আবরার মরে গিয়ে বেঁচে গেছে ,আমরা বেঁচে আছি মরার মত

আপডেট: অক্টোবর ১২, ২০২২
0

ডা জাকারিয়া চৌধুরী :

নাম কি ?
-আম্মান। এক কথায় উত্তর।

‘আরমান’ তা মা দূর থেকে ছেলের ভুল শুধরে দিল। বয়স তাঁর কতো হবে ? বড়জোড় আড়াই বছর। এই বয়সী বাচ্চারা অপরিচিত কারো কথায় কান দেয় না। নিজের কাজকেই সবচে দরকারি কিছু মনে করে। সে দিয়েছে। তাঁর স্বতস্ফুর্ততা আমাকে মুগ্ধ করল। সে বসে আছে তাঁর নানুর পাশে। নানু লাউ কাটছে। আজ বিশেষ দিন। লাউ দিয়ে হাসের মাংসের পাতলা ঝোল হবে। কড়া করে ভাজা শোল মাছের দো’পিয়াজি হবে ঝোল ছাড়া। নানি – নাতি ক্ষীন স্বরে আলাপে মগ্ন। আমার খুব ইচ্ছে করছে তাদের আলোচনা শুনতে। সবচে বড় কথা হচ্ছে এই সিকি মার্কা শিশুটা বসে বসে কাচা লাউয়ের বিচি খাচ্ছে। এই নিয়ে দু’জনার কারোর-ই কোন বিকার আছে বলে মনে হচ্ছে না।

কাঁচা লাউয়ের বিচি খাচ্ছো কেনো – কৌতূহল দমাতে না পেরে এক সময় জিগেস করেই ফেললাম।
-মিতামিন খাই।
‘আরমান ভিটামিন খায়। ডিস্টার্ব করিস না তো’ – সেজো খালা আমাকে থামিয়ে দিলেন। আলোচনায় ছেদ পড়ায় দুজনেই খুব বিরক্ত। আমি ভেবে পেলাম না, কাঁচা লাউয়ের বিচিতে এই ছেলে ভিটামিনের সন্ধান পেল কিভাবে। তৃতীয় প্রশ্ন করারও সাহস পেলাম না। এদিকে বাচ্চা পেলে আমি সরে যেতে পারি না। এদের সাথে কোন না কোন বিবাদে লিপ্ত আমি হবোই।

একবার আট নয় বছর বয়সী এক বাচ্চাকে জিগেস করলাম –
জাতীয় ফুলের নাম কি ?
শাপলা- তাঁর চটপটে উত্তর।
গাব ফুল- আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললাম। সেই বাচ্চা মিনিট
পাচেকের মধ্যে অন্তত কুড়ি পচিশজনকে ডেকে আনলো। এবার সবার সামনে আমাকে জিগেস করল – জাতীয় ফুলের নাম কি ?
কদম ফুল। বর্ষার শুরুতে ফুটে। একেকটা কদম ফুলকে আমার একেকটা চন্দ্র সুর্য দেবতা মনে হয়।

এক সাথে এত অপরাধ মাথায় নেবার মত ক্ষমতা তাঁর ছিল না। সে সবার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। যাদেরকে স্বাক্ষী হিসেবে ডেকে এনেছিল তাদের সামনে তাঁর মান ইজ্জতের দফারফা। নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে মামার হাতে সে কঠিন জব্দ হয়েছে বলে মনে হল। নিজ মনে-ই বিরবির করে বলতে লাগল- প্রথমে মামা বলছে গাব ফুল হচ্ছে জাতীয় ফুল। এখন বলছে কদম। আবার বলছে কদম নাকি চন্দ্র সুর্যের মত-ই দেবতা। আচ্ছা চন্দ্র সুর্য কি দেবতা ? সে কি বুঝে সে কত বড় গুনাহের কাজ করল ? এই বাড়িতে থাকার তো কোন মানে দেখি না। যাদেরকে ডেকে এনেছিল তাদের কাছেও তাঁর কিছু বলার নেই। প্রসঙ্গ পাল্টে গেছে। সে শক খেয়ে বোবার মত বসে আছে।

গত দুই দিন আমিও বোবার মত বসে আছি। দুই যুগ রাজনীতি করে এখন রাজনীতির ভিটামিন খুঁজছি। জাতীয় ফুল কি বোঝার চেষ্টা করছি। জাতীয় স্বার্থ কারে কয় তা এখনো ঠাহর করতে পারছি না। সরকার তো জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করে এমন কিছু করে না। অথচ এ নিয়ে কথা বলার অপরাধে-ই আবরারকে মরতে হল ! আমার খটকা যায় না। ভাবি, জাতী কি ? জাতীর অভিভাবকত্ব করে কারা ?

এমন শত শত প্রশ্ন। এরপরে নিজ মনেই নিজেকে শোনাই, নাহ, আবরার মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আমি বেঁচে আছি মরার মত। অথবা আমরা বেঁচে আছি এক রকম মরার মত। আমাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই। কথা বলার সুযোগ নেই। রাজনীতির পথ খোলা নেই। উল্লেখ করার মত হাজার কথা পেটে জমা থাকে। বলার সুযোগ নেই। আগেও বলেছি, আবারও বলছি – সুখরঞ্জন বালী বিবাদী পক্ষের হয়ে সত্য স্বাক্ষ্য দিতে চেয়েছিল। তাঁর স্থান হয়েছে ভারতের কারাগারে।

কথা বলতে চেয়েছিল সালাউদ্দিন। ইলিয়াস আলী সুরমা’র পাড়ে সিলেটবাসীকে দাঁড় করিয়েছিল বরাক ড্যাম বন্ধের দাবিতে। এই সামান্য অপরাধে ( এটা অপরাধ কিনা সে প্রশ্নের ফয়সালা করবে ইতিহাস ) সে ‘নেই’ হয়ে গেছে সেও এক দশকের কাছাকাছি সময় তো হবে-ই। আবরার নামের সদ্য কৈশোর পার করা এক যুবকের পছন্দ ছিল- চালের পাতলা রুটি সাথে গরুর মাংসের ঝোল। সে দেশ সেরা একজন স্টুডেন্ট, বুয়েটের ছাত্র। মায়ের ন্যাওটা ছেলে। তা না হলে বাড়ি থেকে ঢাকা ফেরার পথে মা কেন তাকে বাসে তুলে দিয়ে আসতে হয় ? ঘন্টায় ঘন্টায় মা খোঁজ নিয়েছেন ছেলের যাত্রা কতদূর…… বাসের গতি নিয়ে ঢাকার পথে যতটা দূর সে সেকেন্ডে সেকেন্ডে এগিয়ে যাচ্ছিলো, মৃত্যুর দেবতা যমরাজ যেন ততটাই কাছে এগিয়ে আসছিল। সে অনেক গুলো মানুষ নামের পশু রুপে আবরারের অপেক্ষায় ছিল। মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গিয়েছিল বেশ আগেই। কারন কি ? নাজমুস সাকিব নামের একজন আবরার হত্যার সাফাই গাইতে গিয়ে পরদিন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন। ‘আবরার বেঁচে থাকলে কি হতো ? একজন জঙ্গি ইঞ্জিনিয়ার-ই তো পয়দা হত। এরচে বেশি কি ? আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম- বড় হয়ে কে কি হবে সেটাও তারা আগে ভাগে-ই জেনে ফেলে সম্ভবতঃ কোন এক গায়েবী জপে’র মাধ্যমে। তাঁর কথায় মনে হয়, আবরারকে হত্যা করে দেশকে অগ্রিম জংগিমুক্ত করা-ই উচিত কাজ হয়েছে। বড় হয়ে কে কি হবে তার কি শাস্তি দিতে হবে এই ওহী নাজমুস সাকিবকে কে দিয়েছে ? এর বিচার নামক হত্যা কান্ডের সাফাই গাইবার শক্তি তাকে কে দিয়েছে ? প্রশ্ন হাজার…… আজ যারা আবরার হত্যার স্মরন সভায় যাচ্ছে তাদেরকে পিটিয়ে রক্তাক্ত কে করেছে। এই অধিকার দানবীয় শক্তি তাদের কে দিচ্ছে। আদালতের চোখে তারা জামিনের যোগ্য হতে পারছে না। তাই তারা জেলখানায় আছে। হামলাকারীরা এই জংগলে হায়েনার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আরেকজনের কথা শুনছিলাম। তাঁর বক্তব্য অনেকটা এমন যে, এই ফ্যামেলি তো আওয়ামী গোত্রের। আওয়ামী গোত্রের হয়েও তাকে খুন হতে হবে কেন ? তিনি কি বলতে চাইলেন ? আওয়ামী ঘরানার বাইরে হলে খুন করা যাবে ? এদেশে যখন-ই স্পেসিফিক কিছু পলিটিশিয়ানকে দেখি নীতি আর সততা রক্ষার আন্দোলনে একা-ই পথে নেমে গেছেন তখন থেকে-ই আমি দিন গুনতে শুরু করি। ভাবি, এই অসভ্যটা কত টাকায় রফা করবে। আওয়ামী সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে সম্ভবতঃ জনৈক বাঘ সিদ্দিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় প্রতি মংগলবারে সরকারকে তুলোধুনো করে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। ধর্মীয় ফতোয়ার আদলে উনি-ই ঠিক করে দিচ্ছেন কোনটা জায়েজ কোনটা মুনাফেকী, আরও কত কি ? এর মধ্যে একটা ঘটনা খুব মনে পরে। তিনি প্রতি শুক্রবার মোহাম্মদপুরের এক মসজিদে যান জুম্মার নামাজ আদায় করতে। সেখানে এসি নাই। এই নিয়ে সরকারের এমন কোন স্তর নাই যেখানে তিনি কন্ঠযুদ্ধ করেন নাই শুধুমাত্র ঈমানদার মুসলিমদের স্বার্থে। এক সময় তিনি ভারতকেও হুশিয়ারি দিচ্ছিলেন, হাসিনা সরকারের পাশে থাকলে ভারতকে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে।

তাঁর কিছুদিন পরে যখন তাঁর নিজের সংসদীয় আসনটি খালি হলো, তখন হাসিনার অনুগ্রহের আশায় বললেন- জীবনে বোন পেয়েছি। কিন্তু হাসিনার মত এতো স্নেহশীল দায়িত্বপরায়ন বোন দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। তারপর বউ নিয়ে গনভবনে প্রবেশের চেষ্টা করেন। সেটা ব্যার্থ হয়। আবার এক সময় তাঁর ক্ষোভ গগনে উতলে উঠল কোন এক কারনে। তিনি দিলকুশা মতিঝিল পাম্পের সামনের এক ফুটপাতে বসে পড়লেন। যতদিন এই সরকার উৎখাত না হবে ততদিন তিনি উঠবেন না। সরকার উৎখাত হলো না, তাকেও কেউ কিছু বলল না। মাস দুই না যেতে-ই দেখলাম তাঁর বউয়ের দৌড় ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। কাদেরের মত লোক কি রাস্তায় পরে পরে মরবে নাকি ? গত নির্বাচনের আগে কিছুদিন বিএনপি’র সাথে লটরপটর করলেন। তারপর আগের দালালীতে ফেরত গেলেন গামছা সমেত।

এরা হচ্ছে আমাদের দেশের স্টার পলিটিশিয়ান। এদের চরিত্র এবং ব্যাক্তিগত ইমেজ যদি এই লেভেলের হয় তখন জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে একটা দেশের সকল অংগই যে এক সময় ফাঁপা খোল হয়ে যাবে তাতে অবাক হবার কি আছে ? এদেশে মেধাবীরা এমনিতেই পলিটিক্স বিমুখ। এর পরেও যে কিছু মানুষ এই মাটি কামড়ে পরে থাকতে চাইছে, খবর নিয়ে দেখুন নিজ দলে তাদের কি বেহাল অবস্থা। অশিক্ষিত মুর্খ শয়তানের দল সব একাট্রা হয়ে সিন্ডিকেট তৈরী করে রাখে। এই সিন্ডিকেটের আজীবনের অংশ হয় প্রশাসন। ক্লাসে মধ্যম সারির ছেলে মেয়েরা-ই এদেশে প্রশাসন যন্ত্রের এখনো মূল শক্তি। এদের আজীবনের ক্ষোভ থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে প্রথম সারির ছাত্রদের উপরে। এই রোষ থেকে বাঁচতে একদল শিক্ষিত যুবক শুরুতে-ই দেশের বাইরে চলে যায়, আর ফিরে না। যারা থাকে তারা একটা জ্বলন্ত অগ্নিমুখে বসে জীবন পার করে।

আবরার, ভাই আমার তুমি বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলেও পরিচয় ছিল না। তোমার মৃত্যু একদিক দিয়ে সুফল দিয়েছে। এই দেশের মানুষ শত্রু মিত্র চিনেছে খুব ভাল করে। ২০০৭ সালের পর তুমি-ই সম্ভবত একমাত্র মানুষ যে দেশের জন্যে প্রান দেয়ার আগে দেশ নিয়ে তোমার ভাবনা লিখে গিয়েছিলে। এ জাতী তোমাকে মনে রাখবে না নিশ্চিত থাকো। আবার তুমি এটাও নিশ্চিত থাকো, তুমি আমার চোখে অন্তত একজন নিষ্পাপ শহীদ। তুমি দেশের জন্যেই প্রান দিয়ে গেলে। যারা তোমার প্রকৃতির মানুষ তারা কখনো-ই ভাবে না, কে কারে মনে রাখল কিংবা রাখল না। তোমার প্রাপ্তি এটাই। আরেকটা কথা বলি, তোমার জানাজার সময়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটা রিক্সা ড্রাইভার, ভিক্ষুক, কুলি , মজুরকে আমি কাঁদতে দেখেছি। মানুষের এতো এতো দোয়া বিফলে যায় না। পাপ ও পুন্যের আলাদা আলাদা চিত্র এক সময় ভেসে উঠে। মানুষ প্রকাশ্যে বলতে না পারলেও গোপনে হলেও বলে। আর যিনি আসমান এবং জমিনের সকল কিছুর অধিকারী তিনি মানুষের মনের কথা বুঝেন না, তা কি হয়, বলো ?