কাউন্সিলরদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক বহুমুখী সমস্যার সমাধান প্রয়োজন ঢাকার দুই সিটির —আইপিডি

আপডেট: মে ৩০, ২০২২
0

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরশনের উদ্যোগে নগরের জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে খাল ও জলাশয় উদ্ধার, সংস্কার ও পরিচ্ছনতা কার্যক্রম গ্রহণ, বাস রুট রেশনালাইজেশন এর মাধ্যমে ঢাকা নগর পরিবহন এর যাত্রা শুরু, এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বিগত দুই বছরে, যা প্রশংসার দাবী রাখে। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন নগর এলাকায় সড়ক খননজনিত দূর্ভোগ, খেলার মাঠ-গণপরিসর-উদ্যানের স্বল্পতা, ওয়ার্ড কাউন্সিল এর মাধ্যমে জনভোগান্তি কমানোর কার্যকর উদ্যোগের অভাবসহ স্থানিক জলাবদ্ধতা, বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা, মশার উৎপাতসহ প্রভূত সমস্যা নগরবাসীর নাগরিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। ঢাকা মহানগরীর অনেক উন্নত এলাকায় মানসম্মত নাগরিক সেবার যেমন দেখা মিলছে, ঠিক তেমনি এই নগরের অনেক ওয়ার্ডে নাগরিক সেবার একেবারেই বেহাল দশা। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ঢাকার নাগরিকদের নাগরিকদের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের মেয়রদের আন্তরিক উদ্যোগের পাশাপাশি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। একইসাথে ওয়ার্ডভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সাশ্রয়ী ও সহজসাধ্য উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নগরবাসীর জীবনে ন্যূনতম স্বস্তি দেবার আন্তরিক উদ্যোগ নেয়া দরকার। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে উপরোক্ত মতামতগুলো উঠে এসেছে অদ্য ৩০শে মে, সোমবার, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) কর্তৃক অনলাইনে আয়োজিত নগর সংলাপে, যার মূল প্রতিপাদ্য “ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দুই বছরঃ নাগরিকদের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা”।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত নগর সংলাপের মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড.আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদ্বয় তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছেন, পাশাপাশি এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আছে যেগুলোর বাস্তবায়নে এখনও তেমন কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। আবার নগর ব্যবস্থাপনায় শৃংখলা আনবার জন্য অন্যান্য নগর সংস্থাগুলোকে স্ব-স্ব বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা সিটি করপোরশেনের পরিকল্পনার সাথে সমন্বয়ের করিয়ে নেবার জন্য মেয়রদের আহবানে কম সাড়া পাবার কারণে সিটি করপোরশনেরন পক্ষে সার্বিক সমন্বয় করাটা কঠিন হচ্ছে। একইসাথে ওয়ার্ড কাউন্সিলকে শক্তিশালী করবার উদ্যোগ না থাকবার কারণে এলাকাভিত্তিক অনেক সমস্যার সঠিক সমাধান হচ্ছে না, পাশাপাশি জনভোগান্তিও বাড়ছে। আইপিডির পক্ষ থেকে মেয়রদের ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতিসমূহের সার্বিক পর্যালোচনা করেন অধ্যাপক আদিল ।

জনসাধারণের জন্য নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা ও বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলতে সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ড কাউন্সিল এর জন্য বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ ওয়ার্ড কাউন্সিলসমূহকে শক্তিশালী করা এবং ওয়ার্ড কমপ্লেক্স তৈরি, কমিউনিটি মবিলিটি প্ল্যান তৈরি করবার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক যানবাহন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা, বস্তিএলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সম্প্রসারণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, মানসম্মত গণপরিবহন নিশ্চিত করবার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা, সড়ক খননজনিত জনভোগান্তি কমাতে স্থানীয় পর্যায়ে তদারকি বাড়ানো, শিল্প বর্জ্য ও পয়ঃ বর্জ্য দূষণ সহ পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে এলাকাভিত্তিক মনিটরিং জোরদার করা, খেলার মাঠের অবৈধ দখল উচ্ছেদে উদ্যোগ নেয়া ও পার্ক-উদ্যান ইজারা দেয়ার উদ্যোগ বন্ধ করে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, ওয়ার্ড প্রোফাইল তৈরী করার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক নাগরিক সেবা ও অবকাঠামোর বিদ্যমান অবস্থা ও করণীয়সমূহ নির্ধারণের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, নগর এলাকাসমূহের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য দূর করবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া এবং নগর এলাকার প্রকৃত চাহিদা নির্ণয় করতে জনমত যাচাই ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওয়ার্ডের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম নির্ধারণ করা প্রভৃতি।

আইপিডি’র নগর সংলাপে পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম – পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ও শেলটেক কনসালটেন্টস লিমিটেড এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বিগত দুই বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ সমস্যা সমাধানে বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও নাগরিক সেবা প্রদানে তাদের আরো উদ্যোগ বাড়াতে হবে। ফুটপাত ও পায়ে হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত সুবিধাদি প্রদানসহ এলাকভিত্তিক গণপরিসর করবার কার্যকর উদ্যোগ নেবার পরামর্শ দেন আইপিডি’র এই পরিচালক।

পরিকল্পনাবিদ ড. চৌধুরী মোঃ জাবের সাদেক, পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এবং বাংলাদেশ পুলিশ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উন্নয়ন) বলেন, ঢাকার পার্কিং ব্যবস্থাপনা ও হকার ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশনের আরো কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে ঢাকার সড়কসমূহের কার্যকারিতা আরো বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে অন্যান্য নগর সংস্থাসমূহের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকার ট্রাফিক ইন্টারসেকশনগুলোর নকশা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার কার্যকর সংশোধন করে সড়কে যানজট এর পরিমাণ কমানো সম্ভব।

ড. ফরহাদুর রেজা, সহযোগী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নগর এলাকায় সড়কবাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খেলার মাঠ প্রভৃতি সুবিধাদি নিশ্চিত করা সম্ভব। অনেক খেলার মাঠে জনগণের সার্বজনীন প্রবেশাধিকার নেই উল্লেখ করে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক খেলার মাঠসমূহ নগরবাসীর জন্য শর্তসাপেক্ষে উন্মুক্ত করা গেলে নগরবাসীর খেলারমাঠ ও বিনোদন সুবিধাদির সংকট কাটানো সম্ভব।

রাজউক কর্তৃক প্রণীত ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রকল্প (ড্যাপ) এর পরামর্শক পরিকল্পনাবিদ আবু মুসা জিন্নাহ বলনে, মিরপু্রের বাউনিয়া, রুপনগর এলাকায় বিভিন্ন মহাপরিকল্পনায় চিহ্নিত খেলার মাঠ, জলাশয়গুলো অবৈধভাবে দখল করা হলেও নগর কর্তৃপক্ষসমূহ যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকা উদ্যান, খোলা জায়গাসমূহে নতুন করে ভবন তৈরি করে নগরে শিশু-কিশোরদের বিনোদন সুবিধাদি একেবারে সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে; এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই স্থানগুলোর সংরক্ষণের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এই পরিকল্পনাবিদ।

ঢাকার জুরাইন এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অনেকেই জনসেবার মাধ্যমে এলাকা ও এলাকাবাসীর উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন বেশী। তিনি আরো বলেন, জুরাইন এলাকার খেলার মাঠ-উদ্যান-গণপরিসর একবারেই না থাকবার কারণে শিশু-কিশোরেরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধসহ মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা‍য় ভুগছেন। জুরাইন এর অনেক এলাকাতে রাস্তা সংস্কার ও উন্নয়নের নামে রাস্তা উঁচু হয়ে যাবার কারণে অল্প বৃষ্টিতেই বসতবাড়ি জলাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এমনকি কিছু এলাকাতে বছরের অধিকাংশ সময় জলাবদ্ধ থাকে, যা চরম জনদূর্ভোগের কারণ বলে মন্তব্য করেন এই নাগরিক।

নগর সংলাপে অংশ নিয়ে ঢাকার উত্তরা, যাত্রাবাড়ি, কমলাপুর, মিরপুর, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা এলাকার বাসিন্দাগণ ফাহিম মন্ডল, আব্দুল আহাদ, মাহমুদুল হাসান, শায়লা আফরিন, মুনিম আব্দুল্লাহ, ইয়াসির আমিন, শফিকুল শাওন প্রমুখ নিজ নিজ এলাকায় সিটি করপোরশনের উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরবার পাশাপাশি এলাকার নাগরিক সেবার চ্যালেঞ্জ ও নাগরিক দূর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন। ঢাকা নগরের বিভিন্ন এলাকার নাগরিক সমস্যা ও নাগরিক দূর্ভোগ লাগবের জন্য এলাকাবাসীর সমন্বয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে বিষয়ভিত্তিক কমিটি তৈরী করবার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবার আহবান জানায় দেয় ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।