রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুমহান মর্যাদা এবং বেয়াদবির শাস্তি

আপডেট: জুন ১৭, ২০২২
0

হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। তিনি নবী-রাসূলদের সর্দার।
امام الانبیاء سید المرسلین، خاتم النبین، شفیع المذنبین، رحمۃ اللعلمین، اوّ من یرفع من القبور، اول ما یجازی الصراط فاتح للشفاعۃ، اول ما یقرع باب الجنۃ، اول من یدخل الجنۃ، وشرفہ اکرمہ اللہ تعالی بقولہ انک لعلی خلق عظیم۔

অর্থাৎ- নবী-রাসূলদের ইমাম, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল, পাপীদের জন্য সুপারিশকারী, সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত। তিনিই কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম কবর থেকে উঠে দাঁড়াবেন, সর্বপ্রথম পুলসিরাত অতিক্রম করবেন, উম্মাতের জন্য সর্বপ্রথম সুপারিশ করবেন, সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবেন এবং সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁর সম্মান ও মর্যাদা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
وَ اِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِیْمٍ

অর্থাৎ- আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী (সূরা কলম, ৪ আয়াত)।

তাঁর আগমনে বিশ্ববাসী পেয়েছে আলোর সন্ধান এবং তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ মানুষকে দিয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাঁর কাছে পেয়েছে তাদের আশার বাণী এবং লাভ করেছে ইহকাল ও পরকালের মুক্তি।

মহান আল্লাহপাক রাসূল (সা.)কে সারা বিশ্বের জন্য রহমতের প্রতীক হিসেবে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি’।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অতুলনীয় মর্যাদা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ আনসারী (রাযি.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, আমাকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এমন পাঁচটি বিষয় দেয়া হয়েছে, যা আমার আগে আর কাউকে দেয়া হয়নি। এতে আমার কোনো গর্ব নেই। (১) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলরা কোনো বিশেষ জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। আর আমি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি। (২) আমার জন্য দুনিয়ার সমগ্র মাটি মসজিদের মতো পরিণত করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ জমিনের যেকোনো অংশে উম্মতে মুহাম্মদিয়া যাতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারে। এর আগে অন্য কোনো উম্মতের এ সুযোগ ছিল না। (৩) আমার জন্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গণিমত) হালাল করে দেয়া হয়েছে। যা আমার আগে কারো জন্য হালাল ছিল না। (৪) আমাকে সাহায্য করা হয়েছে শত্রুর অন্তরে ভয়ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে। (৫) আমাকে ব্যাপকভিত্তিক সুপারিশের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে একটি করে বিশেষ সুপারিশের অধিকার দান করেছেন। অন্য নবীরা দুনিয়াতেই সেই অধিকার ব্যবহার করেছেন; কিন্তু আমি বিশেষ সুপারিশের এ অধিকার আমার উম্মতের জন্য সংরক্ষণ করেছি। যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করেনি, সে কিয়ামতের দিন এ সুপারিশের ফল লাভ করবে ইনশা আল্লাহ। (বুখারি ও মুসলিম)।

হাশরের ময়দানে রাসূল (সা.) মর্যাদার যে সুমহান স্থান লাভ করবেন তার নাম হলো মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থান। সেদিন তাঁকে হাউজে কাওসারের সার্বিক অধিকার দেয়া হবে। নবী (সা.) এক দিন সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান কাওসার কী? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, এটা জান্নাতের নহর। আমার প্রভু আমাকে এটি দেবেন বলে অঙ্গীকার বলেছেন। এতে অনেক কল্যাণ রয়েছে। আর আমার উম্মতরা হাশরের সেই ভীষণ দিনে এর থেকে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করবে।
হযরত রাসূলে কারীম (সা.)এর উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন- وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ অর্থাৎ- আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি। (সূরা ইনশিরাহ, ৪ আয়াত)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার হাতেই থাকবে আল্লাহ তায়ালার হামদের পতাকা। আদম (আ.) এবং তাঁর পর যত লোক এসেছে এবং আসবে সবাই আমার পতাকাতলে আশ্রয় নেবে। এটিও রাসূল (সা.)এর অন্যতম একটি মর্যাদা।

আল্লামা জামি (রাহ.)এর ভাষায়-
یا صاحب الجمال و یا سید البشر

من وجہک المنیرلقد نور القمر
لا یمکن الثناء کما کان حقہ
بعد از خدا بزرگ توئی قصہ مختصر

অর্থাৎ- হে জ্যোতির্ময়! হে মানব শ্রেষ্ঠ! আপনার পূত চেহারার দীপ্তি থেকেই চাঁদ আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা আপনার যথোপযুক্ত প্রশংসা করতে অক্ষম; বরং সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এটিই বলতে পারি আল্লাহর পর তাঁর সৃষ্টিকুলে আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মহাববত মুমিনের দ্বীন ও ঈমানের অংশ এবং তিনি ঈমানদারের জীবন ও কর্মের আদর্শ। নবী (সা.)এর মুহাব্বত ও ভালবাসা কেবল আবেগের বিষয় নয়, দ্বীন ও ঈমানের বিষয়। কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ কথা বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قُلۡ اِنۡ کَانَ اٰبَآؤُکُمۡ وَ اَبۡنَآؤُکُمۡ وَ اِخۡوَانُکُمۡ وَ اَزۡوَاجُکُمۡ وَ عَشِیۡرَتُکُمۡ وَ اَمۡوَالُۨ اقۡتَرَفۡتُمُوۡهَا وَ تِجَارَۃٌ تَخۡشَوۡنَ کَسَادَهَا وَ مَسٰکِنُ تَرۡضَوۡنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیۡکُمۡ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ جِهَادٍ فِیۡ سَبِیۡلِهٖ فَتَرَبَّصُوۡا حَتّٰی یَاۡتِیَ اللّٰهُ بِاَمۡرِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ

অর্থাৎ- বলুন, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত’। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সূরা তাওবা, ২৪ আয়াত)।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-
مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ وَ مَا نَهاکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ

অর্থাৎ- রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। (সূরা হাশর, ৭ আয়াত)।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধ সমর্পিত চিত্তে মেনে নেওয়াই ঈমানের আলামত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّمَا کَانَ قَوۡلَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذَا دُعُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَهُمۡ اَنۡ یَّقُوۡلُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ؕ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ

অর্থাৎ- মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এ মর্মে আহবান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার, মীমাংসা করবেন, তাদের কথা তো এই হয় যে, তখন তারা বলে: ‘আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম। (সূরা নূর , ৫১ আয়াত)।

হাদীস শরীফে নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন-
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

অর্থাৎ- “তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা থেকে, পুত্র থেকে এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হই। (হযরত আনাস (রাযি.)এর সূত্রে, বুখারী, কিতাবুল ঈমান, হাদীস- ১৫; মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদীস- ১৭৭)।

কুরআন ও হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশনা সর্বযুগে মুমিনের চেতনাকে জাগ্রত রেখেছে। তারা আল্লাহর নবীকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালবেসেছেন এবং সমর্পিত চিত্তে তাঁর আনুগত্য করেছেন। অন্যদিকে ঈমানের দৌলত থেকে বঞ্চিত লোকেরাই আল্লাহর নবীকে ত্যাগ করেছে এবং বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর বিরোধিতা করেছে। তাই খোদাদ্রোহীদের রাসূল-অবমাননার ঘটনা নতুন নয়। আর তাদের পরিণতিও কারো অজানা নয়। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও রিসালত-অবমাননার ঘটনা ঘটেছে এবং নবী-প্রেমিক সাহাবীগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন।

মদীনা মুনাওয়ারায় আবু ইফক নামক এক ব্যক্তি নবী (সা.)এর নিন্দা করে কবিতা রচনা করেছিল। সালিম ইবনে উমাইর (রাযি.) তাকে হত্যা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪/২৮২)।

ফাতহে মক্কার সাধারণ ক্ষমার সময়ও ইবনে খাত্তালকে ক্ষমা করা হয়নি। সে আত্মরক্ষার জন্য কাবা ঘরের গিলাফ ধরে রেখেছিল। ঐ অবস্থায় তাকে নবী (সা.)এর আদেশে হত্যা করা হয়। তার দুই দাসীকেও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল, যারা ইবনে খাত্তাল রচিত কবিতা লোকদের আবৃত্তি করে শোনাত। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৪০৩৫; আলকামিল ইবনুল আছীর, ২/১৬৯)।

হাদীসের কিতাবে একজন অন্ধ সাহাবীর ঘটনা আছে। তার দাসী রাসূলুল্লাহ (সা.)এর শানে গোসতাখি করত। সাহাবী তাকে নিষেধ করতেন। একদিন সে যখন আবার গোসতাখি করল তো সাহাবী তাকে তরবারি দিয়ে শেষ করে দিলেন। ঘটনাটি শোনার পর হুযূর (সা.) বললেন, دَمُھَا ھَدرٌ অর্থাৎ এ হত্যার কোনো শাস্তি নেই।

ইহুদি-নেতা কাব ইবনে আশরাফ নবী (সা.)এর শানে গোসতাখি করত এবং নিন্দা ও উপহাসমূলক কবিতা পাঠ করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা. তাকে খতম করেছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস, ৪০৩৭)।

নবী-যুগের এইসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, তাওহীনে রিসালাত বা রাসূল-অবমাননা একটি চরম অপরাধ, যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। উম্মাহর চার ইমাম এ বিষয়ে একমত।

আল্লামা শামী (রাহ.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিকারী ঈমান থেকে খারিজ ও হত্যার উপযুক্ত। চার ইমাম এ বিষয়ে একমত’।

সূত্র: উম্মাহ ডট কম