অক্টোবরে সন্ত্রাসী হামলার শিকার ১৪ সাংবাদিক গ্রেফতার-২

আপডেট: নভেম্বর ১, ২০২১
0

বিএফইউজে’র মিডিয়া মনিটরিং রিপোর্ট

অক্টোবর-২০২১ মাসে দেশে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ১৪ জন সাংবাদিক। রাজধানী ঢাকাসহ পৃথক ৮টি স্থানে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫টি ঘটনায় সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে আক্রান্তরা অভিযোগ করেছেন। হামলা ছাড়াও একই মাসে ৬ সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তন্মধ্যে ২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। গ্রেফতার হয়েছেন দুই সাংবাদিক। এছাড়া জীবননাশের হুমকি ও নাজেহালের মুখে পড়েছেন আরও অন্ত ৫ জন সাংবাদিক।

আগের মাস সেপ্টেম্বরে দেশে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন ২০ জন সাংবাদিক। ওই মাসে ৬ সংবাদকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তার আগে আগস্ট মাসে দেশে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন ৬ সাংবাদিক। ওই মাসে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। হেনস্থা ও হুমকির সম্মুখীন হন আরও ৪ জন সংবাদকর্মী। জুলাই মাসে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন ৬জন সাংবাদিক। ডিজিটাল আইনে ১০ জনসহ বিভিন্ন মামলায় জুলাই মাসে আসামী হয়েছিলেন ১১জন সাংবাদিক। ওই মাসে হামলা, হেনস্থা ও হুমকির সম্মুখীন হন আরও ৭ জন সংবাদকর্মী।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)’র মনিটরিং সেল প্রধান প্রধান সংবাদপত্রসহ শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ওপর নজর রেখে এ তথ্য ও পরিসংখ্যান পেয়েছে।

বিএফইউজে’র সভাপতি এম আবদুল্লাহর তত্ত¡াবধানে এ মনিটরিং সেল কাজ করছে। মনিটরিং কমিটিতে রয়েছেন বিএফইউজে’র সহসভাপতি রাশিদুল ইসলাম (আহবায়ক), সহকারি মহাসচিব মো. সহিদ উল্লাহ মিয়াজী (যুগ্ম আহবায়ক) ও প্রচার সম্পাদক মাহমুদ হাসান (সদস্য সচিব)। বিচারহীনতার কারণে সাংবাদিক নির্যাতন অব্যাহত চলছে বলে উল্লেখ করে বিএফইউজে’র সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন এক বিবৃতিতে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ি ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
অক্টোবর মাসে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, নওগাঁ ও বগুড়ায়। হামলায় আহত ও লাঞ্ছিত সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন, বরিশালে দৈনিক দক্ষিণের সময়ের সম্পাদক আলম রায়হান, পত্রিকাটির প্রতিনিধি হাফিজ ও মশিউর, পটুয়াখালীতে যুগান্তরের দশমিনা প্রতিনিধি মো. মামুন তানভীর, নোয়াখালীতে ঢাকা প্রতিদিনের কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি নাসির উদ্দিন, নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায় আনন্দ টিভির নারী সাংবাদিক মনি ইসলাম, ঢাকার মিরপুর পল্লবীতে সাপ্তাহিক নতুন বার্তার সম্পাদক ইউসূফ আহমেদ, দৈনিক বাংলাদেশের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার এসএম জহির, বাংলানিউজ ২৪ ডটকমের স্টাফ করসপন্ডেট মিরাজ মাহবুব ইফতি, অনলাইন পোর্টাল জাগো কন্ঠের ক্যামেরা পার্সন মোহাম্মদ আলী, যুগান্তরের গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম খান, নওগাঁয় বৈশাখী টেলিভিশনের প্রতিনিধি এবাদুল হক ও বণিক বার্তার প্রতিনিধি আরমান হোসেন রুমন এবং বগুড়ায় প্রত্যাশা প্রতিদিনের শাহজাহানপুর প্রতিনিধি শাহীন।
এদিকে অক্টোবর মাসে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হওয়া সাংবাদিক জাকির হোসেন ইমনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাঁরই সহকর্মী এক নারী সাংবাদিক। ফেসবুকে ওই নারী সাংবাদিকের চরিত্র হনন করে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

====বিস্তারিত====

হামলার ঘটনা
২ অক্টোবর রাতে বরিশাল নগরীর বটতলা এলাকায় দৈনিক দখিনের সময় পত্রিকার কার্যালয়ে হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এলাপাতাড়ি কুপিযে পত্রিকাটির সম্পাদক আলম রায়হানসহ অন্তত ৩ জন সাংবাদিককে আহত করেছে। আহত অপর দুই সাংবাদিক হচ্ছেন- পত্রিকাটির বরিশাল বিশ^বিদ্যালয় প্রতিনিধি হাফিজ ও সরকারি সৈয়দ হাতে আলী কলেজ প্রতিনিধি মশিউর। সম্পাদক আলম রায়হান বেশ কয়েক দিন বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁর ডান হাতটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ও ডেইলী স্টার, ৪ অক্টোবর।
৬ অক্টোবর পটুয়াখালীর দশমিনায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসানের হাতে লঞ্ছিত হন স্থানীয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও যুগান্তরের দশমিনা দক্ষিণ প্রতিনিধি মো. মামুন তানভীর । সূত্র : যুগান্তর, ২১ অক্টোবর।
১১ অক্টোবর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে যুবলীগ নেতার হামলায় এক সাংবাদিক আহত হয়েছেন। দৈনিক ঢাকা প্রতিদিন ও আঞ্চলিক দৈনিক নোয়াখালী প্রতিদিনের সাংবাদিক নাসির উদ্দিনের ওপর বসুরহাট পৌরসভাপর মেয়র আবদুল কাদের মির্জার অনুসারী পৌর যুুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হামিদের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী এ হামলা চালায় । পৌর ভবনের দক্ষিণ গেটে এ হামলার পর আহত নাসিরকে লোকজন উদ্ধার করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায়। সূত্র : নয়াদিগন্ত, ১০ অক্টোবর।
১৯ অক্টোবর বগুড়ার শাজাহাপুরে শাহীন আলম নামের এক সাংবাদিক দুর্বৃত্তদের নৃশংস হামলার শিকার হন। বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রত্যাশা প্রতিদিনের সাংবাদিক শাহীনের দুই পা থেঁতলে দেয় হামলাকারীরা। পুলিশ জানিয়েছে, পূর্বশত্রæতার জেরে এ হামলা হয়েছে। মামলার পর দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ অক্টোবর।
২৩ অক্টোবর নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায় বক্তাবলী এলাকায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হামলার শিখার হন বেসরকারী আনন্দ টিভির নারী সাংবাদিক মনি ইসলাম। এ ঘটনায় মামলা হলে ২৬ অক্টোবর রাতে র‌্যাব-১১ হামলার মূল হোতা হাজী ওসমান গনিকে গ্রেফতার করে। সূত্র : যুগান্তর, ২২ ও ২৮ অক্টোবর
২৮ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হযেছেন চার সাংবাদিক। একটি এতিমখানা থেকে শিশুদের বের করে দখলের খবর পেয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাপ্তাহিক নতুন বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক ইউসূফ আহমেদ, দৈনিক বাংলাদেশের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার এসএম জহিরুল ইসরাম, বাংলানিউজের স্টাফ করসপন্ডেন্ট মিরাজ মাহবুব ইফতি ও অনলাইন পোর্টাল জাগো কন্ঠের ক্যামেরা পার্সন মোহাম্মদ আলী নামে চার সাংবাদিক সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। স্থানীয় যুবলীগ নেতা আল মাহমুদ নয়ন ও তার সহযোগীরা এ হামলা চালিয়েছে বলে থানায় দায়েরকৃত এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউসূফ আহমদের জখম ছিল গুরুতর। তিনি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। অন্যদের মধ্যে বাংলানিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক রয়েছেন। হামলাকারীরা সাংবাদিকদের ক্যামেরা, মোবাইলসহ বিভিন্ন জিনিষ ছিনিয়ে নেয়। সূত্র : বাংলানিউজ২৪ ডটকম, ২৯ অক্টোবর।
৩০ অক্টোবর সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন দৈনিক যুগান্তরের গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম খান। ইউপি নির্বাচনে আচরণবিধি লংঘন করায় ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করেন স্থানীয় চাঁদপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মিজানুর রহমানের সমর্থকদের। তারা জরিমানা না দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসহ অন্যদের ঘিরে ফেলেন। এ সময় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ছবি তুলছিলেন সাংবাদিক খোরশেদ। তখনই প্রার্থীর সমর্থকরা তার ওপর হামলে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন মেডেকেল করেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সূত্র : আজকের পত্রিকা, ৩১ অক্টোবর।
৩০ অক্টোবর নওগাঁ’র ২৫০ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতাল চত্ত¡রে লঞ্ছিত হন দুই সাংবাদিক। ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের হাতে বৈশাখী টেলিভিশনের নওগাঁ প্রতিনিধি এবাদুল হক ও বণিক বার্তার জেলা প্রতিনিধি আরমান হোসেন রুমন আক্রান্ত ও আহত হন। সূত্র : নয়াদিগন্ত, ৩১ অক্টোবর।

মামলা ও গ্রেফতার
১৯ অক্টোবর কুষ্টিয়ায় ডিজিটাল আইনে করা মামলায় গ্রেফতার হন দৈনিক যায় যায় দিনের সাংবাদিক ফরহাদ আমীর টিপু। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি ও বিকৃত ছবি শেয়ার করার অভিযোগে কুমারখালী উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ ইমরান বাদী হয়ে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন। এর পর থানায় কথা বলার জন্য ডেকে নিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। সাংবাদিক টিপুর পরিবার বলছে, মোবাইল রেখে বাসার বাইরে যাওয়ার পর তাঁর ৭ বছরের শিশুপুত্র টিপাটিপি করার সময় একটি পোস্ট শেয়ার হয়ে যায়। দেখার পর ১৫ মিনিটের মধ্যে তা ডিলিট করে দেওয়া হয়। তবুও মামলা এবং গ্রেফতার থেকে রক্ষা পাননি টিপু। সূত্র : দেশ রূপান্তর, ২০ অক্টোবর।
প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিলের বিরুদ্ধে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে মামলা করেন সর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অস্ট্রিয়া প্রবাসী নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। ১৯ অক্টোবর করা এ অভিযোগে তাসনীম খলিলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ করা হয়েছে।
বেসরকারি চ্যানেল-২৪ এর বার্তা সম্পাদক ও প্রতিবেদক মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের ছেলে মুশফেক আলম সৈকত। পারিবারিক বিষয়ে মানহানিকর সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে ২৭ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে এ মামলা করা হয়। ২২ অক্টোবর চ্যানেল-২৪ এ সংবাদটি প্রচারিত হয়। সূত্র : যুগান্তর, ২২৮ অক্টোবর।
উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে দৈনিক নয়া দিগন্ত লোহাগাড়া সংবাদদাতা আরফাত হোছাইন বিপ্লব ও দৈনিক আজাদী লোহাগাড়া প্রতিনিধি মোহাম্মদ মারুফকে একটি মামলার আসামি করা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লোহাগাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক এলডিপি নেতা জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুলের পক্ষে তার দেয়া ক্ষমতাপত্র মূলে মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ (৩১) এ মামলা দায়ের করেন।
রাজধানীর রামপুরা থানায় দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ২৬ অক্টোবর রাতে গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক সমকালের সহ সম্পাদক জাকির হোসেন ইমন। পরে আদালত তাঁর জামিন নাকচ করে জেলে পাঠিয়েছে। ২৮ অক্টোবর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ উর রহমান তাঁর জামিন নাকচ করেন।

হত্যার হুমকি
৭ অক্টোবর পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে গিয়ে হুমকি ও নাজেহালের শিকার হন কয়েক জন সাংবাদিক। প্রান্তিক চাষিদের গমের টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গেলে এক ব্যাংক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘হু আর ইউ’ বলে হুংকার দিয়ে দুর্ব্যবহার করেন। সূত্র : ইত্তেফাক, ৮ অক্টোবর।