিকার, সাংবাদিক ও কবি হিসেবে কে জি মোস্তফা নামে অধিক পরিচিত। তিনি একজন সৌখিন হোমিওপ্যাথিক ‍চিকিৎসক। ষাটের দশকে নোয়াখালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

এ ছাড়া তাঁর লেখা ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানটিও অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ গানটি গেয়েছেন আরেক প্রখ্যাত শিল্পী মাহমুদুন্নবী সংগীতপিপাসু মাত্রই এ গানটি শুনলে আজও শিহরিত হয়ে ওঠেন।

রোববার (৮ মে) রাত সাড়ে আটটায় কে জি মোস্তফা নিভৃতে থেকেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর প্রকৃত নাম খন্দকার গোলাম মোস্তফা।

তালাত মাহমুদের ভাই ঢাকায় থাকতেন। সেই সুবাদে তিনি ঢাকায় আসেন। তরুণ নির্মাতা এহতেশাম সিদ্ধান্ত নিলেন ‘রাজধানীর বুকে’ সিনেমায় তালাতের কণ্ঠে গান যুক্ত করবেন। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। এই সিনেমার ইতিহাস হয়ে যাওয়া গীতিকবিতাটি লেখেন কে জি মোস্তফা।

২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে এই গান প্রসঙ্গে কে জি মোস্তফা জানান, তিনি তখন ছাত্র। গানের কথা লেখার জন্য তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি রবিন ঘোষের বাসায় যান। সেখানে গিয়ে জানলেন, সুরের ওপর গানের কথা বসাতে হবে। এ কথা শুনে কিছুটা শঙ্কিত হলেন। কারণ এতদিন নিজের মতো করে গান লিখেছেন। এখন সুরের ওপর লিখতে হবে।

রবিন ঘোষ গানের বিষয়ে ধারণা দিলেন। একইসঙ্গে দিলেন উৎসাহ। কিন্তু কে জি মোস্তফার মাথায় কিছুই আসছিল না। এদিকে রাত গভীর হচ্ছে। কে জি মোস্তফা এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাইলেন। তাঁর ভাষায়— ‘আমি ভাবলাম, আমি একটা কিছু লিখি। তারপর আমাকে বাদ দিয়ে দিক। এভাবে মুক্তি পেতে চেয়েছি।’

কে জি মোস্তফা জানান, সংগীতের একটা ছন্দ থাকে। তিনি সেভাবেই গানটি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। লিখলেন ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’। এক সময় গানের ‘স্থায়ী’ আবেদন তৈরি হয়। সুরের কারণে একটি শব্দ বদলাতে বলেন রবিন ঘোষ। কে জি মোস্তফা তা বদলে দেন। রবিন ঘোষ সদ্য লিখিত স্থায়ী কথাগুলো সুরে বসিয়ে গুনগুন করে গাইতে শুরু করেন। সে সময় সেখানে পরিচালক এহতেশাম আসেন। তিনি গানের কথা পছন্দ করলে কে জি মোস্তফা ভীষণ অনুপ্রাণিত হন। সারারাত চেষ্টার পর তিনি গানের বাকি অংশ লেখেন। সকালে রবিন ঘোষ কে জি মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়ান এবং পুরো গানের কথায় সুর বসিয়ে বারবার গাইতে থাকেন। যেন, চলমান ঢাকা শহরকে সামনে রেখেই যাচাই করে নিচ্ছিলেন নিজের সৃষ্টিকে।

কে জি মোস্তফার জন্ম ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মূলত গীতিকার হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি একজন সফল সাংবাদিক ও কলামিস্ট ছিলেন।

১৯৫৮ সালে দৈনিক ইত্তেহাদে শিক্ষানবিশ হিসেবে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। ওই বছরেই দৈনিক মজলুমে সহসম্পাদক পদে নিয়োগ পান কে জি মোস্তফা। পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত সেটিতেই কাজ করেছেন তিনি। এরপর দীর্ঘ বিরতি শেষে ১৯৬৮ সালে সাপ্তাহিক জনতায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।

স্বাধীনতার পর কে জি মোস্তফা প্রথমে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ ও পরে ‘দৈনিক স্বদেশ’ পত্রিকায় চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দৈনিক জনপদে কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন।

১৯৭৬ সালে কে জি মোস্তফা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে প্রথমে সম্পাদক ও পরে সিনিয়র সম্পাদক পদে উন্নীত হন তিনি।

কে জি মোস্তফার লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবনেই। ওই সময় থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে তার লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়ে আসছে। এক পর্যায়ে গান লিখতে শুরু করেন এবং তার লেখা বেশ কিছু গান অসামান্য জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৬০ সাল থেকে চলচ্চিত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে তার লেখা অনেক গান প্রচার হয়।

কে জি মোস্তফার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’, ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’, ‘ওগো লাজুক লতা শুধু এ লগনে’, ‘একি চঞ্চলতায় মন ভরেছে’, ‘সম্মুখে আজ না হয় থাকুক’।

একসময় তিনি নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকেও ঝুঁকেছিলেন। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ‘মায়ার সংসার’, ‘অধিকার’ ও ‘গলি থেকে রাজপথ’ ছবিতে। রয়েছে বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ, ছড়ার বই, গানের বই, গদ্যগ্রন্থ, গানের সিডি, ক্যাসেট।

তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ— ১. কাছে থাকো ছুঁয়ে থাকো ২. উড়ন্ত রুমাল ৩. চক্ষুহীন প্রজাপতি ৪. সাতনরী প্রাণ ৫. আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন ৬. এক মুঠো ভালোবাসা ৭. প্রেম শোনে না মানা ৮. মন চায় উড়ে যেতে।

গদ্যগ্রন্থ—১. কোথায় চলেছি আমি (সরস আত্মকাহিনী) ২. কবিতার প্রাণ-মন-দেহ। ছড়ার বই— ১. শিশু তুমি যীশু ২. কন্যা তুমি অনন্যা ৩. মজার ছড়া শিশুর পড়া।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগ কর্তৃক ‘দেশবরেণ্য গীতিকার’ পদকসহ আরও অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।