“ ধনী সিলেটের সেলিব্রেটি বন্যা আর গরীব কুড়িগ্রামের মিসকিনি বন্যা”

আপডেট: আগস্ট ৩, ২০২২
0

সুরাইয়া পারভিন

ঘষেটি বেগমের উপর যতই ক্ষুব্ধ হ’ন। জিঞ্জিরা প্রাসাদ আপনার দেখতে ইচ্ছে, না করার কিছু নেই। ঢাকার খুব কাছেই কেরানিগঞ্জে এই প্রাসাদ। জিঞ্জিরা যায়গার নাম শোনার অনেক আগেই জিঞ্জিরা প্রাসাদের কথা শোনা যায়। ঠাকুমার ঝুলির মত করে পলাশীর ঘটনা খুব ছোটবেলা থেকেই শিশুরা শুনে আসে। জিঞ্জিরা প্রাসাদ বলতে জিঞ্জির, শিকল – এসবই বুঝেছি। হতে পারে জিঞ্জির থেকেই জিঞ্জিরা হয়েছে। সেদিকে যাচ্ছি না।

কথা হচ্ছে ঐতিহাসিক এই দর্শনীয় স্থান, আপনি চাইলেই ঘুরে দেখতে পারছেন না। এর অস্তিত্ব গুগল ম্যাপে পেয়ে গেলেও। গোলকধাঁধার মত ঘুরতে থাকবেন। বুঝতে পারবেন, আপনি ঠিক সেই যায়গাতেই আছেন। কিছু সামনে এগিয়েছেন, কিছু পিছনে চলে এসেছেন। অথবা বৃত্তাকার ভাবে সে যায়গাকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন। কিছুতেই ধরতে পারছেন না।

কারন হলো – এই প্রাসাদ ঘিরেই তৈরি হয়েছে বাড়িঘর।আপনাকে বাড়ির সরু যায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। তারপরে এই রাজপ্রাসাদের সন্ধান পাবেন। এই পর্যন্ত পৌঁছাবেন জোর করে। এক পর্যায়ে রিক্সাও ছেড়ে দিতে হবে। এমনই সরু রাস্তা। স্থানীয়রা বিরক্ত হবে। তথ্য দিতে রাজি না। ইতিহাসের পাতায় থাকলেও, পরীক্ষার প্রশ্নে থাকলেও ; বাস্তবে এর অস্তিত্ব স্থানীয়রা স্বীকার করতে চায় না।

অভিশপ্ত প্রাসাদ, তাই বলে? হবে হয়তো। কিন্তু এর কোল ঘেঁষে তারা এতো আয়েশে থাকে কি করে? দুর্জনেরা বলে এরা দখলদার। দখলী সম্পদ আবার না বেহাত হতে চায়।স্থানীয়রা এ কাজে পরস্পর পরস্পরের সহযোগী।

কুড়িগ্রামে ফি বছর বন্যা হয়। পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া তারা নিয়তি হিসেবেই নিয়েছে। সরকারি, বেসরকারি ত্রাণ যা পায়। তাই নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে চায়। তারা নিত্য রুগী, কত আর সেবা চাইতে পারে!!

এবারেও বন্যায় তাদের ভাসালো। যা কিছু সহযোগীতা, তা নিয়ে হয়তোবা কোন ক্ষেদ ছিল না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো সিলেটের বন্যা সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে। মিডিয়া তাদের নিয়ে খবর যা কিছু প্রচার করছে। সীমাহীন কষ্টে থেকেও কুড়িগ্রামের প্রতি যেন তেমন মায়া হচ্ছে না। এমন বিমাতাসূলভ আচরন ক্ষুব্ধ অপমানিত হয় মানুষ।

“ধনী সিলেটের সেলিব্রেটি বন্যা আর গরীব কুড়িগ্রামের মিসকিনি বন্যা।”– কষ্ট, হতাশা মিশিয়ে সেখানকার কেউ এভাবেই লিখলেন। তারা প্রতিবছর মরছে, তাদের জন্য তেমন হাহাকার নেই। মনোযোগ পুরোটা সিলেটে। তুলনা করেই নিজেরা কষ্ট পেয়েছে। মিডিয়া, দেশ — তাদের জন্য কাঁদছে না কেন?

এটা অবশ্য ঠিক। বন্যা সিলেটে এসেছে প্রলয় হিসেবে। মানুষ হতভম্ব, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তলিয়ে যাচ্ছে, ভাসিয়ে নিচ্ছে। ঘুর্নীতে পাক খেয়ে মৃত্যুদুয়ারে পৌঁছছে।

তারপরেও কুড়িগ্রামের মানুষের দুঃখ যাবে কেন? ত্রাণ পরবর্তীতে অনেক সংগঠনই দিয়েছে। কিন্তু সরকারি, ব্যক্তি পর্যায়ের অনুভূতি এরা ছুঁতে পারে নি বলা যায়।

উজানের ঢল আর অতি বৃষ্টি এদের চুবনি দিয়ে যায়।কুড়িগ্রামের উপর দিয়ে তিস্তা ব্রক্ষপুত্র সহ অসংখ্য নদী এসেছে ভারত থেকে। বলা হয় ব্রক্ষার পুত্র তাই নাম ব্রক্ষপুত্র, সে নদ। ইনি হিমালয় থেকে নেমে কয়েকটা নাম নিয়ে অনেক দূর পথ পারি দিয়ে বিশাল বপু নিয়ে কুড়িগ্রামের উপর দিয়ে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন। আর সব নদীর মত সাপের মত আঁকাবাকা তো বটেই। সেই সাথে মেয়েদের চুল বাঁধা বেণীর মত এর গড়ন। যাকে বলে braided river. অসংখ্য চর আছে এতে। ধরে নিতে হয় বেণীর প্যাঁচের যায়গাটিতে আছে চর। নদীতে পানি বাড়ছে, তো চর প্লাবিত হচ্ছে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস শুকিয়েছিল। এখানে তিস্তায় পানির সমারোহ। তবে সে বর্ষায়। পানিতে যখন নদী টুইটুম্বর। তখন উজান থেকে ঢল নামে। উজান দেশের ব্যারেজ খুলে যায়।

শমরেশ মজুমদার তাঁর উত্তরাধিকার উপন্যাসে দেখিয়েছেন, তিস্তা ব্যারেজ তাদের জন্য কত প্রয়োজনীয় ছিল। তিলতিল করে প্রসূতিকে মরে যেতে হয়েছে।ডাক্তার বসে আছেন। তার হাতে কিছুই নাই। হাসপাতালে নিতে হতো রুগীকে। সেখানে নেয়ার উপায় নেই। তিস্তায় পানি বাড়ছে হু হু করে। এ তিস্তা ওপাড় বাংলার। উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, মৌষলকাল। জনপ্রিয় এই সিক্যুয়েল তিস্তা ব্যারেজের জন্য মানুষের অনুভূতি কি সুন্দর গেঁথে রেখেছে। তারা বাঁচার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে আর আমরা মরছি।

পাঠক হৃদয়ে নকশাল অনিমেষের জন্য বেদনার সাথে, ওর মায়ের মৃত্যুতে সমান হাহাকার আসে। তিস্তা ব্যারেজের অপরিহার্যতা প্রফুল্লচিত্তেই যেন মেনে নেয়। আহা আরও আগে কেন হলো না। এমন বোধ নিজের মাঝে কাজ করতে চায়। আমাদের দেশ ভাসছে, সে ওদের দৃষ্টির আড়ালে। মনে হয় শক্তিমান লেখক
ওই দেশের মানুষের চিন্তার, বিবেকের দায়মুক্তি দিয়েছেন।

ম্যাক্সিম গোর্কির “মা” উপন্যাস যেমন সমাজতন্ত্রকে মগজে ঢালাই করতে এসেছে। মনে হয় এই উত্তরাধিকার সিরিজ তিস্তা ব্যারেজকে নৈতিক অবস্থানে মানুষের কাছে যুক্তিযুক্ত করে গেছেন। তারা অপরাধবোধে ভোগে না। তারা বাধ্য, এই থিম।

প্রতিবেশি দেশের উন্নয়নেও আমরা মরি। নিজেদের উন্নয়নেও মরি।

কুড়িগ্রামের আরেক নদী বুড়িতিস্তা। একে সৌন্দর্যের ঘুঙুর পরানো হয়েছে। উন্নয়নের ফাঁদে ফেলে মুখ বন্ধ করে ফেলেছে। বলা হয় নদী পরিচর্যার নামে এ নদীর ভয়াবহ সর্বনাশ করা হয়েছে। এক সময় এটা ইংরেজি V এর মত প্রবাহিত হতো। ভি এর নিচের অংশ ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে যাওয়ায় বুড়িতিস্তা দুই ভাগ হয়ে যায়। উজানের অংশ তিস্তার উপনদী আর ভাটির অংশ তিস্তার শাখা ও ব্রক্ষপুত্রের উপনদী হয়ে গিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাটির তিস্তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। আর পুকুরের মত মাটি তুলে পাড় বাধাই করেছে। বলা যায় পৃথিবীর দীর্ঘতম পুকুর, যার এক দিক উম্মুক্ত। উজানের বুড়িতিস্তা নদীতে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ হয়েছে। জোর করে মানুষদের সব সুবিধা গিলিয়ে খাওয়াবে।

আসে নীলফামারীর স্বরমঙলা নদীর কথা। সবার মঙ্গল হতো তাই নাকি এ নদী সর্বমঙ্গলা — স্বরমঙলা। এ হচ্ছে সরুতম নদী। উপকারি গাছের ছাল থাকে না। উপকারি নদী পাড় খুইয়েছে। আশেপাশে বসত ভিটা। এই নদীকে কোনও যায়গায় বাড়ির মালিক ক্যানেল তৈরি করে দিয়েছেন। এ নদী উন্নয়নের ফাঁদে পরেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের নদী খাল নাম ধারন করছে। এ ভুল ইচ্ছাকৃত? অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে।

কপোতাক্ষ, ধানসিঁড়ি, তিতাস — এরা গল্প কবিতায় উল্লেখ না থাকলে কেউ আলাদাভাবে চিনতো না। এই নদীগুলোতে অবগাহন করার, দেখতে যাওয়ার লোক আছে। এদের শুকিয়ে যাবার, জর্জরিত হবার খবর তাই জানা যায়।

উন্নয়নের ত্রাসে, জিঞ্জিরা প্রাসাদের মতো করে আমাদের নদীগুলো হয়তো জিঞ্জির আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বন্যা ভাসিয়ে নিতে আসে। ডুবিয়ে মারতে আসে। প্রতিবছর ত্রাণের সাহায্য না দিয়ে এই নদীগুলোকে স্বাধীনভাবে আগের অবস্থানে চলতে কি দেয়া যায়?নদী, নদীতেই থাকুক ; বাড়িতে না আসুক। সে চাওয়া সকলের। উন্নয়নের শেকল ছিঁড়ে নদী যখন আছড়ে পরে, তার তাণ্ডবলীলা বড় ভয়াবহ হয়ে ওঠে।